বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আর্চারিতে স্বর্ণজয়

|

আরিফুল ইসলাম,চুয়াডাঙ্গা
রীতিমত বিস্ময়কর ঘটনা। যে বয়সে সহপাঠীদের সাথে খেলাধুলা ও বিদ্যালয়ে যাওয়ার কথা সে বয়সে বিয়ের আসরে বসতে বাধ্য হতে হয় তাকে। তবে বাল্যবিয়ের বলি হতে চায়নি ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া মেয়েটি। বিয়ের আসর থেকে পালিয়ে আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে যোগ দেয় তাবাসসুম ইতি। হয়তো আর্চারিতেই মুক্তির পথ দেখছিলেন চুয়াডাঙ্গার ইতি। আর তাইতো যোগ দেন উন্মুক্ত ট্রায়ালে। স্থানীয় এক কোচের সহযোগিতায় তীর-ধনুকের প্রথম পরীক্ষায় উতরেও যান তিনি। বদলে যায় তার জীবনের চিত্র। বর্তমানে সে বাংলাদেশের বিস্ময় বালিকা এসএ গেমসে আর্চারির স্বর্ণকন্যা।

নেপালের পোখরাতে চলা এসএ গেমসে আর্চারিতে দলীয়, মিশ্র ও ব্যক্তিগত ইভেন্টে তিনটি স্বর্ণ জয়ের খবরে দারুনভাবে খুঁশি ইতির পরিবার। দেশের জন্য বয়ে আনা মেয়ের এমন সাফল্যে দারুণভাবে উজ্জিবিত ইতির পরিবারসহ প্রতিবেশীরা। মেয়ের এমন সাফল্যে আবেগ আপ্লুত ইতির বাবা-মা। ভাবনাতীত এমন জয়ে বেশ খুশি তারা। মেয়ের উত্তরোত্তর সাফল্যে দেশবাসীর কাছে দোয়াও চেয়েছেন তারা।

তাবাসসুম ইতির বাবা ইবাদত আলী মেয়ের আকাশচুম্বি সাফল্যের প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে, কেঁদে ফেলেন। তিনি অশ্রুসিক্ত নয়নে বলেন, আজ নিজেকে খুব সু:খী মানুষ মনে হচ্ছে। অভাবের সংসার আমার। মেয়েকেটি ঠিকমত পড়াশুনার খরচও দিতে পারতাম না। কোন রকমে সংসার খরচের পাশাপাশি তার পড়াশুনা চালাতাম। ঠিকমত মেয়েটিকে ভালমন্দ খেতেও দিতে পারেনি। আর এ কারণে ৬ষ্ঠ শ্রেণিতে থাকা অবস্থায় তার বিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিলাম। কিন্তু মেয়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে বাল্য বিয়ের বিরুদ্ধে এক অভিনব প্রতিবাদ জানিয়ে আমাদের চোখ খুলে দিয়েছিল। বাল্য বিয়ের আয়োজন করার কারণে তিনি দু:খও প্রকাশ করেছেন। বলেছেন, আমারত মত কোন বাবা যেন তার সন্তানদের বাল্য বিবাহ না দেয়।

আর ইতির মা আলেয়া খাতুন আনন্দে বাকরুদ্ধ। দেশের জন্য মেয়ের স্বর্ণজয়ী হওয়ার খবরে তিনি এখন এক গর্বিত মা। তিনি মেয়ের জন্য শুধু দেশবাসীর নিকট দোয়া কামনা করেছেন।

চুয়াডাঙ্গা শহরের বেলগাছী মুসলিমপাড়া এলাকার দরিদ্র হোটেল শ্রমিকের মেয়ে তাবাসসুম ইতি। ছোট বেলা থেকেই খেলাধুলাতে ছিল তার দারুণ প্রতিভা। পরিবারের অস্বচ্ছলতার কারণে খেলাধুলাতে মত ছিল না বাবা মায়ের। তারপরও দমে যান যায়নি ইতি।

ষষ্ঠ শ্রেণিতে পড়া অবস্থায় পরিবারের চাপে বাল্যবিয়ের পিড়িতে বসতে হয় ইতিকে। তবে সেই বিয়ের পিড়ি থেকে পালিয়ে চুয়াডাঙ্গায় তখন চলা আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পে যোগ দেয়। হয়তো সেখানেই মুক্তির পথ দেখছিলেন ইতি। যোগ দেন উন্মুক্ত ট্রায়ালে। স্থানীয় এক কোচের সহযোগিতায় তীর-ধনুকের প্রথম পরীক্ষায় উতরেও যায় ইতি।

আর্চারীতে ‘নিশানাভেদটা’ সেদিন ভালো করেছিলেন বলে কোচের মাধ্যমেই ইতি চলে আসে জাতীয় পর্যায়ে। প্রতিভা বুঝতে পেরেই তাকে দলে নেন তীরন্দাজ সংসদ। সেখানেই তার আর্চারির পাঠ। সেখান থেকেই আজ তিনি দক্ষিণ এশিয়ার সেরা আর্চারদের একজন।
কে জানতো বিয়ের পিড়ি থেকে পালানো সেই ইতিই এসএ গেমসে বাংলাদেশের জন্য বয়ে আনবে গৌরবগাঁধা সাফল্য। ইতির এমন সাফল্যে চুয়াডাঙ্গাবাসী ভাসছে এক নতুন আনন্দে। ইতির স্কুল শিক্ষকসহ সহপাঠীদের মধ্যেও চলছে ইতি বন্দনা।

চুয়াডাঙ্গা ঝিনুক মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়ের ক্রীড়া শিক্ষক শামসুন্নাহার শিলা (ইতির স্কুল) বলেন, আমার ছাত্রীর এমন বিস্ময়কর স্বর্ণজয়ের খবরে আমরা দারুণ খুঁশি। সে এখন শুধু চুয়াডাঙ্গার নয় দেশের গর্ব। তার মত মেধাবী ছাত্রী আমার শিক্ষার্থী এটা ভাবতেও সুখনাভুতি হয়।

চুয়াডাঙ্গার মেয়ে ইতির স্বর্ণ শিখরে পৌছানোতে গর্বিত জেলার ক্রীড়া ব্যক্তিত্বরাও। চুয়াডাঙ্গা জেলা ক্রীড়া সংস্থার সাধরণ সম্পাদক নাঈম হাসান জোয়ার্দ্দার বলেন, ইতির এই সাফল্যের খবরে জেলার অন্যান্য নারী আর্চারীদের মনোবল আরও বৃদ্ধি পাবে। একই সাথে দেশের আর্চারীতেও নারীদের অংশগ্রহনও বাড়বে বলে মত তার।

বাংলাদেশ আর্চারী ফাউন্ডেশনের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ও চুয়াডাঙ্গা আর্চারীর প্রশিক্ষণ কোচ সোহেল আকরাম বলেন, আর্চারির প্রতিভা অন্বেষণ ক্যাম্পেই আমি ইতির ভিতরে লুকিয়ে থাকা প্রতিভা বুঝতে পেরেছিলাম। এজন্য তাকে একটু বেশিই কেয়ার করতাম। আমি নিশ্চিত ছিলাম এ মেয়ে একদিন আমাদের সকলের মুখ উজ্জল করবে। সেটা ও করিয়েও দেখিয়েছে।

চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়া সংগঠক মাহবুল ইসলাম সেলিম, বলেন, আর্চারীতে ইতির বিস্ময়কর স্বর্ণ পদকে চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়াঙ্গনে আর্চারীতে নতুন এক দিগন্ত উম্মেচিত হয়েছে। ইতির এই সাফল্য আগামীতে চুয়াডাঙ্গার ক্রীড়াঙ্গনে বড় ভূমিকা রাখবে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply