করোনাভাইরাস বিষয়ে বিজ্ঞানীদের যত গবেষণা

|

বিশ্বময় করোনার প্রাদুর্ভাবের কারণে ভাইরাসটি নিয়ে দিনরাত গবেষণা করছেন বিজ্ঞানীরা। করোনাভাইরাসের উপস্থিতি অনেক আগে থেকে থাকলেও কোভিড-১৯ গোটা বিশ্বকে থমকে দিয়েছে।

চীনের উহান থেকে বিশ্বব্যাপী মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়া করোনাভাইরাসের পর্যন্ত আক্রান্ত হয়েছে ১৮ লাখ ৫৭ হাজার ৩৫৪ জন।

প্রাণ হারিয়েছে ১ লাখ ১৪ হাজার ৩৬৭ জন। তিন মাসেও প্রাণঘাতী এ ভাইরাস নিয়ন্ত্রণের লক্ষণ নেই। ইতিমধ্যে করোনায় বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারাবিশ্ব। গত ২৪ ঘণ্টায় ৫ হাজার ৪১৫ জনের মৃত্যু হয়েছে।

ব্রিটিশ গণমাধ্যম গার্ডিয়ানের প্রতিবেদনে বলা হয়, দীর্ঘদিন ধরেই বিভিন্ন করোনাভাইরাস মানুষের জন্য সমস্যা সৃষ্টি করেছে। একই গোত্রের সার্স ও মার্স ভাইরাসের সঙ্গে সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত হলেও তাদের প্রভাব মহামারি সৃষ্টিকারী কোভিড-১৯–এর তুলনায় অনেক কম ছিল।

মাত্র ৫ মাস আগেও এই ভাইরাসটি সম্পর্কে কোনো তথ্য বিজ্ঞানীদের কাছে না থাকলেও এখন এটি নিয়ে ব্যাপক গবেষণা চলছে। ভ্যাকসিন প্রকল্প বেড়েছে, ওষুধের পরীক্ষা চালু করা হয়েছে এবং নতুন নতুন শনাক্তকরণ প্রক্রিয়ার চেষ্টা চলছে।

করোনার উৎপত্তি

ফাঁস হয়ে যাওয়া নথিপত্রের বরাত দিয়ে রোববার এক প্রতিবেদনে ডেইলি মেইল জানিয়েছে, সার্স-কোভ-২ ভাইরাসটি বাদুড়ের উৎস থেকে উদ্ভূত। গত কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন স্তন্যপায়ী প্রাণীর ভাইরাস নিয়ে গবেষণা করছে উহান ইন্সটিটিউট অব ভাইরোলজি।

মার্কিন সরকারের অর্থায়নেই এই প্রকল্প চালিয়েছেন ল্যাবের বিজ্ঞানীরা।

বাদুড়সহ এসব ধরা হয় উহান থেকে কমপক্ষে ১০০০ মাইল দূরে ইউনান প্রদেশের পাহাড়ের গুহা থেকে। করোনাভাইরাসের যে জিনোম সিকোয়েন্সি তার সঙ্গে ইউনানের গুহা থেকে ধরা বাদুড়গুলোর মিল পাওয়া গেছে।

কিন্তু ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ার পর প্রথম দিকে এটা উহানের একটি পশুপাখির বাজার থেকে ছড়িয়েছিল বলে মনে করা হচ্ছিল।

সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক এডওয়ার্ড হোমস বলেন, বন্যপ্রাণীদের মধ্যে এমন ভাইরাস আছে যা মানুষকে সংক্রমিত করার ক্ষেত্রে নিজেদের মানিয়ে নিতে পারে। তিনি বলছেন,‘করোনাভাইরাসের সঙ্গে বাঁদুড়ের নিশ্চয়ই সম্পর্ক আছে, হয়তো প্যাঙ্গোলিনও সম্পর্কিত, তবে অন্য কোনো প্রাণীর জড়িত থাকারও জোর সম্ভাবনা আছে।’

গত সপ্তাহে আরেক প্রতিবেদনে ডেইলি মেইল জানায়, পশুপাখির বাজার নয়, উহান ইন্সটিটিউট থেকে দুর্ঘটনাক্রমে ভাইরাস অবমুক্ত হয়ে বিশ্বজুড়ে এই মহামারী সৃষ্টি করেছে।

আলজাজিরার মতে, এ ব্যাপারে একটি স্বীকারোক্তিমূলক বিবৃতিও দিয়েছেন ল্যাবের খ্যাতনামা নারী বিজ্ঞানী শি ঝেংলি। সামাজিক মাধ্যমে প্রকাশিত এক ভিডিওতে শি ঝেংলি বলেন, ‘করোনাভাইরাস তার ইন্সটিটিউট থেকে ছড়িয়ে থাকতে পারে।’

চীনের বিজ্ঞানীদের পাশাপাশি অন্যান্য দেশের বিজ্ঞানীরাও ল্যাব থেকে দুর্ঘটনাক্রমে করোনা ছড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা উড়িয়ে দেননি। ডেইলি মেইল বলেছে, যুক্তরাষ্ট্রের ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব হেলথের অর্থায়নে একটি প্রকল্পে বাদুড়ের ওপর বিজ্ঞানীরা ওই পরীক্ষা করছিলেন। সেখানকার গবেষণা রিপোর্ট প্রকাশিত হয় ২০১৭ সালের নভেম্বরে।

ওই গবেষণা রিপোর্টের শিরোনাম ‘ডিসকভারি অব এ রিচ জিন পুল অব ব্যাট সার্স-রিলেটেড করোনাভাইরাস প্রোভাইডস নিউ ইনসাইটস ইনটু দ্য অরিজিন অব সার্স করোনাভাইরাস’।

যেভাবে মানুষকে সংক্রমিত করে করোনাভাইরাস

যুক্তরাজ্যের নটিংহ্যাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইরোলজির অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, কোভিড-১৯ সংক্রমণ সাধারণত মৃদু হয়। এ কারণেই ভাইরাসটি দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। অনেক মানুষই সংক্রমণের বিষয়টি ধরতে পারে না। তাই তারা বাইরে যায় এবং ঘরের ভেতর অন্যদের সংক্রমণ ছড়ায়।

তিনি বলেন, শ্বাস নেয়ার সময় ভাইরাসবাহিত কণাগুলো শ্বাসতন্ত্রে ঢুকে যায় এবং গলা ও গলনালির কোষের আস্তরণের সংস্পর্শে আসে। এসব কোষের পৃষ্ঠে প্রচুর ‘এইস-২ রেসেপ্টর’ নামে বিশেষ সংকেত গ্রহণকারী অংশ থাকে। কোষের রেসেপ্টর মূলত রাসায়নিক পরিবহনের মূল ভূমিকা রাখে এবং কোষের মধ্যে সংকেত প্রবাহের কাজ করে।

কোভিড-১৯ ছড়িয়ে পড়ার প্রক্রিয়া জানাতে গিয়ে অধ্যাপক জোনাথন বল বলেন, ভাইরাসটিতে থাকা প্রোটিন ওই রেসেপ্টরে আটকে যায় এবং কোষের মধ্যে আরএনএ ঢুকে পড়ে। একবার কোষের ভেতর ঢুকে গেলে কোষের নিজস্ব প্রতিলিপি পদ্ধতিতে এটি নিজেকে যুক্ত করে নেয় এবং ভাইরাসের একাধিক প্রতিলিপি তৈরি করে। এটি কোষ থেকে ফেটে বেরিয়ে যায় এবং সংক্রমণ বিস্তার লাভ করে।

কোভিড-১৯ এত মৃত্যুর কারণ কী?

করোনাভাইরাস যখন শ্বাসনালি ছেড়ে নেমে যায় এবং ফুসফুসে সংক্রমিত হয় তখন আসল জটিলতা সৃষ্টি হয়। কারণ ফুসফুসে আরও বেশি ‘এইস-২ রেসেপ্টর’ থাকে। ফুসফুসের অনেক কোষ ধ্বংস হয়ে যায়। এতে ভাঙা কোষে ফুসফুস ভরে যেতে শুরু করে। এ ক্ষেত্রে রোগীকে নিবিড় পরিচর্যাকেন্দ্রে বা ইনটেনসিভ কেয়ার (আইসিইউ) নেয়ার প্রয়োজন পড়ে।

আরও খারাপ পরিস্থিতি সৃষ্টি হলে, ফুসফুসে প্রদাহ সৃষ্টি হয়। এ সময় অনেক প্রতিরোধী কোষ ভাইরাসকে আক্রমণের জন্য ছুটতে থাকে যাকে ‘সাইটোকিন স্ট্রম’ বলে। গ্রিক ভাষায় সাইটো অর্থ কোষ আর কিনো অর্থ নড়াচড়া করা। অনেক ক্ষেত্রে এ ঘটনাটি রোগীর মৃত্যুর কারণ হয়ে দাঁড়ায়।

শিশুদের ঝুঁকি কতটুকু?

প্রাণঘাতী এ ভাইরাসের আঁতুড়ঘর উহানের জিনইনতান হাসপাতালের রোগীদের নিয়ে বিশ্লেষণ করে বিশেষ কিছু তথ্য পেয়েছেন গবেষকরা।

ওই বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ভাইরাসে আক্রান্তদের মধ্যে অর্ধেকেরই বয়স ৪০ থেকে ৫৯ বছরের মধ্যে। ৩৯ বছরের কম বয়সী রোগী অনুপাত মাত্র ১০ শতাংশ। আর ১৮ বছরের নিচে শিশুদের মধ্যে ভাইরাসটির সংক্রমণের ঘটনা বিরল।

এমন পরিসংখ্যানে প্রশ্ন উঠেছে, ‘ভাইরাসটি শিশুর শরীরে সংক্রমিত হচ্ছে না কেন? এ নিয়ে বিজ্ঞানীরা অনেক ধরনের তত্ত্ব সামনে রাখলেও এ বিষয়ে স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের কাছে কোনো সুনির্দিষ্ট জবাব নেই।’

এ বিষয়ে ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক ইয়ান জোনস বিবিসিকে বলেন, ‘এমন প্রশ্নের সুস্পষ্ট জবাব এখনো দিতে পারছি না আমরা। এখন পর্যন্ত আমাদের বলতে হচ্ছে -হয় শিশুরা সংক্রমণ এড়িয়ে যাচ্ছে, নয়তো তারা মারাত্মক সংক্রমণের শিকার হচ্ছে না।’

তাই বলে করোনাভাইরামের সংক্রমণ থেকে শিশুরা মুক্ত সঠিক নয় বলেন জানান ইয়ান জোনস।

তিনি বলেন, ‘শিশুরা এ ভাইরাসে মৃদুভাবে আক্রান্ত হচ্ছে। এতে তাদের মধ্যে সেভাবে রোগের উপসর্গ দেখা যাচ্ছে না। তারা মারাও যাচ্ছে না। চিকিৎসকের কাছেও যেতে হচ্ছে না তাদের। আর গেলেও হাসপাতালে ভর্তি করার দরকার হয় না। ফলে পরিসংখ্যানে তাদের সংখ্যা স্থান পায়নি।’

অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি এবং ইম্পেরিয়াল কলেজ লন্ডনের স্ট্যাটিস্টিকাল এপিডেমিওলজির বিশেষজ্ঞ ক্রিসেল ডনেলি।

তিনি বলেন, ‘২০০৩ সালে চীনে সার্স ও ২০০৭ সালে হংকংয়ে মার্স ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময়েও একই ঘটনা দেখা গেছে।’

তিনি তথ্য দেন, ‘সার্স ভাইরাস প্রাদুর্ভাবের সময় ৮০০ মানুষ মারা গেলেও শিশুদের সংক্রমণের সংখ্যা উল্লেখযোগ্য হারে কম ছিল এবং মার্স এর সময় ১৩৫ জন শিশু আক্রান্ত হয়। কিন্তু সে প্রকোটে কোনো শিশু ও কিশোরের মারা যাওয়ারা খবর পাওয়া যায়নি।’

শিশুদের দেহে সার্স ও মার্সের মতো করোনাভাইরাসের ক্ষেত্রেও একই বিষয় লক্ষ্য করা যাচ্ছে বলে জানান ডনেলি।

ভয়ের কারণ নেই

প্রাণঘাতি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়া রোগীদের মধ্যে প্রতি চারজনে একজন সুস্থ হয়ে উঠছেন। ভাইরাসটিতে হাজার হাজার মানুষের মৃত্যু হলেও মোট মৃত্যুর হার মাত্র ১ শতাংশ বা আরও কম।

ওয়ার্ল্ডওমিটারসের তথ্য অনুযায়ী, করোনায় বিশ্বে গড় সুস্থতার হার ২২ দশমিক ৬২ শতাংশ। প্রাণঘাতী এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার পর প্রতি চারজনে একজন সুস্থ হয়েছেন।

এ পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত হয়েছে যুক্তরাষ্ট্রে। দেশটিতে সুস্থতার হার ৫.৭১ শতাংশ। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ আক্রান্ত হয়েছে স্পেনে। সেখানে সুস্থতার হার ৩৬.২৬ শতাংশ। যুক্তরাজ্যে এ হার সবচেয়ে কম- ০.৪৩ শতাংশ।

বলা হচ্ছে গুরুতর তীব্র শ্বাসযন্ত্রের সিন্ড্রোমের (এসএআরএস) রোগী ও ইবোলা রোগীর মৃত্যুহারের তুলনায় করোনায় মৃত্যুহার অনেক কম। এসএআরএসের রোগীর মৃত্যুর হার প্রায় ১১ শতাংশ আর ইবোলা ৯০ শতাংশ।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply