অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিলেন চিকিৎসক

|

রোগীর মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা

অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিলেন চিকিৎসক।

সরাসরি স্বাস্থ্যসেবা দেওয়া এক ডাক্তারের ফেসবুক স্ট্যাটাসে উঠে এসেছে এক রোগীর করুণ পরিণতি কথা। চিকিৎসকের এমন মর্মস্পর্শী স্ট্যাটাস যেন গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অসঙ্গতিগুলোকে তুলে ধরেছে। এই নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে।

স্ট্যাটাসে চিকিৎসক ডা. সাদিয়া আফরিন ত্রিনা জানান, গত রােববার সিজারের জন্য এক রোগী ভর্তি হন হাসপাতালটিতে। রোগীর বয়স ৩৭ এবং এটিই তার প্রথম বেবি। তাই গুরুত্ব একটু বেশিই। এদিকে রােগীর অনেক শারীরিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও অপারেশনের পর রোগী সুস্থ ছিলেন। বিকেল থেকে রোগীর শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন দেয়া হয়। এতেও রোগীর খুব একটা উন্নতি না হলে রেফার করা হয় অন্যত্র। আর রাতে ফিরে আসে তার নিথর দেহখানি। রোগীকে রিসিভ করা এবং তার ডেথ সার্টিফিকেট দেয়া হয় মাত্র ২১/২২ ঘণ্টার ব্যবধানে।

ডা. সাদিয়া আফরিন ত্রিনা লেখেন, একজন ডাক্তার হয়ে এই কাজটি করা কতটা কঠিন, সেটা আমরাই জানি। আমরাও মানুষ। আমাদেরও মন খারাপ হয়। কিন্তু চোখে পানি আসা যাবে না। কারণ, আমরা যে ডাক্তার!

অবহেলায় রোগীর মৃত্যুর মর্মস্পর্শী বর্ণনা দিয়ে লেখা ড. সাদিয়া আফরিন ত্রিনার ফেসবুক পোস্টটি পাঠকদের জন্য হুবহু তুলে ধরা হলো-

“আজ আমি আমার গত ২৪ ঘণ্টার অভিজ্ঞতা শেয়ার করব। আমাদের ঠাঁই কোথায় সেটা জানার জন্য!

গতকাল ২৬/৪/২০ সকাল ৭.৩০ এ আমি ২৪ ঘন্টার শিফট করার জন্য বাসা থেকে বের হই ওজিএসবি হাসপাতালের এম্বুল্যান্স এ করে। গত রােববার সকাল সাড়ে ৯টায় একজন রোগী ভর্তি হন পূর্ব নির্ধারিত তারিখে সিজার করার জন্য। রোগীর বয়স ৩৭ এবং এটি তার প্রথম বেবি হওয়ায় অনেক গুরুত্বপূর্ণ প্রেগ্ন্যাসি ছিল।

সকাল সাড়ে ১১টার পর তার অপারেশন হয়। মাতৃত্বকালীন অবস্থায় উনার ডায়বেটিক, হাঁপানি, এছাড়া জরায়ুতে ফাইব্রয়েডের সমস্যা আগে থেকেই ছিল। এছাড়া অপারেশনের পরও উনার ভাইটাইলস ভালো ছিল। বিকেলে লক্ষ্য করলাম ০২ স্যাট (অক্সিজেন স্যাচুরেশন) কমে যাচ্ছিল, ৯৪-৯৫%। তাই অক্সিজেন সাপোর্ট দিলাম। এছাড়া ইনহেলার, নেবুলাইজেশনও দিলাম। একটু উন্নতি হয় কিন্তু আবার কমে যায়। রাত ৮ টার দিকে দেখছি ৯১-৯২%। এবার দিচ্ছি হাই ফ্লো-অক্সিজেন। তাতেও উন্নতি নেই। এর মধ্যে কনসালট্যান্টকে জানালাম এই পরিস্থিতি। উনি বললেন ভয় পেওনা, ঠিক হয়ে যাবে।

কিন্তু আমি ভয় পাবার মানুষ নই। সোহরাওয়ার্দী আর ঢাকা মেডিকেল এর মত টারশিয়ারি লেভেলের হাসপাতালে ২০১৩ সাল থেকে কাজ করছি। খারাপ রোগীর চেহারা আমার একটু হলেও আন্দাজ আছে। ঢাকা মেডিকেলে আমি নিজে খারাপ রোগীর স্ট্রেচার টেনে রোগীকে ২য় তলা থেকে ৪র্থ তলায় আইসিইউতে শিফট করেছি। তাই আমি সচেতন ভাবে রোগীর পরিবারকে রেফার লাগতে পারে বলে একটু আন্দাজও দিলাম। পোস্ট অপারেটিভে সিস্টারকে বললাম ল্যারিয়ানগোসকোপ (laryngoscope) এবং এন্ডোট্র্যাসিয়াল টিউব (endotracheal tube) যেন বের করে রাখে। একটা এক্সট্রা ইনহেলারও আনিয়ে রাখলাম। দুঃখজনক হলেও সত্য আমার কনসালট্যান্ট ফোনের ওপার থেকে আমাকে আশা দিতে চাইলেন রোগী ভাল হয়ে যাবে, এই বলে।

রাত পোনে ১০টায় ৮ লিটার অক্সিজেনসহ এখন ৮৮-৮৯%। আমি বুঝে গেলাম আমার তাকে রেফার করা লাগবে। আমি কনসালট্যান্টকে ইনসিস্ট করলাম যে রেফার লাগবেই বেশি দেরি হবার আগে। কারণ রেফারাল লেটার লিখা, অ্যাম্বুলেন্স ডাকা, রোগী শিফট, কোথায় যাবে ম্যানেজ করা এগুলোও সময়ের ব্যাপার।

পরে রাত ১টায় শিফট করলাম আহসানিয়ার আইসিইউতে। সেখানে ভর্তি করলেন। এরপর শুরু হল আসল কাহিনী।

আহসানিয়া থেকে কিছুক্ষণ পরে বললেন, শ্বাসকষ্টের রোগী উনারা রাখবেন না। কুর্মিটোলাতে নেন। এরপর গেলো কুর্মিটোলা। সেখানে অ্যাম্বুলেন্সেই স্ক্যান করে বললেন ইনি করােনা রােগী না। ঢাকা মেডিকেলে নিতে বলেন। ঢাকা মেডিকেলে বলল মুগদাতে নেন। উনি এখানে রাখার রোগী না। সাথে খুব দুর্ব্যবহার! মুগদা বলল এই রোগীতো গাইনী বিভাগের, আমাদের এখানে না। এর মাঝে ঢাকা মেডিকেলের ক্রিটিক্যাল কেয়ারে কাজ করা ফ্রেন্ডকে ফোন দিলাম। সাহায্য করার চেষ্টা করল।

তারপর অ্যাম্বুলেন্স ড্রাইভার বলল, আপা এখন কি করব?

আমি বললাম, বাদ আছে সোহরাওয়ার্দী, ওখানে যান। আমি আমার এক বড় ভাইকে ফোন দিলাম তিনি ওখানকার করােনা ইস্যু নিয়ে ডাইরেক্টলি কাজ করছেন। জিজ্ঞাসা করলাম, রোগীতো করোনা ডিটেকটেড না। ভর্তি কি নিবে না? ভাই বললেন, এখানেও হবে না। কারণ, নন-কোভিড; হাসপাতালে সাসপেক্টেড কেস নিবে না। তাহলে কি করা যায়? রোগীরতো সাপোর্ট লাগবে। বলল, পাঠিয়ে দেখ।

ড্রাইভার কে বললাম, সোহরাওয়ার্দীতে যেতে। রওনা দিল। এর মাঝে আমি রোগীর খোঁজ নিচ্ছি। আমার কাছে থাকা অবস্থায় যাকে এক মুহূর্তের জন্য অক্সিজেন খুলতে দেয়নি, সে কিভাবে রাস্তায় রাস্তায় ঘুরছে! তার শ্বাসকষ্টটা আমাকে খুব অস্থির করছিল। অস্থিরতাটা বোঝাতে পারবো না। শুধু ভাবছিলাম, একটু সাপোর্ট লাগবে, তাহলেই বোধহয় বেঁচে যাবে!

সোহরাওয়ার্দীর গেটে রোগী অক্সিজেন নেয়া বন্ধ করল। ফেরত আসল আমার কাছেই। নিচে নেমে দাড়িয়ে আছি ডেথ ডিটেকশন এর সরঞ্জাম নিয়ে। স্টেথ, বিপি মেসিন, লাইট।
রোগী আমার শ্বাস নেয় না, হৃৎস্পন্দন নেই, পিউপিল ডাইলেটেড, ফিক্সড। অবশেষে সকাল ৬টায় তার মৃত্যু ঘোষণা করলাম।

একজন ডাক্তার হয়ে এই কাজটি করা কতটা কঠিন, সেটা আমরাই জানি। আমরাও মানুষ। আমাদেরও মন খারাপ হয়। কিন্তু চোখে পানি আসা যাবে না। কারণ, আমরা যে ডাক্তার!

আমার প্রশ্ন, কোভিড হাসপাতাল কোভিড-১৯ পজেটিভ ছাড়া নিবে না, নন-কোভিড হাসপাতালে সাসপেক্টেড কেস নিবে না, নন-কোভিড হাসপাতাল কোভিড নেগেটিভ ছাড়া নিবে না।

তাহলে রোগীরা যাবে কোথায়? এভাবেই কি হাসপাতালে হাসপাতালে ঘুরে অ্যাম্বুলেন্সে মারা যাবে?? বাস্তব চিত্র এটাই। এটাই হচ্ছে। কারণ কোন সঠিক দিক-নির্দেশনা নেই, নেই কোন জবাবদিহিতা।

রোগীকে রিসিভ করলাম আমি, ডেথ সার্টিফিকেটও দিলাম আমি। ব্যবধান ২১/২২ ঘণ্টা!

সঠিক দিক-নির্দেশনাটা কি কোন ভাবে পাওয়া সম্ভব? একজন ডাক্তার হয়ে বড় নিরুপায় লাগল আজ নিজেকে!”


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply