গাছ বাঁচানোর আন্দোলন দেশে দেশে

|

গাছ মানুষের বন্ধু, এ কথা কে না জানে। যেখানে গাছ নেই, সেখানে মানুষ বাঁচতে পারে না; এ অমোঘ সত্যটা মরুভূমির দিকে তাকালেই বোঝা যায়। ছায়া ঘেরা গ্রাম ছেড়ে নগর জীবনে বাস করলেও গাছের প্রয়োজন মানুষ ভুলে যায়নি। গাছ কাটার বিরুদ্ধে নানা সময় নানান দেশে হয়েছে প্রতিরোধ আন্দোলন। গাছ কাটা বিরোধী এসব উদ্যোগের কোনোটি ছিল সরাসরি মাঠে নেমে, আবার কোনোটি অনলাইনে, মানে মাঠের বাইরে। দুই ধরনের প্রতিরোধেই সাফল্যের নজির রয়েছে। আরো জানাচ্ছেন ফয়সাল হায়দার।

চিপকো আন্দোলনকে বলা হয়ে থাকে পরিবেশ রক্ষায় সবচেয়ে অভিনব ও অহিংস আন্দোলন। শুধু গাছ কিংবা বনভূমি রক্ষা নয়, এ আন্দোলন আদিবাসী ও প্রান্তিক মানুষদেরকে নিয়ে দেশটির সুশীল সমাজের ভাবনার জায়গায় প্রচণ্ড নাড়া দিয়েছিল। আর বিশ্ববাসী এ চিপকো আন্দোলনের সাফল্য থেকে পেয়েছিল পরিবেশ রক্ষার একটি অনন্য রোল মডেল।

পরিবেশ রক্ষায় অহিংস চিপকো আন্দোলন

চিপকো আন্দোলন গড়ে উঠেছিল সত্তরের দশকে প্রতিবেশি ভারতের উত্তর প্রদেশে। এলাহাবাদের করাত কল মালিকদের শত শত গাছ কাটার অনুমতি দিলেও বনের আদিবাসীদের বছরে জীবন ধারণের জন্য ১০টি গাছ কাটার অনুমতি দেয়নি বন বিভাগ। অথচ বনভূমির সবচেয়ে বড় রক্ষক ও অংশীদার তারাই। আদিবাসীদের ক্ষতিপূরণ দেয়ার আশ্বাস দিয়ে গাছ কাটার সুযোগ করে নেয় সরকার ও করাতকল কোম্পানি।


কিন্তু বাধ সাধে ‘মহিলা মঙ্গল দল’ ও তার প্রধান গওরা দেবী।
২৫ মার্চ ১৯৭৫ সালে করাতকলের লোকজন গাছ কাটতে এলে খবর পেয়ে ছুটে আসেন তিনি। তার সঙ্গে যোগ দেন আরও বেশ কিছু নারী। তারা গাছ কাটা ঠেকাতে জীবন বাজি রেখে গাছকে জড়িয়ে ধরেছিলেন। ‘জড়িয়ে ধরা’ বা ‘সেঁটে থাকা’-কে হিন্দিতে বলে চিপকো, আর এই শব্দ থেকে নাম হয়েছে চিপকো আন্দোলন।

তাদের নিরস্ত করতে না পেরে গালাগাল শুরু করে করাত কলের লোকজন, এমনকি গুলি করার হুমকিও দেয়। কিন্তু গওরা দেবীরা ছেড়ে দেননি, গাছটিকে জড়িয়ে ধরে সারা রাত জেগেছিলেন। পরের দিন আবারও করাতকলের লোকজন এলে গাছ কাটার খবর আশপাশের গ্রামগুলোতেও ছড়াতে শুরু করেছিল। দলে দলে লোকজন ছুটে আসে চিপকো আন্দোলনে যোগ দিতে। চার দিন পর করাতকলের লোকজন রণেভঙ্গ দিয়ে স্থান ত্যাগ করে। বিজয়ী হন বন ভূমিবাসী মানুষ, জয়ী হন গওরা দেবীরা।

‘মহিলা মঙ্গল দল’র প্রধান গওরা দেবী

এই আন্দোলনের সাফল্য ওখানেই সীমাবদ্ধ ছিল না, ছড়িয়ে পড়ে পুরো উত্তর প্রদেশে। মুখ্যমন্ত্রীর কানে খবর গেলে, তিনি বিষয়টি অনুসন্ধানের নির্দেশ দেন। তার ভিত্তিতে মুখ্য মন্ত্রী নেওয়া সিদ্ধান্ত গওরা দেবীদের পক্ষেই গিয়েছিল। তাদের এ বিজয় রথ রাজ্য ছাড়িয়ে কেন্দ্র অবধি পৌঁছেছিল। ১৯৮০ সালে তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী পুরো হিমালয় অঞ্চলকে সবুজের চাদরে ঢাকতে পনের বছরের জন্য সব ধরনের গাছ কাটা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন।

এতো গেল বন ভূমির সঙ্গে যাদের জীবন জড়িত, বনভূমির যাদের আত্মার আত্মীয়; তাদের সংগ্রাম ও সাফল্য গাথার কথা। শহরে যারা থাকেন তারা কি এমন করে বনভূমিকে ভালোবাসেন কিংবা বনভূমির জন্য ওভাবে জীবনকে গুলির মুখে দাঁড় করবেন। তা হয়তো নয়, কেননা নাগরিক জীবনে বন ভূমির সঙ্গে আত্মীক যোগাযোগের সুযোগ কোথায়? তবে হ্যাঁ, শহরের সত্য ও সুন্দর বোধ সম্পন্ন মানুষগুলো ঠিকই বোঝেন বন ভূমি বা গাছের গুরুত্ব। তাদের প্রতিবাদের উপায়টাও তাই শহুরে কায়দায়।

ফিলিপাইনে পরিবেশবাদীদের আপত্তি ও পিটিশনের ফলে গাছ কাটা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ

বিশ্বের বিভিন্ন দেশে গাছ কাটা ঠেকাতে দায়ের করা হয় পিটিশন। জাতে বেনিয়া হলেও ব্রিটিশরা নাগরিকরা ঠিকই গাছের মর্ম বুঝেন। গত বছরের মাঝামাঝি যুক্তরাজ্যের কার্লাইল শহরে সড়ক প্রশস্ত করতে গাছ কাটার উদ্যোগ নিয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। কিন্তু বাধ সাথে শহরের অধিবাসীরা। তারা পিটিশন দায়ের করে চেইঞ্জ ডট অর্গ-এ। তিন হাজার ৭৫৩ জনের সমর্থন নিয়ে দায়েরকৃত ওই পিটিশনের ফলে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল কর্তৃপক্ষ।

ফিলিপাইনে মহাসড়ক চওড়া করতে ২৮৪টি গাছ কাটার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছিল ২০১৬ সালে, কেটেও ফেলা হয়েছি ১০৫টি গাছ। কিন্তু পরিবেশবাদীদের প্রবল আপত্তি ও দায়েরকৃত পিটিশনের ফলে গাছ কাটা থেকে পিছু হটতে বাধ্য হয়েছিল সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, এবং জীবন রক্ষা পেয়েছিল বাকি গাছগুলোর।

এভাবেই গাছে ছবি একে প্রতিবাদ জানায় ফিলিপাইনের প্রতিবাদকারীরা

আবারও ভারতে ফিরে আসি। এবারের ঘটনা দেশটির দক্ষিণে অবস্থিত কর্ণাটক রাজ্যের বন্যপ্রাণী অভয়াশ্রম নিয়ে। এ অভয়াশ্রমের মধ্য দিয়ে চলে গেছে ভারতের ১৩ নম্বর জাতীয় মহাসড়কটি (সোলাপুর-ম্যাঙ্গালুরু)। এটিকে চওড়া করতে হবে, কাটতে হবে রাস্তার পাশে বনের গাছগুলো। বাধ সেধেছেন আবারও সেই সচেতন নাগরিকরা, অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চেঞ্জ ডট অর্গ-এ একটি পিটিশন দায়ের করেছে। এ পর্যন্ত চার হাজারের অধিক মানুষ এতে সমর্থন দিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় শেষ পর্যন্ত কী হয়?

সম্প্রতি বাংলাদেশের যশোর রোডে গাছকাটার প্রতিবাদে পিটিশন


গাছ কাটা রোধে এমন আরও অনেক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ লড়াই চলছে সারা বিশ্বে। আমাদের দেশে ভূমি নিয়ে আন্দোলনের বহু সমৃদ্ধ ইতিহাস থাকলেও গাছ বাঁচানো নিয়ে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলার মতো তেমন কোনো আন্দোলন এখনো দেখা যায়নি। কে জানে, মরতে বসা প্রাণ-প্রকৃতিকে দেখে হয়তো বোধ জাগতেও পারে, সেই বোধ যা চিপকো আন্দোলনের গওরা দেবীরা দেখিয়েছেন।

যমুনা অনলাইন: এফএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply