টগবগিয়ে চলা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’ (দ্বিতীয় কিস্তি)

|

মুরশিদুজ্জামান হিমু

পশ্চিম বাংলার বেশিরভাগ মানুষ তখনও আধুনিক মিউজিক্যাল ইন্সট্রুমেন্ট যেমন গিটার, ভায়োলিন, কি-বোর্ড, এগুলোর সাথে তেমন পরিচিত না। কিন্তু মহীনের ঘোড়াগুলি যে এইগুলি নিয়েই এগিয়ে যেতে চায়। তাদের ধ্যানে গিটার, খাওয়ায় গিটার, ঘুমে গিটার; সব সময়ই গিটারের সুর আর কিছু কথার পিঠে কথা সাজাতেই ব্যস্ত তারা।

রিহার্সেল চলছে নিয়মিত। চলছে আড্ডাও। এরই ফাঁকে নিজেদের গানও তৈরি হয়ে গেছে কয়েকটা। সিদ্ধান্ত হল, তারা অ্যালবাম করবে। গৌতম দা (গৌতম চট্টপাধ্যায়) ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা গান আর রিহার্সেলের গতি আরও বাড়িয়ে দিল। কথা নিয়ে নাড়াচাড়া, সুর একটু এদিক-ওদিক। নাওয়া-খাওয়া সব বাদ। কারণ নতুন কিছু তো দিতে হবে শ্রোতাকে। না হলে কেন তারা মনে রাখবে মহীনের ঘোড়াগুলিকে?

১৯৭৭ সালে বের হল প্রথম অ্যালবাম। নাম, ‘সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক’। নাম শুনেই তো অনেকের চোখ কপালে। এটা আবার কেমন নাম? ‘সংবিগ্ন’ মানে ‘উদ্বিগ্নতা’? মানে কী এসবের? কেউ তাদের গান শুনলেন, কেউ শুনলেন না। না শোনার সংখ্যাই হল বেশি। যারাও শুনলেন, তাদের অনেকেই আবার আলোচনার চেয়ে সমালোচনাই করলেন বেশি।

কেউ বিদ্রুপ করে বললেন, ‘পেলভিস প্রিসলি’ (মূলত এলভিস প্রিসলি), কেউ আবার বললেন, গানের চেয়ে নাচোন-কোদনই বেশি, কেউ বললেন, গানের গলাই তো শোনা যায় না। কেউ আবার বললেন, ‘ইংরেজি’ যন্ত্র দিয়ে বাজিয়ে চালিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলবে না বেশি দিন। যাই হোক, কেউ কেউ মহীনের ঘোড়াগুলির প্রশংসাও করলেন। অনেকেই আগ্রহ ভরে শুনলেন, ‘ভেসে আসে কলকাতা’, ‘মেরুন সন্ধ্যালোক’, ‘হায় ভালবাসি’ আর ‘সংবিগ্ন পাখিকুল’ গানগুলো। বলে রাখা ভালো, প্রথম অ্যালবামে তাদের মোট চারটি গানই ছিল।


মহীনের ঘোড়াগুলি ব্যান্ডের সদস্যরা একটি সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘সংবিগ্ন পাখিকুল ও কলকাতা বিষয়ক’ বের হবার পর তো শুধু মুখে মুখে সমালোচনা হয়নি। পত্রিকায় সমালোচনা হয়েছে, টিভিতে কেউ কেউ কটু কথা বলেছেন। অনেক ক্ষুব্ধ শ্রোতা তো রীতিমতো চিঠি দিয়ে গালাগালি করেছেন। তাতে কি দমে যাবার পাত্র মহীনের ঘোড়াগুলি? না, অবশ্যই না। সব সমালোচনা, অর্থাৎ, পত্রিকার কাটিং, চিঠিপত্র কোলাজ করে হল দ্বিতীয় অ্যালবামের ব্যাককাভার। যাকে বলে একেবারে মোক্ষম জবাব।

