প্রভাবশালীর বাড়ির সামনে ঝুপড়ি, তাই উচ্ছেদ ভিক্ষুকের ঘর

|

ফরিদপুর প্রতিনিধি:

প্রভাবশালী এক ব্যবসায়ীর বাড়ির সামনে এক ঝুপড়ি ঘর। বাড়ির সৌন্দর্য নষ্ট আর ওই ব্যবসায়ীর ফুলের বাগান করার শখের কারণে উচ্ছেদ করা হলো প্রতিবন্ধী এক ভিক্ষুকের বসত ঘর।

এ ঘটনা ঘটে ফরিদপুর জেলার নগরকান্দা উপজেলার তালমা ইউনিয়নের শাকপালদিয়া গ্রামে। গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুমার নদের পাশে দীর্ঘ ৩২ বছর যাবত বসবাস করছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক মোজাহার সরদার(৬০)। তার পাশেই প্রভাবশালী ধনাঢ্য ব্যবসায়ী আশরাফ মুন্সীর দালান।

নদীর পাশে পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা, এই অজুহাতে গত বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার অভিযান চালিয়ে ওই ভিক্ষুকের ঘর ভেঙে দেয় উপজেলা প্রশাসন। অথচ ওই জমিতে দীর্ঘ ৩২ বছর যাবত বসবাস করে আসছেন ওই প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক।

এদিকে যাদের জায়গা, উচ্ছেদ এর বিষয়ে কিছুই জানে না সেই পানি উন্নয়ন বোর্ড। আর কোন ধরনের আগাম নোটিশ ছাড়াই এই উচ্ছেদ চালানো হয় বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীর।

উচ্ছেদের সময় ওই ভিক্ষুককে একই সাথে জমি কিনে দেয়ার প্রস্তাব দেয়া হয় ওই প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর পক্ষ থেকে। একই সাথে ওই ভিক্ষুকের পরিবারের বিরুদ্ধে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডেরও অভিযোগ তোলা হয়।

শারীরিক প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক মোজাহার সরদার জানান, আমাদের বাড়ীর সামনে ধনী প্রতিবেশী আশরাফ আলী মুন্সির বাড়ী। তিনি দীর্ঘদিন যাবত আমাদের এখান থেকে উচ্ছেদের ষড়যন্ত্র করছে। তার প্রভাবে পড়ে প্রশাসনের কর্তাব্যক্তিরা এই কাজ করেছে।

তিনি বলেন, আমরা মাননীয় সংসদ উপনেতা সৈয়দা সাজেদা চৌধুরীর কাছ থেকে চিঠি দিয়ে তার লিখিত অনুমতি নিয়ে বাপাউবো শাকপালদিয়া ১৩৮ নং মৌজার ১৬২৪ নং খতিয়ানের এস এ ৩৬৭২ ও ৩৬৬৭ দাগের মোট ৬ শতাংশ জমিতে বাড়ী ঘর নিয়ে রয়েছি। হঠাৎ করে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা থেকে এই ঘটনা ঘটালো তারা। এখন আমার স্ত্রী, দুই পুত্র, তাদের স্ত্রী, নাতি নাতনি নিয়ে কোথায় গিয়ে দাড়াবো। খোলা আকাশে কাল থেকে অবস্থান করছি সবাইকে নিয়ে।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন নদীর পাড়ে শত বাড়িঘর, প্রভাবশালী আশরাফ আলী মুন্সির কথায় তারা শুধু আমার উপর ঝুলুম করলো। অভিযোগ করেন, আশরাফ নিজেও তো পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা দখল করে আছে। এছাড়া আমাদের পাউবো ফরিদপুর গত ১৬ মার্চ ২০১৫ সালে অনুমতি প্রদান করে বসবাসের জন্য।

মোজাহারের ছেলে ফারুক বলেন, আমার বাবা একজন শারীরিক প্রতিবন্ধী ও ভিক্ষা করে। আমি ইলেকট্রিক মিস্ত্রির কাজ করি। এই দুই জনের উপার্জনের আমাদের পুরো পরিবার চলে। আমাদের বিরুদ্ধে নানা অপরাধ কর্মকাণ্ডের অভিযোগ দেয়া হচ্ছে। আমরা যদি সত্যিই এত অপরাধ করতাম তাহলে তো থানায় ২/১ টা মামলা থাকতো। আমাদের নামে তো কোন থানায় কোন অভিযোগ নাই।

তিনি আক্ষেপ করে বলেন, কত বাড়ি রয়েছে নদীর জমিতে কোন জমি তারা দেখলো না শুধু টার্গেট হলাম আমরা। তিনি এসময় কান্না জড়িত কণ্ঠে বলেন ৩২ বছর যাবত থাকি জমিতে, কত কষ্ট, কত স্মৃতি। বড়লোকের বাগান হবে তাই আমাদেরকে রাস্তায় নামিয়ে দেয়া হলো।

এসময় তিনি জানান, প্রতিবেশী বড়লোক আশরাফ সাহেব বাগান করবেন আমাদের থাকার জমিতে যে কারণে আমাদের ষড়যন্ত্র করে উঠিয়ে দিলো।

তার স্ত্রী সাকির বেগম বলেন, কুদ্দস মেম্বার আমাদের সরকার থেকে ঘরবাড়ি দিবে বলে কাগজে স্বাক্ষর নিয়েছে। পরে জানলাম আমাদেরকে উচ্ছেদ করতে এই স্বাক্ষর নিয়েছে।

জাকির নামে একজন জানান, এরা কোন মতে ভিক্ষা করে জীবিকা নির্বাহ করে। এদের মাথার উপরে থাকার ঘরটি জোর করে এই ঘর ভেঙ্গে দেয়া হলো। আমরা এর তীব্র প্রতিবাদ জানাই। সরকার যেন দ্রুত সময়ে এ ব্যাপারে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করে। এছাড়া এর পিছনে যারা থেকে এই কাজ করলো তাদের বিচার চাই।

ব্যবসায়ী আশরাফ আলী মুন্সির সাথে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথমে জানান, জায়গা উচ্ছেদ করেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড, তাদের জায়গা আমার এখানে কি করার আছে। পরে তিনি বলেন, মানবিক কারণে আমি তাদের জমি কিনে দেয়ার প্রস্তাব দিয়েছি। ওই ভিক্ষুককে উচ্ছেদে বিভিন্ন জায়গায় আবেদন জমা দেয়ার বিষয়ে প্রশ্ন করা হলে তিনি জানান, আমি দেই নাই, এলাকাবাসী তাদের উচ্ছেদে আবেদন দিয়েছিল।

পানি উন্নয়ন বোর্ড এর জায়গা তো আপনার দখলেও আছে এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাউবো যখন চাইবে তখনই আমি জায়গা ছেড়ে দিবো। প্রতিবন্ধীর ওই জায়গায় বাগান করার কথা জানতে চাইলে তিনি বলেন, বিষয়টি সঠিক নয়।

তালমা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান দেলোয়ারা বেগম জানান, আমি এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আমাকে তারা একবার বলতে পারতো। কোন রকম পূর্ব ঘোষনা ছাড়াই এমন কাজটি ইউনিয়নে করা হলো, ঘটনাটি দুঃখজনক।

এ ব্যাপারে নগরকান্দা উপজেলা নির্বাহী(ভারপ্রাপ্ত) মো. আহসান মাহমুদ রাসেল জানান, পানি উন্নয়ন বোর্ডের জায়গা, তাদের চাহিদা মোতাবেকই উপজেলা প্রশাসন জায়গাটি উচ্ছেদ করেছে। কোন গোষ্ঠীর চাপে নয় স্বাভাবিক নিয়মেই উচ্ছেদ করা হয়েছে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বাকীদেরও উচ্ছেদে নোটিশ দেয়া হয়েছে।

ফরিদপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী সুলতান মামমুদ বলেন, গত কালের উচ্ছেদের বিষয়টি তার জানা নেই বলে উল্লেখ করে বলেন, বিষয়টি মানবিক, পাউবোই তাকে সেখানে থাকার জন্য অনুমতি দিয়েছিল। ওই এলাকার আশরাফ নামে এক ব্যক্তি বোর্ডসহ বিভিন্ন কার্যালয়ে আবেদন দিলে আমাকে বিষয়টি তদন্তের জন্য বলা হয়। তখনও আমি তদন্ত করে প্রতিবন্ধী ভিক্ষুক এর বিষয়টি উল্লেখ করেছি। তারপরও কেন প্রশাসন হঠাৎ করে এই উচ্ছেদ চালালো তা আমি বলতে পারবো নাহ।

পাউবো সব সময় দখলদারদের কাছ থেকে নদী খাল দখল করতে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে। সারা দেশের ন্যায় ফরিদপুরের সব জায়গা এই অভিযান চালায় পাউবো। কিন্তু শাকপালদিয়ার উচ্ছেদের বিষয়ে ফরিদপুর পাউবো পূর্ব থেকে অবগত ছিল নাহ।

তিনি উল্লেখ করেন, পরবর্তীতে উচ্ছেদের সংবাদ পেয়ে আমি স্টাফ পাঠিয়েছি বিষয়টি দেখার জন্য।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply