ঢাকা-বরিশাল নৌপথ: গলার কাঁটা ডুবে থাকা নৌযান

|

ঢাকা-বরিশাল নৌপথে গলার কাটা হয়ে দাঁড়িয়েছে ডুবে থাকা নৌযানগুলো। বিভিন্ন সময়ে নানা দুর্ঘটনায় নদীতে ডুবে যাচ্ছে যাত্রীবাহী লঞ্চ, ট্রলার ও পণ্যবাহী কার্গো। কিন্তু এসব নৌযান আর উত্তোলন করা হচ্ছে না। ফলে ক্রমশই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়েছে এ রুটে যাত্রীবাহী নৌযান চলাচল।

বিআইডব্লিউটিএ’র কয়েকটি উদ্ধারকারী জাহাজ রয়েছে। কিন্তু এসব জাহাজের ধারণক্ষমতা সর্বোচ্চ ২৫০ টন। আর ডুবে যাওয়া নৌযানগুলোর ওজন ১ হাজার থেকে ১২শ’ টন। ফলে এসব নৌযান নদীতে থেকেই যাচ্ছে। পরে বিআইডব্লিউটিএ নৌযান মালিকদের তা তুলে নেয়ার চিঠি দিয়েই দায়িত্ব শেষ করে। সক্ষমতার ঘাটতি ও ব্যয় বিবেচনায় মালিকরাও তা তুলে নেন না।

এরই মধ্যে কমতে শুরু করেছে নদীর পানি। তাই উদ্বেগ বাড়ছে। এ অবস্থায় এক মাসের মধ্যে নদী পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য মঙ্গলবার বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানকে অনুরোধ জানিয়েছে লঞ্চ মালিক সমিতি।

নাব্য সংকট, অদক্ষ চালক, লঞ্চে আধুনিক প্রযুক্তির অভাব, আবার প্রযুক্তি থাকলেও এর ব্যবহার না জানা, সংশ্লিষ্ট দফতরের মনিটরিং সংকটের কারণে নৌপথে দুর্ভোগের সীমা নেই। এসব নৌপথে অহরহ ঘটছে দুর্ঘটনা। ফলে ডুবছে বহু নৌযান। ছোট ছোট নৌযান উত্তোলন করা গেলেও অত্যাধুনিক শক্তিশালী উদ্ধারকারী জাহাজ না থাকার কারণে ভারি নৌযান তোলা যাচ্ছে না।

২৫ মে বালুবাহী বাল্কহেড এমভি সিয়াম মেঘনা নদীর মিয়ারচর এলাকায় নিমজ্জিত হলে তিন মাসেও তা উদ্ধার করা সম্ভব হয়নি। ৬ আগস্ট মেঘনা নদীর গজারিয়ায় সার বোঝাই এমভি টপশিপ কার্গো ও গোবিন্দপুর এলাকায় আরেক মালবাহী কার্গো নিমজ্জিত হয়।

মেঘনা নদীতে এ তিনটি কার্গো প্রায় কাছাকাছি স্থানে নিমজ্জিত হওয়ায় ঝুঁকি আরও বেড়েছে। বিশেষ করে মেঘনা নদীতে ডুবোচরের পাশাপাশি কার্গো নিমজ্জিত থাকায় নদীপথ সরু হয়ে গেছে। এর আগে হিজলার মুখে লালখারাবাদ বামনীর চর এলাকায় কার্গো এমভি টপশিপ ডুবে যায়।

একাধিক লঞ্চ মাস্টার জানান, মিয়ারচর চ্যানেলে বাল্কহেড ডুবির ঘটনার পর বড় লঞ্চগুলোকে মেহেন্দিগঞ্জের কালীগঞ্জ রুট হয়ে চলাচল করতে হচ্ছে। এতে যেমন সময় বেড়েছে, তেমনি বেড়েছে খরচও। কালীগঞ্জ রুটটি দীর্ঘদিন ব্যবহার না করায় চালকদের হিমশিম খেতে হয় উল্লেখ করে তারা বলেন, যেসব লঞ্চে পানি মাপার যন্ত্র (ইকোসাউন্ডার) নেই তারা বিপদে পড়ছেন। আবার কালীগঞ্জ স্থানটি মেঘনার ডেঞ্জার জোন এলাকায়। মিয়ারচর দিয়ে যেমন স্বাচ্ছন্দ্যে নৌযান চলাচল সম্ভব হতো কালীগঞ্জে ঠিক তার উল্টো।

বিআইডব্লিউটিএ’র উদ্ধারকারী জাহাজ হামজা ও রুস্তম অনেক আগেই যৌবন হারিয়েছে। ওই দুটি জাহাজের ক্রেনের উত্তোলন ক্ষমতা ৬০ টন করে। হামজা সংগ্রহ করা হয় ১৯৬৫ সালে, যা বর্তমানে আরিচা ফেরিঘাটে রয়েছে। রুস্তম সংগ্রহ করা হয় ১৯৮৪ সালে, যা বর্তমানে মাওয়া ফেরিঘাটে রয়েছে। দীর্ঘ ২৯ বছর পর ২০১৩ সালে কোরিয়া থেকে আমদানি করা হয় নির্ভীক ও প্রত্যয় নামে দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ।