বাজারে এল তাদের দ্বিতীয় অ্যালবাম। নাম ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু  বা ‘অ-উ-ব’। সেটা ১৯৭৮ সালের কথা। এটার ব্যাক কাভারের গল্প তো জানলাম। এবার বলি ‘কাভার’ বা প্রচ্ছদ কী দিয়ে হয়েছিল। অনেক ভাবনা-চিন্তার পর ঠিক করা হল, কিছু মনের কথা লেখা থাকবে প্রচ্ছদে। শ্রোতাদের উদ্দেশ্যে লেখা হল,

সাংসারিক আলাপ, খাতির, আপনার ডাংগুলি লাঞ্ছিত ছেলেবেলা
ড্রেনমগ্ন শব যার পিঠে সতেজ উদ্ভিদের মতো ফুটে রয়েছে অমোঘ
একটি ছুরি ও আকাশচারী কেরানীকুলের গানসহ আমরা আপনার
সাথে নিবিড় হবো ও অনন্ত একাকীত্ব থেকে আপনাকে উদ্ধার করে
আনবো’। ফলত আমরা নিজেরা বিয়াল্লিশ ফুট উঁচু ঝুলবারান্দা
থেকে নীচে কেৎরে পড়ে যাবো, চুরমার হয়ে যাবো এবং ঐ-ক্ষনাৎ
ভায়োলিন, বাঁশি, গীটার ও গুবগুবির ভাঙ্গা টুকরোগুলো কুড়িয়ে
নিতে নিতে আপনার হাত কেঁপে উঠবে, হাঁটু দুমড়ে যাবে’’

শুধু এ কথাগুলোই নয়, প্রচ্ছদে ছিল, ব্যান্ড সদস্যদের সবার আঙুলের ছাপও।

এমন ব্যতিক্রমী প্রচ্ছদ সে সময়ে মনে ধরেছিল অনেকের। খানিকটা পাগলাটে হলেও তো অন্যরকম বটেই। এমন দু-একজন করলে ক্ষতি কী? এটা ভেবেই হয়তো অনেকেই শোনা শুরু করল মহীনের ঘোড়াগুলিকে। বলে রাখি, ‘অজানা উড়ন্ত বস্তু’ ও ‘সুধীজন শোনো’ শিরোনামে মাত্র দুটি গান ছিল দ্বিতীয় অ্যালবামে। পরের বছরই, অর্থাৎ ১৯৭৯ সালে ‘দৃশ্যমান মহীনের ঘোড়াগুলি’ শিরোনামে বের হয় তৃতীয় ও শেষ অ্যালবাম। সে রেকর্ডেও ‘আয় সুরে বহুদূরে’ ও ‘চৈত্রের কাফন’ শিরোনামে ছিল মাত্র দুটি গান।

শুরুতে অনেক সমালোচনা হলেও ধীরে ধীরে গ্রহণযোগ্যতা পেতে শুরু করে মহীনের ঘোড়াগুলি। সমালোচকদের অনেকেরই বোধোদয় হয়। তারা বুঝতে পারেন, যে কথা আর সুর নিয়ে কাজ করেছেন গৌতম চট্টপাধ্যায় ও তার সঙ্গীরা, তা একদিনে হারিয়ে যাবার নয়। তা থাকবে বহু বছর, বহুকাল। কিন্তু আশির দশকের গোড়ার দিকে মাত্র ছয় বছরের মাথায় হঠাৎ ভেঙে যায় অনেক আশা নিয়ে শুরু করা এই ব্যান্ড। ভালবাসা আর বিপ্লব নিয়ে বাঁধা গানের পথচলার ঘটে প্রাথমিক সমাপ্তি। ব্যান্ড ভেঙে যাবার পর গৌতম চট্টপাধ্যায় ব্যস্ত হয়ে পড়েন সিনেমা নিয়ে। আর অন্যরা যে যার পেশায়।

(চলবে…)

প্রথম পর্ব: টগবগিয়ে চলা ‘মহীনের ঘোড়াগুলি’

যমুনা অনলাইন: এমএইচ/টিএফ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply