×
Logo

অন্যান্য

আইফার্মারের কৃ-শপ তৈরি করছে কৃষি ব্যবসার নতুন ডিজিটাল সংস্কৃতি

অনলাইন ডেস্ক

প্রকাশ: ২১ অক্টোবর ২০২৫, ০৭:১১ পিএম

আইফার্মারের কৃ-শপ তৈরি করছে কৃষি ব্যবসার নতুন ডিজিটাল সংস্কৃতি

বগুড়ার নন্দীগ্রাম উপজেলার মুরাদপুর বাজারের কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী ফারিহা ট্রেডার্সের মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন। ছোট্ট দোকান হলেও এলাকার কৃষকদের বেশির ভাগই তার কাছ থেকেই বীজ, সার ও কীটনাশক কেনেন। কিন্তু আগে পণ্য মজুত রাখতে হিমশিম খেতে হতো তাকে। প্রতিটি কোম্পানির প্রতিনিধির সঙ্গে আলাদাভাবে যোগাযোগ রাখা, দাম সমন্বয়ের ঝামেলা সামলানো, কখনও দেরিতে সরবরাহ—সব মিলিয়ে হিসাব রাখা ছিল কঠিন কাজ।

কিন্তু এখন সেই দৃশ্য পাল্টেছে। তার ফোনেই দোকান সামলানোর সব ব্যবস্থা আছে। কয়েকটি ট্যাপ করেই তিনি বীজ, অণুখাদ্য, পশুখাদ্য ও কৃষিযন্ত্রের অর্ডার করতে পারেন। খুব দ্রুত পণ্য চলে আসে দোকানে।

ফরহাদ বলেন, আগে ফোন করে বা কখনও গিয়ে অর্ডার দিতে হতো। কার কাছ থেকে কী আনছি, সেটা লিখে রাখতে হতো খাতায়। অনেক সময় পণ্য শেষ হয়ে যেত, তখন কৃষকদের ঠিক সময়ে উপকরণ সরবরাহ করতে পারতাম না। এতে কৃষকেরা অসন্তুষ্ট হতেন।

তিনি আরও বলেন, এখন অ্যাপের মাধ্যমেই সবকিছু দেখা যায়—দামের পার্থক্য, নতুন পণ্য, কোনটা শেষ হয়ে গেছে—সব তথ্য হাতের নাগালে। তিনি যে অ্যাপটির কথা বলছিলেন, সেটি দেশের প্রথম এবং সবচেয়ে বড় কৃষি উপকরণ মার্কেটপ্লেস কৃশপ, যা তৈরি ও পরিচালনা করছে দেশের অন্যতম এগ্রিকালচার কোম্পানি আইফার্মার।

ফরহাদের মতো হাজারও কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ী এখন কাজ করছেন আইফার্মারের কৃ-শপের মাধ্যমে। দেশের গ্রামীণ অর্থনীতিতে এই খুচরা বিক্রেতারাই কৃষকের প্রথম ভরসা। তাদের মাধ্যমেই কৃষকরা বীজ, সারসহ অন্যান্য কৃষি উপকরণ পান এবং পরামর্শও নেন।

বাংলাদেশের প্রায় ৪০ শতাংশ মানুষ জীবিকার জন্য কৃষির ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু কৃষি উপকরণের বাজারের বড় অংশ এখনও অনানুষ্ঠানিক, যেখানে অনেক বিক্রেতা মূলধনের অভাব ও সরবরাহ সংকটে ভোগেন। অনেকেই হাতে লেখা খাতায় লেনদেন রাখেন, ফলে ক্রেতা বা পণ্যের হিসাব রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। আবার ডিস্ট্রিবিউটরের কাছ থেকে নগদে পণ্য কিনতে হয় বলে অনেক সময় ব্যবসা বাড়ানোও সম্ভব হয় না।

এই বাস্তবতায় কয়েক বছর আগে যাত্রা শুরু করে আইফার্মারের কৃ-শপ। এটি একটি ই-কমার্স অ্যাপ, যা সরাসরি কৃষি উপকরণ বিক্রেতাদের জন্য তৈরি। অ্যাপটির মাধ্যমে তারা এখন এক প্ল্যাটফর্মে ১৬০০-এর বেশি পণ্যের অর্ডার করতে পারেন—বীজ, সার, কীটনাশক, কৃষিযন্ত্র, পশুখাদ্য সবই পাওয়া যায় এক জায়গায়।

কৃ-শপ বিক্রেতাদের জন্য এনেছে বেশ কিছু সুবিধা। এর মাধ্যমে তারা দোকানের মজুতপত্র ডিজিটালি দেখতে পারেন, বাকির হিসাব রাখতে পারেন, প্রয়োজনে ক্রেডিটে পণ্য কিনতে পারেন এবং বিকাশের মাধ্যমে পেমেন্ট করতে পারেন। এ ছাড়াও অ্যাপে রয়েছে কমিউনিটি সেকশন, যেখানে দেশের বিভিন্ন এলাকার বিক্রেতারা পণ্য, দাম ও বাজার নিয়ে আলোচনা করেন। এতে তারা নতুন তথ্য, কোম্পানির অফার বা কৃষকের চাহিদা সম্পর্কে দ্রুত জানতে পারেন।

শুরুতে কৃ-শপ ৯ জেলায় প্রায় সাত হাজার খুচরা ব্যবসায়ী নিয়ে কাজ শুরু করেছিল। এখন সেই সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজারের বেশি, কার্যক্রম চলছে ৪২ জেলায়। শুধু কৃষি উপকরণ ব্যবসায়ীরাই নয়, এই অ্যাপের সুফল পৌঁছেছে দেশের প্রান্তিক কৃষকদের কাছেও। বিক্রেতারা এখন নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে মানসম্মত উপকরণ সংগ্রহ করতে পারছেন, আর সময়মতো সরবরাহও নিশ্চিত হচ্ছে। ফলে কৃষকেরাও পাচ্ছেন মানসম্মত পণ্য ও ন্যায্য দাম।

সব কৃষি উপকরণের মধ্যে বীজই কৃষকের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। ভালো বীজ মানেই ভালো ফলন—এ কথা কৃষকেরা বারবার বলেন। তাই কৃ-শপে বীজের ভাণ্ডারও সমৃদ্ধ। এখানে এখন পাওয়া যাচ্ছে বিভিন্ন ধরনের ভুট্টা ও সবজির বীজ। তালিকায় রয়েছে বিভিন্ন কোম্পানির পণ্য, আবার আছে আইফার্মারের নিজস্ব হাইব্রিড (এফ১) বীজও। সহজলভ্য হওয়ায় অনেক কৃষক এগুলো ব্যবহার করছেন। দেশের প্রায় ২৫ হাজার ৬০০ কৃষক এখন পর্যন্ত আইফার্মারের বীজ ব্যবহার করেছেন। তাদের মতে, ভালো বীজ হাতে পেলে ফসল ও আয়ে দুটোতেই পরিবর্তন আসে।

এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি আস্থা অর্জন করেছে আইফার্মারের নিজস্ব উদ্ভাবিত হাইব্রিড ভুট্টা বীজ, যা এখন অনেক কৃষকের কাছে নির্ভরযোগ্য একটি নাম। রাজশাহীর চাষি মো. রাজ্জাক এই বীজ ব্যবহার করে এক বিঘা জমিতে তুলেছেন প্রায় ১৭০ মণ ফলন—যা এলাকার গড় উৎপাদনের তুলনায় অনেক বেশি। তিনি বলেন, “এই জাতের গাছ মাঝারি উচ্চতার, মোটা ও সবল। সহজে হেলে পড়ে না। দানাতে আর্দ্রতা কম, মোচাও বড়—সংগ্রহ করতে সুবিধা হয়।”

চাষিদের মতে, এই আগাম জাতের ভুট্টা শুধু ফলনেই নয়, রোগসহনশীলতাতেও ভালো ভূমিকা রাখছে। অনেকেই বলছেন, আইফার্মারের বীজ ব্যবহার শুরু করার পর থেকে উৎপাদন বেড়েছে, আয়ও হয়েছে তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল।

ভুট্টার পাশাপাশি কৃ-শপ এখন পাওয়া যাচ্ছে ১৭৮ ধরনের সবজি বীজ। এর মধ্যে রয়েছে কুমড়া, করলা, টমেটোসহ নানা ফসলের জাত। সিরাজগঞ্জের ফরিদুল ইসলাম ‘স্পটলেস ব্ল্যাক’ কুমড়া চাষ করে বাজারে ভালো দাম পেয়েছেন। আত্রাইয়ের কৃষক মো. মিরাজুল আইফার্মারের এফ১ করলার বীজ ব্যবহার করে দেখেছেন রোগ কম ধরছে, গাছও হয়েছে সবল। তাদের হিসাবে, আগের তুলনায় ফলন বেড়েছে পাঁচ থেকে দশ শতাংশ, আর আয় বেড়েছে তিন থেকে পাঁচ শতাংশ।

বিশেষজ্ঞদের মতে, কৃ-শপের মতো রিটেইলারকেন্দ্রিক ডিজিটাল প্ল্যাটফর্ম নীরবে বদলে দিচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতির চিত্র। আগে যেখানে উপকরণ বিক্রেতাদের জন্য পণ্য মজুত, সরবরাহ ও হিসাব রাখা ছিল জটিল, এখন তা সম্ভব হচ্ছে এক অ্যাপের মাধ্যমেই। বিক্রেতারা এখন আরও দক্ষভাবে দোকান পরিচালনা করতে পারছেন, দ্রুত ও নির্ভরযোগ্য উৎস থেকে উপকরণ পাচ্ছেন। ফলে কৃষকের কাছেও সময়মতো মানসম্মত উপকরণ পৌঁছাচ্ছে, আর পুরো কৃষি সরবরাহ শৃঙ্খল হচ্ছে আরও কার্যকর ও স্বচ্ছ।

তবে চ্যালেঞ্জও আছে। পণ্যের মাননিয়ন্ত্রণ, বিক্রেতা প্রশিক্ষণ এবং প্রত্যন্ত এলাকায় সময়মতো সরবরাহ—এসবই এখনো কৃশপের ভবিষ্যতের বড় পরীক্ষা।

বাংলাদেশ বহুদিন ধরেই কৃষিকে আধুনিকায়নের চেষ্টা করছে। জলবায়ু পরিবর্তনে কৃষি মৌসুম অস্থির হয়ে ওঠায় নির্ভরযোগ্য কৃষি উপকরণ, বিশেষ করে মৌসুমসহিষ্ণু বীজ ও নতুন প্রযুক্তি এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। এই প্রেক্ষাপটে কৃশপ বিক্রেতা ও কৃষকের মধ্যে তৈরি করছে এক নতুন সংযোগ। বিক্রেতারা পাচ্ছেন প্রযুক্তিনির্ভর ব্যবসার নিশ্চয়তা, আর কৃষকরা পাচ্ছেন আসল উপকরণ, ন্যায্য দাম ও সময়মতো সরবরাহ।

বগুড়ার মোহাম্মদ ফরহাদ হোসেন বা রাজশাহীর রাজ্জাকদের কাছে কৃ-শপ এখন শুধু একটি অ্যাপ নয়, বরং অনিশ্চয়তা কমানোর এক নির্ভরযোগ্য উপায়। ধীরে ধীরে এই পরিবর্তন বদলে দিচ্ছে মাঠঘাটের বাস্তবতা ও গ্রামীণ অর্থনীতির ধারা।

এভাবেই প্রযুক্তির ছোঁয়ায় বদলে যাচ্ছে কৃষির চিত্র—গ্রামের দোকান থেকে ফসলের মাঠ পর্যন্ত গড়ে উঠছে এক নির্ভরযোগ্য সংযোগ।

/এসআইএন

মন্তব্য করুন

Logo