এ দুটির উত্তোলন ক্ষমতা ২৫০ টন করে। প্রয়োজনের তুলনায় কম উত্তোলন ক্ষমতাসম্পন্ন হলেও নতুন দুটি উদ্ধারকারী জাহাজ আশার সঞ্চার করেছিল। তবে উদ্ধার অভিযানে এ দুটি জাহাজও হতাশ করেছে সংশ্লিষ্টদের। দুটি মিলে ৫০০ টন উদ্ধার ক্ষমতা হলেও বরিশালে অবস্থানরত নির্ভীক ও নারায়ণগঞ্জে অবস্থানরত প্রত্যয় পুরনো জলযান রুস্তম ও হামজার মতো একযোগে উদ্ধার অভিযান চালাতে পারে না। এছাড়া গভীর পানি ছাড়া চলতে পারে না নতুন এ দুটি ভারি জাহাজ।

বিআইডব্লিউটিএ’র সূত্র জানায়, রুস্তম ও হামজা সাত-আট ফুট পানিতে চলাচল করতে পারলেও নির্ভীক ও প্রত্যয় চলাচলের জন্য এর দ্বিগুণ গভীরতা প্রয়োজন হয়। তাছাড়া নিজে চলতে পারে না এ জাহাজ দুটি। কোথাও দুর্ঘটনা ঘটলে টাগ বা অন্য জাহাজের সাহায্যে টেনে নিয়ে যেতে হয়। এতে জ্বালানির প্রয়োজন হয় প্রতি ঘণ্টায় ৩০০ লিটারের। ভাটার সময় এর গতি আরও কমে যায়।

ফলে মেঘনা, লক্ষ্মীপুরসহ চাঁদপুরের আনাচে-কানাচে কিংবা বরগুনার বিষখালী, খাতাচেড়া কিংবা আগুনমুখা নদীতে দুর্ঘটনা ঘটলে বরিশাল ও নারায়ণগঞ্জ থেকে উদ্ধারকারী নৌযানগুলোর ঘটনাস্থলে পৌঁছতে দীর্ঘ সময় পার হয়ে যায়। দেশের বিশাল নৌপথ যখন নাব্য সংকটে রয়েছে তখন গভীর জলে চলাচল উপযোগী প্রত্যয় ও নির্ভীক দুর্ঘটনাস্থলে কীভাবে পৌঁছবে তা নিয়েও সংশয় রয়েছে। জোয়ার-ভাটার হিসাব মিলিয়ে ওই দুটি ইউনিট দুর্ঘটনাস্থলে পৌঁছলেও কাজ করতে পারে মাত্র একটি ইউনিট।

বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌচলাচল (যাত্রী পরিবহন) সংস্থার সিনিয়র সহ-সভাপতি বদিউজ্জামান বাদল বলেন, ‘সরকারের যে সব উদ্ধারকারী জাহাজ রয়েছে তা দিয়ে যে কোনো নৌযান উদ্ধার করা সম্ভব। ডুবে যাওয়া নৌযানটি যদি ১ হাজার টনও হয়, তারপরও তাকে তোলা সম্ভব। কারণ, ডুবে যাওয়া নৌযানটি আনলোড করে ওজন কমানো যায়। তাছাড়া পানির ওপরের স্তরের ওজন পানিতে থাকে না। ২৫০ টন ক্ষমতাসম্পন্ন দুইটি জাহাজ দিয়ে ওই নৌযান উত্তোলন করা সম্ভব।’

তিনি বলেন, ‘ডুবন্ত অবস্থায় বড় বড় নৌযান থাকলে যাত্রীবাহী নৌযানের ঝুঁকি কয়েকগুণ বেড়ে যায়। আমরা বিআইডব্লিউটিএ চেয়ারম্যানকে বলেছি, আগামী ১ মাসের মধ্যে নদী পরিষ্কার করে দেয়ার জন্য। কারণ নদীর পানি কমতে শুরু করেছে। ডুবন্ত নৌযানের মালিকরা যদি তাদের নৌযান উঠিয়ে না নেয়, তবে বিআইডব্লিউটিএ ওই নৌযান তুলে নিলামে বিক্রি করে দিতে পারে।

বিআইডব্লিউটিএ’র নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের উপ-পরিচালক আজমল হুদা সরকার মিঠু জানান, ‘নৌপথগুলো সচল রাখার জন্য আমরা সব সময় তৎপর। তাই এই পথে যদি কোনো নৌযান ডুবে থাকে তা সরানোর জন্য সংশ্লিষ্ট বিভাগ ও মালিকদের বলা হয়ে থাকে।

এ ব্যাপারে বরিশাল নৌসংরক্ষণ বিভাগের উপ-পরিচালক রফিকুল ইসলাম জানান, ‘নিমজ্জিত স্থান বয়া দিয়ে চিহ্নিত করা হয়েছে। যদিও ৬ বছরে বেশ কটি নৌযান নিমজ্জিত হলে এ নিয়ে সংশ্লিষ্ট দফতরের তদন্ত কমিটি গঠন ও পরবর্তীতে উদ্ধার অভিযান পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়।

এতে নিমজ্জিত নৌযানের অধিকাংশ পানির নিচেই ধ্বংস হয়ে যায়। তবে এটি সময়সাপেক্ষ।’ তিনি বলেন, ‘কোনো নৌযান ডুবে গেলে আমরা উদ্ধারের চেষ্টা করে থাকি। তবে এখন অধিকাংশ নৌযান ১ হাজার থেকে ১২শ’ টন ওজনের হয়ে থাকে। আর আমাদের উদ্ধারকারী জাহাজের ধারণক্ষমতা রয়েছে ২৫০ টন। এসব বিষয়ে নৌযান মালিকদের আমরা চিঠি দিই। তারা যেন ম্যানুয়ালি নৌযান উত্তোলন করে নেয়।

(সূত্র: যুগান্তর)


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply