যেভাবে আজকের অবস্থানে আওয়ামী লীগ

|

১৯৪৯ সালের ২৩ জুন বিকালে ঢাকার কেএম দাস লেনের রোজ গার্ডেনে গঠিত হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ’। পরে সেই দলের নাম পরিবর্তন হয়ে হয় বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। প্রতিষ্ঠার প্রায় ২ যুগ পর ১৯৭১ সালে এ দলটির নেতৃত্বেই স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। আবার স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের প্রাক্কালে সেই দলটির নেতৃত্বই বিশ্বে মাথা উঁচু করে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ। সেই আওয়ামী লীগের ২১তম জাতীয় কাউন্সিল আজ।

জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’তে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী মুসলিম লীগ প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে লিখেছেন, ‘কোথাও হল বা জায়গা না পেয়ে শেষ পর্যন্ত হুমায়ুন সাহেবের রোজ গার্ডেনের বাড়িতে সম্মেলনের কাজ শুরু হয়েছিল।’ বঙ্গবন্ধু আরও লিখেছেন, “সকলেই একমত হয়ে নতুন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান গঠন করলেন, তার নাম দেয়া হল- ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ’।”

আওয়ামী লীগের উত্থান নিয়ে বই লিখেছেন লেখক ও রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহিউদ্দিন আহমদ। তিনি বলেছেন, ১৯৪৮ সালে পাকিস্তান হওয়ার পর ঢাকায় মুসলিম লীগের রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করতেন মাওলানা আকরাম খান ও খাজা নাজিমুদ্দিন। সোহরাওয়ার্দী-আবুল হাশেমের নেতৃত্বাধীন বঙ্গীয় প্রাদেশিক মুসলিম লীগের অনুসারী যে প্রগ্রেসিভ (উদারপন্থী) নেতারা ছিলেন, তারা সেখানে নিজেদের অবহেলিত মনে করছিলেন। তখন তারা মোঘলটুলির ১৫০ নম্বর বাড়িতে একটি কর্মী শিবির স্থাপন করেছিলেন। সেখানে তারা একটি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের কথা চিন্তা করছিলেন। কলকাতা থেকে এসে শেখ মুজিবুর রহমান তাদের সঙ্গে যুক্ত হন।

তখন টাঙ্গাইলে প্রিন্সিপাল ইব্রাহীম খাঁ পদত্যাগ করায় শূন্য হওয়া একটি উপনির্বাচনে দুই দফায় মুসলিম লীগ প্রার্থীকে হারিয়ে দিয়েছিলেন মওলানা ভাসানী ও শামসুল হক। কিন্তু তাদের দু’জনের নির্বাচনী ফলাফলই অবৈধ ঘোষণা করে নির্বাচন কমিশন। তখন তারাও এসে এ মুসলিম কর্মীদের সঙ্গে মিলে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের কথা ভাবতে শুরু করেন। তারা একটি সভা ডাকেন, যার প্রস্তুতি কমিটির সভাপতি ছিলেন মওলানা ভাসানী, সাধারণ সম্পাদক ছিলেন ইয়ার মোহাম্মদ খান। কিন্তু সেই সভা করার কোনো অডিটোরিয়াম পাওয়া যাচ্ছিল না। তখন কেএম দাস লেনের কাজী হুমায়ুন রশীদ তার মালিকানাধীন রোজ গার্ডেনে সভা করার আহ্বান জানান।

সেখানেই ২৩ জুন বিকালে আড়াইশ’-তিনশ’ লোকের উপস্থিতিতে নতুন একটি রাজনৈতিক দল গঠনের সিদ্ধান্ত হয়। মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী সভাপতি, টাঙ্গাইলের শামসুল হক সাধারণ সম্পাদক, শেখ মুজিবুর রহমানকে (কারাবন্দি) যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক করে গঠিত হয় আওয়ামী (মুসলিম) লীগের প্রথম কমিটি। শেরেবাংলা একে ফজলুল হকসহ তৎকালীন রাজনৈতিক নেতারা সেদিন রোজ গার্ডেনে উপস্থিত ছিলেন।

১৯৫৫ সালে দলটি ধর্মনিরপেক্ষতাকে আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করে। দলের নামকরণ হয় ‘পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ।’ মুক্তিযুদ্ধের পর পাকিস্তান শব্দটি বাদ গিয়ে দলটি ‘বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ’ নামে কার্যক্রম শুরু করে। এ আওয়ামী লীগের মাধ্যমে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৬৬ সালে বাংলার জনগণকে বাঙালি জাতীয়তাবাদের চেতনায় উদ্বুদ্ধ করে স্বাধিকার আদায়ের জন্য ঐতিহাসিক ৬ দফা ঘোষণা করেন। সেই ৬ দফা আন্দোলনের পথ বেয়েই ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, ’৭০-এর নির্বাচনে বাঙালির নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ ও ’৭১-এর মহান মুক্তিযুদ্ধে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম ও মুক্তিযুদ্ধের সফল নায়ক ছিলেন তৎকালীন আওয়ামী লীগ সভাপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান।

দীর্ঘ সংগ্রাম ও সাফল্যের ৭০ বছর পেরিয়ে চলতি বছরের ২৩ জুন ৭১-এ পা দিয়েছে উপমহাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই রাজনৈতিক দলটি। ৭০ বছরের পথপরিক্রমায় দেশের বৃহত্তম ও প্রাচীন রাজনৈতিক দলটিকে অনেক চড়াই-উতরাই পেরোতে হয়েছে। স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালের আগস্টে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর কিছুটা অস্তিত্ব সংকটে পড়ে আওয়ামী লীগ। দলের ভেতরেও ভাঙন শুরু হয়। এর মধ্যেই আবদুল মালেক উকিল-জোহরা তাজউদ্দীনের দৃঢ়তায় সংকট কাটিয়ে উঠতে শুরু করে দলটি।

১৯৮১ সালে দলের সভাপতি নির্বাচিত হওয়ার পর দেশে ফিরতে সক্ষম হন বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। এরপর এক দশক ধরে সারা দেশ ঘুরে দলকে সংগঠিত করেন তিনি। ১৯৯৬ সালে তার নেতৃত্বেই ২১ বছর পর সরকার গঠন করে আওয়ামী লীগ। ২০০৮ সালের নির্বাচনে জয়ী হয়ে আবার সরকার গঠন করে দলটি। ২০১৪ সালের নির্বাচনে পুনরায় বিজয়ী হয়। এরপর ২০১৮ সালের ৩১ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে টানা তৃতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগ।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply