বুদ্ধিজীবী হত্যা: মঈনুদ্দীন-আশরাফের ফাঁসি ৬ বছরেও কার্যকর হয়নি

|

বুদ্ধিজীবী হত্যাকারী চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানের মৃত্যুদণ্ডের রায় গত ৬ বছরেও কার্যকর হয়নি। এই দুই ঘাতক বিদেশে অবস্থান করায় তাদের দণ্ড কার্যকর করা সম্ভব হয়নি।

এদিকে এতদিনেও দণ্ড কার্যকর না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন শহীদ বুদ্ধিজীবীদের সন্তান, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থা। তারা বলেছেন, চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি। পাশাপাশি আসামিদের ফিরিয়ে আনতে যে সেল গড়ে তোলা হয়েছে তা কার্যকর করতে হবে।

জানতে চাইলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক যুগান্তরকে বলেন, বুদ্ধিজীবী হত্যায় সরাসরি জড়িত ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড হয়েছে। পলাতক থাকায় রায় কার্যকর করা এখনও সম্ভব হয়নি। যুক্তরাজ্যে সাধারণ নির্বাচন থাকায় মঈনুদ্দীনকে ফিরিয়ে আনতে আমাদের কূটনৈতিক তৎপরতা কিছুটা ব্যাহত হয়। দণ্ডিত এই দু’জনকে ফিরিয়ে আনবে সরকার। এজন্য চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর অ্যাডভোকেট রানা দাশগুপ্ত বলেন, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দেয়া তদন্ত সংস্থার প্রতিবেদন অনুসারে পলাতক আশরাফুজ্জামান বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে, আর মঈনুদ্দীন যুক্তরাজ্যে অবস্থান করছেন। এই দুই আসামির সর্বোচ্চ সাজা হওয়ার পর এখন তাদের ফিরিয়ে আনার দায়িত্ব স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের। আশা করি, দ্রুত তাদের ফিরিয়ে এনে রায় কার্যকর করা হবে। তিনি বলেন, রায় বাস্তবায়ন না হলে বিচারের প্রতি মানুষের আস্থা কমে যাবে।

পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি তদারকি সেল গঠন করে। এই সেলের অন্যতম সদস্য তদন্ত সংস্থার সিনিয়র তদন্ত কর্মকর্তা সানাউল হক। তিনি বলেন, ‘এই সেল থেকে উদ্যোগ নেয়ার কথা বলা হয়েছে। এখনও পরিস্থিতি যা, তাতে খুব বেশি আশাবাদী হওয়া যাচ্ছে না।

তবে পলাতকদের ফিরিয়ে আনতে ট্রাইব্যুনালের নির্দেশে পুলিশ সদর দফতরের উদ্যোগে একটি কমিটি গঠন হয়। সেই কমিটির প্রধান একজন ডিআইজি। কমিটির মাঝে মধ্যে মিটিং হয়। কিন্তু কার্যকর পদক্ষেপ দেখা যাচ্ছে না।

শহীদ সাংবাদিক ও লেখক শহীদুল্লা কায়সারের মেয়ে অভিনেত্রী শমী কায়সার বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এ ধারা অব্যাহত রাখতে হবে। বুদ্ধিজীবী হত্যায় যারা জড়িত ছিলেন বিশেষ করে চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খানকে দেশে ফেরত এনে রায় বাস্তবায়ন করতে হবে। তবেই জাতি পরিপূর্ণ স্বস্তিবোধ করবে।

শহীদ ডা. ফজলে রাব্বীর মেয়ে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী নূসরাত বলেন, দেশকে বুদ্ধিজীবীশূন্য করে দিতে চেয়েছিল আশরাফুজ্জামান খান ও চৌধুরী মঈনুদ্দীন। তাদের দণ্ডাদেশ কার্যকর হবে না, এটা খুবই হতাশাজনক। তাদের ফিরিয়ে আনতে কূটনৈতিক তৎপরতা আরও সক্রিয় হওয়া জরুরি।

১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণের দু’দিন আগে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, লেখক, সাংবাদিকসহ বহু খ্যাতিমান বাঙালিকে বাসা থেকে তুলে নিয়ে হত্যা করা হয়। তাতে প্রত্যক্ষ সহযোগিতা করে রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যরা। বন্দি অবস্থায় বুদ্ধিজীবীদের বিভিন্ন বধ্যভূমিতে হত্যা করা হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর তাদের ক্ষত-বিক্ষত ও বিকৃত লাশ রায়েরবাজার এবং মিরপুর বধ্যভূমিতে পাওয়া যায়। অনেকের লাশ শনাক্তও করা যায়নি, পাওয়াও যায়নি বহু লাশ। ১৯৭১-এর ১৪ ডিসেম্বরের নির্মম হত্যাকাণ্ডের কথা স্মরণ করে প্রতি বছর ১৪ ডিসেম্বর বাংলাদেশে পালিত হয় শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস।

মুক্তিযুদ্ধের সময় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ৯ জন শিক্ষক, ৬ জন সাংবাদিক ও তিনজন চিকিৎসকসহ ১৮ বুদ্ধিজীবীকে অপহরণের পর হত্যাসহ ১১টি অভিযোগই মূলহোতা মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামানের বিরুদ্ধে প্রমাণিত হয়। সেই ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ডে জড়িত থাকার অভিযোগে দু’জনকে ২০১৩ সালের ৩ নভেম্বর মৃত্যুদণ্ড দেন আন্তির্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর আশরাফুজ্জামানের নাখালপাড়ার বাসা থেকে উদ্ধার করা তার ব্যক্তিগত দিনপুঞ্জিতে এই হত্যা পরিকল্পনা ও টার্গেট ব্যক্তিদের একটি তালিকা পাওয়া যায়। তার মাধ্যমে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ও নাট্যকার মুনীর চৌধুরী, অধ্যাপক মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, গিয়াসউদ্দিন আহমেদ, ড. সিরাজুল হক খান, ড. মো. মর্তুজা, ড. আবুল খায়ের, ড. ফয়জুল মহিউদ্দিন, অধ্যাপক রাশিদুল হাসান, অধ্যাপক আনোয়ার পাশা ও ড. সন্তোষ ভট্টাচার্য, সাংবাদিক সিরাজ উদ্দিন হোসেন, সৈয়দ নাজমুল হক, এএনএম গোলাম মুস্তাফা, নাজিম উদ্দিন আহমেদ, সেলিনা পারভীন, শহীদুল্লা কায়সার, চিকিৎসক মো. ফজলে রাব্বী ও আলিম চৌধুরীকে হত্যার অভিযোগ প্রমাণিত হয়।

রায়ে ট্রাইব্যুনাল বলেন, ‘একাত্তরে বুদ্ধিজীবী হত্যার সঙ্গে জড়িত সবাইকে খুঁজে বের করা সম্ভব নয়। তবে ওই হত্যার মূল খলনায়ক ছিলেন চৌধুরী মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান খান। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার পরিকল্পনার নেতৃত্ব দিয়েছেন তারা। এই নৃশংস অপরাধের জন্য তারা শুধু এবং শুধু ফাঁসির যোগ্য। তাদের মৃত্যুদণ্ড না হলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না।’

চৌধুরী মঈনুদ্দীনের বাড়ি ফেনীর দাগনভূঞা থানার চানপুর গ্রামে। তার বাবার নাম দেলোয়ার হোসাইন। একাত্তরে তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলার ছাত্র। দৈনিক পূর্বদেশের নিজস্ব প্রতিবেদক হিসেবেও তিনি কাজ করেছেন। পাকিস্তানি হানাদারদের সহযোগিতার জন্য গড়ে তোলা আলবদর বাহিনীতে তাকে ‘গুরুত্বপূর্ণ’ দায়িত্ব দেয়া হয়। যুদ্ধের শেষভাগে বাংলাদেশের বুদ্ধিজীবী হত্যার পরিকল্পনা বাস্তবায়নের নেতৃত্বে ছিলেন তিনি।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মঈনুদ্দীন পালিয়ে পাকিস্তান চলে যান। সেখান থেকে যান যুক্তরাজ্যে। এখন পর্যন্ত তিনি লন্ডনেই অবস্থান করছেন। একাত্তরে পাকিস্তানের অখণ্ডতার পক্ষে থাকার কথা নিজের ওয়েবসাইটে দেয়া বিবৃতিতে স্বীকার করেছেন তিনি।

আরেক খুনি আশরাফুজ্জামান খানের বাড়ি গোপালগঞ্জের মুকসুদপুরের চিলেরপাড় গ্রামে। বাবার নাম আজহার আলী খান। ১৯৬৭ সালে সিদ্ধেশ্বরী ডিগ্রি কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাসের পর আশরাফুজ্জামান ভর্তি হন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামী স্টাডিজ বিভাগে। ওই বিভাগ থেকেই ১৯৭০ সালে স্নাতক ডিগ্রি পান ইসলামী ছাত্র সংঘের কেন্দ্রীয় নেতা আশরাফুজ্জামান।

মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার চলাকালীন কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক বেসরকারি টেলিভিশন স্টেশন আলজাজিরাকে এক সাক্ষাৎকারে চৌধুরী মঈনুদ্দীন বলেছিলেন, তিনি আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে হাজির হবেন না। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেছেন, ‘বাংলাদেশের ট্রাইব্যুনাল একটি কৌতুক। তারা একটি সাজানো বিচার করছে।’

পলাতক এই দুই বদর নেতা বিচারের মুখোমুখি দাঁড়াননি। আত্মসমর্পণ না করায় তারা আপিলের সুযোগ হারালেও এখন পর্যন্ত তাদের ফিরিয়ে এনে দণ্ড কার্যকর করা যায়নি।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply