৭২ শতাংশ ট্রেন দুর্ঘটনাই মানুষের ভুলের কারণে : সমীক্ষা

|

স্বাধীনতার পর রেলপথের সংকেত ও রিলে ইন্টারলক ব্যবস্থা (ট্রেন যে লাইনে যাবে তা নির্ধারণ) ছিল এনালগ (হাতে পয়েন্ট তৈরি করতে হতো)। সময়ের বিবর্তনে প্রযুক্তির ৬ ধাপ উন্নয়নের পর এখন এ ব্যবস্থা সম্পূর্ণ ডিজিটাল (কম্পিউটারাইজড ও প্যানেল বোর্ড নিয়ন্ত্রিত)।

সেই সঙ্গে চালক-গার্ড-স্টেশন মাস্টার যোগাযোগ ব্যবস্থাতেও ছোঁয়া লেগেছে হালের প্রযুক্তির। এ আধুনিকায়নে কমে যাওয়ার কথা দুর্ঘটনা ও এর ভয়াবহতা।

কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার উল্টো। কেন? সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যত আধুনিক প্রযুক্তি এসেছে, যুক্ত ব্যক্তিদের ঢিলেমি ও গাফিলতি ততই বেড়েছে।

অথচ এদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নেয়া যায়নি। কারণ- লোকবল সংকট, ব্যবস্থা নিলে কাজ চলবে কীভাবে! ফলে নিরাপদ বাহন ট্রেন দিন দিন হয়ে উঠছে আতঙ্কের আরেক নাম।

ঢাকা-চট্টগ্রাম রেলপথের ব্রাহ্মণবাড়িয়ার কসবায় মন্দবাগ রেলস্টেশনে মঙ্গলবার ভোরে একটি ট্রেন (উদয়ন এক্সপ্রেস) যখন একটি লুপলাইনে যাচ্ছিল তখন আরেকটি ট্রেন (তূর্ণা নিশীথা এক্সপ্রেস) তাকে ধাক্কা মারে। এতে প্রাণ হারান ১৬ জন।

আহত অবস্থায় বিভিন্ন হাসপাতালে ভর্তি রয়েছেন ৪১ জন, যাদের অনেকেরই অবস্থা সংকটাপন্ন। সূত্র বলছে, সংকেত ব্যবস্থা আধুনিক হওয়ার পরও গত ১০ বছরে রেলপথে ৪ হাজার ৮৭০টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এতে প্রাণ গেছে ৪০৪ জনের। ১৩ দফা দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়েছে।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, মঙ্গলবার ভোরের ঘটনায় প্রাথমিকভাবে বলা হচ্ছে, তূর্ণা নিশীথার চালক সিগন্যাল না মেনেই ট্রেনটি চালাচ্ছিলেন। দুর্ঘটনার পরপরই ট্রেনটির চালক, সহকারী চালক ও স্টেশন মাস্টার পালিয়ে যান। সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে চালক ও সহকারীকে। তদন্ত কমিটি করা হয়েছে ৫টি।

সূত্রমতে, ছোট বা বড় দুর্ঘটনা ঘটলেই তদন্ত কমিটি হয়, তদন্ত প্রতিবেদনও জমা পড়ে। দোষী শনাক্ত হয়, শাস্তির সুপারিশ করা হয়। কিন্তু দোষী রেলকর্মীর লঘু শাস্তি দেয়ার মধ্য দিয়ে শেষ হয়ে যায় সবকিছু। প্রতিবেদনের সুপারিশের আলোকে কোনো কিছুই করা হয় না, সমাধান হয় না ত্রুটি-বিচ্যুতির।

রেলওয়ের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালক মঙ্গলবার জানান, এক অভ্যন্তরীণ সমীক্ষায় উঠে এসেছে, প্রায় ৭২ শতাংশ দুর্ঘটনাই যান্ত্রিক নয়, মানুষের ভুলের কারণে হয়েছে। ২৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে কারিগরি ত্রুটির কারণে।

রেলে মানুষের ভুল (হিউম্যান এরর) বলতে চালকের অসতর্কতা, সিগন্যাল অমান্য করা, স্টেশন মাস্টারের দেয়া ভুল সিগন্যালকে বোঝায়। কারিগরি ত্রুটির মধ্যে রয়েছে রেললাইনে সমস্যা, ইঞ্জিন বিকল, সিগন্যাল কাজ না করা ইত্যাদি।

রেলপথ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, স্বাধীনতার পরপর পুরো রেলপথের সংকেত ও রিলে ইন্টারলক ব্যবস্থা ছিল এনালগ (সম্পূর্ণ হাতে নিয়ন্ত্রিত)। ১৯৯০ সালের দিকে মেকানিক্যাল (যান্ত্রিক) পয়েন্ট সেট করা শুরু হয়। ১৯৯৯ সালের দিকে ইলেকট্রিক মেকানিক্যাল (বৈদ্যুতিক তারযুক্ত সুইচ) সংযুক্ত করা হয়।

২০০৫ সালের দিকে পুরো রেলপথে অত্যাধুনিক ডিজিটাল কালার লাইট সিগন্যাল ব্যবস্থা স্থাপন করা হয়। ২০১০ সালের পর পুরো রেলপথ আরও অত্যাধুনিক করে সিবিআই (কম্পিউটার-বেজড ইন্টারলকিং) সিস্টেমে উন্নীত করা হয়।

আধুনিক এ পদ্ধতি স্থাপনের আগে দুই ট্রেনে মুখোমুখি সংঘর্ষের ঘটনা কম ছিল। অত্যাধুনিক ব্যবস্থায় বর্তমানে কোন ট্রেন কোন লাইনে যাচ্ছে, কোথায় আছে- তা দেখা যায় ডিজিটাল ডিসপ্লে বোর্ডে।

আর রিলে ইন্টারলক করা হয় প্যানেল বোর্ডে সুইচ চেপে। ইন্টারলক হওয়ার পরই স্বয়ংক্রিয়ভাবে লাইনে সংকেত (লাল বা সবুজ) দেখায়। এত আধুনিক ব্যবস্থার পরও দুর্ঘটনা তাই উদ্বেগের।

২০১০ সালের ৮ ডিসেম্বর নরসিংদীতে দুটি ট্রেনের মুখোমুখি সংঘর্ষে দুই ট্রেন চালকসহ ১২ জন নিহত হন। আহত হন দুই শতাধিক। চট্টগ্রামগামী আন্তঃনগর ‘মহানগর গোধূলী’ ও ঢাকাগামী মেইল ‘চট্টলা’র ওই সংঘর্ষে দুই ট্রেনের ইঞ্জিন ও ৮টি যাত্রীবাহী বগি দুমড়ে-মুচড়ে যায়।

আগের বছরের ২২ জুন আন্তঃনগর মহানগর এক্সপ্রেস কমলাপুর স্টেশনে ঢোকার সময় লোকাল ট্রেন ঈশাখাঁর সঙ্গে মুখোমুখি সংঘর্ষ হয়। দুই ঘটনায় গঠিত তদন্ত কমিটি দুর্ঘটনার জন্য দু’জন স্টেশন মাস্টারের দায়িত্বে অবহেলাকে দায়ী করে। কিন্তু তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়া যায়নি।

রেলওয়ে যান্ত্রিক বিভাগ সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের ভাষ্য, স্টেশন মাস্টার-ট্রেনচালকের বিন্দুমাত্র ভুল কিংবা দায়িত্বে উনিশ থেকে বিশ হলেই বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটছে।

টিকিট কাউন্টারের ভেতরেই কম্পিউটারাইজড ব্যবস্থা থাকা এবং বিভিন্ন ট্রেনের ইঞ্জিনে অর্থের বিনিময়ে যাত্রী উঠানোর কারণে চালক ও স্টেশন মাস্টারদের মনোযোগ নষ্ট নয়। দুর্ঘটনার এটি অন্যতম কারণ।

মন্ত্রণালয় সূত্র জানায়, এ মুহূর্তে মাঠপর্যায়ে ১২ হাজার ৬০৮ কর্মকর্তা-কর্মচারীর পদ শূন্য রয়েছে। ২৫ শতাংশ ট্রেনচালক ও গার্ড চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ পাওয়া।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক কর্মকর্তা বলেন, চুক্তিভিত্তিক যারা চাকরি করছে, তাদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া যাবে না-এমনটা চুক্তিপত্রেই লেখা রয়েছে। নিয়োগের প্রায় ১০ বছর পর একজন চালক বা গার্ড গাড়ি চালানোর অনুমতি পায়।

এর আগে দুই বছর তাকে শিক্ষানবিস হিসেবে শুধু কার্যক্রম দেখতে হয়। অর্থাৎ ২০১৯ সালে নিয়োগ হলে ১০ বছর পর ২০২৯ সালে একজন সহকারী ট্রেনচালক কাজ করতে পারে। ফলে অবসরে যাওয়া চালক-গার্ডে নির্ভর করতে হচ্ছে রেলকে।

রেলওয়ের এক অতিরিক্ত মহাপরিচালক জানান, সাড়ে ১০ বছরে প্রায় ৫ হাজার দুর্ঘটনার বিপরীতে প্রায় ৮ হাজার তদন্ত কমিটি গঠিত হয়েছে। ছোট ও মাঝারি ধরনের দুর্ঘটনায় দুটি করে, বড় দুর্ঘটনায় ৩ থেকে ৫টি করে কমিটি হয়।

এসব কমিটির রিপোর্টের সুপারিশ বাস্তবায়ন সম্ভব হয়নি। তার মূল কারণ লোকবলের অভাবে দায়ী ব্যক্তিদের আবারও কাজে নিয়োগ দিতে হয়। ট্রেনচালক ও গার্ড অ্যাসোসিয়েশন সূত্র জানায়, একজন ট্রেনচালক একটি ট্রেন চালানোর আগে আট থেকে ১২ ঘণ্টার বিশ্রামের নিয়ম আছে।

কিন্তু চালক-সংকটের কারণে প্রয়োজনীয় বিশ্রাম ছাড়াই আবার ট্রেন চালানো শুরু করতে হয়। ফলে মনোযোগ ধরে রাখা বেশ কঠিন হয়ে পড়ে। ট্রেন চালানো অবস্থায় তারা প্রায়ই ঘুমিয়ে পড়েন।

সূত্র: যুগান্তর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply