দুবাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন, আছে একাধিক বিলাসবহুল হোটেল; দেশে এসে সিআইডির জালে

|

এক সময় নুন আনতে পানতা ফুরাতো তাদের। চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি পৌরসভার হতদরিদ্র পরিবারটির এক ছেলেই কিনা হয়ে উঠলো দুবাই আন্ডারওয়ার্ল্ডের ডন। অবৈধ অর্থে পরিবারটি এখন এলাকার কুতুব। বিলাসবহুল বাড়ি। দামি গাড়ি। যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়ে ‘আঙ্গুল ফুলে কলাগাছ’! বলা হচ্ছে সিআইডির হাতে গ্রেফতার হওয়া দুবাইয়ে নারী পাচারকারী সিন্ডিকেটের গডফাদার আজম খানের পরিবারের কথা।

দেশে ছয়টি হত্যাসহ ১৫টি মামলা রয়েছে আজম খানের বিরুদ্ধে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, একসময় তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির ভয়ংকর সন্ত্রাসী ওসমান বাহিনীর সেকেন্ড-ইন-কমান্ড। যুক্ত হন শিবিরের রাজনীতির সাথেও। পরে জামায়াত হয়ে বিএনপিতে আনাগোনা করেন। এমপি প্রার্থী হওয়ারও চেষ্টা করেন।

ওসমান বাহিনীর প্রধান ওসমান আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে ‘বন্দুকযুদ্ধে’ মারা গেলে দুবাই পাড়ি জমান তিনি। সেখানে ভিড়ে যান অপরাধী সিন্ডিকেটের সাথে। দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে দেশ থেকে গত আট বছরে সহস্রাধিক কিশোরী-তরুণীকে তিনি দুবাই পাচার করেছেন বলে জানা গেছে। তাদের অনেককে বাধ্য করেছেন যৌনকর্মী হিসেবে ও ডান্স বারে কাজ করতে। সিন্ডিকেটের মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন একাধিক বিলাসবহুল হোটেল। এই বছরের শুরুর দিকে দুবাই কর্তৃপক্ষ তার বিষয়ে বাংলাদেশ দূতাবাসকে সতর্ক করে।

শনিবার রাতে রাজধানী থেকে দুই সহযোগীসহ আজম খানকে গ্রেফতার করেছে সিআইডি। তার সঙ্গে পাচার হওয়া বেশ কিছু অডিও-ভিডিও ক্লিপও সিআইডি পেয়েছে, যেগুলোর একটিতে এক তরুণী অনুনয়-বিনয় করে তাকে বলতে শোনা যায়, ‘ভাইয়া আমার নাম…। ভাইয়া বাড়িতে আমার মা খুব অসুস্থ। আমি ছাড়া মাকে দেখার আর কেউ নেই। আমার ভিসার মেয়াদ তিন মাস হয়েছে। আমার ভিসার মেয়াদ আর বাড়াবেন না। আমাকে দেশে ফিরতে দেন।’

রোববার দুপুরে মালিবাগের সিআইডি সদর দফতরে এক সংবাদ সম্মেলনে ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ সাংবাদিকদের জানান, আজম খানের দুবাইয়ে তিনটি ফোর স্টার ও একটি থ্রি স্টার হোটেল রয়েছে। দুবাইয়ে চাকরির কথা বলে দেশ থেকে গত আট বছরে সহস্রাধিক তরুণীকে তিনি দুবাই পাচার করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। দেশে ছয়টি হত্যাসহ ১৫টি মামলার আসামি তিনি।

ডিআইজি ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, হোটেলে কাজ দেওয়ার নাম করে দেশ থেকে ১৫-২০ বছরের মেয়েদের অর্থের লোভ দেখিয়ে দুবাই পাচার করা হতো। তাদের প্রথমে কিছুদিন কাজে রাখার পরই শুরু হতো নির্যাতন। নিয়ে যাওয়া হতো ডান্স বারে। পরে জোর করে দেহব্যবসায় নামানো হতো। অনেক মেয়ে দেশে ফেরত আসার জন্য পাচারকারীদের কাছে কাকুতি-মিনতি করে। সেই সব অডিও রেকর্ড পাওয়া গেছে। কিশোরীদের ট্রাভেল এজেন্সি ও দুটি এয়ারলাইনসের মাধ্যমে দুবাই নেওয়ার তথ্য পাওয়া গেছে।

ইমতিয়াজ আহমেদ আরো জানান, আজম খানের বিষয়ে এ বছরের প্রথম দিকে দুবাই সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ দূতাবাসকে জানানো হয়। দূতাবাস তার পাসপোর্ট বাতিল করে। পরে তিনি এক্সিট পাসের মাধ্যমে দেশে চলে এসে আত্মগোপনে চলে যান। খবর পাওয়ার পর সিআইডি তাকে গ্রেফতারের চেষ্টা চালায়। কিন্তু তিনি বারবার স্থান পরিবর্তন করছিলেন। নতুন পাসপোর্ট করে সীমান্ত দিয়ে অন্য দেশে চলে যাওয়ার চেষ্টা ছিল তার।

সিআইডির এ কর্মকর্তা জানান, তার সিন্ডিকেটের সবাইকে শনাক্ত করা হয়েছে। দুজনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। অন্যদেরও আইনের আওতায় আনা হবে।

জানা যায়, ১৯৯৬ সালে আজম খান দুবাই যায়। মাঝেমধ্যেই দেশে আসতেন তিনি। আজম খানের সহযোগী ডায়মন্ডসহ আরো অনেক দালাল পাচার করা তরুণীদের সংগ্রহ করে নাচের প্রশিক্ষণ দিত। এরপর তাদের মাসে ৫০ হাজার টাকা বেতনে চাকরি পাওয়ার কথা বলে দুবাই পাঠানো হতো। এ ক্ষেত্রে লোভে ফেলার জন্য ২০-৩০ হাজার টাকা অগ্রীমও দিত পাচারকারীরা। অগ্রিম টাকা দেওয়াসহ তাদের দুবাই যাওয়ার খরচওবহন করত পাচারকারীরা। কিন্তু দুবাইয়ের হোটেলে নেওয়ার পরই বদলে যায় দালালদের চেহারা।

জিজ্ঞাসাবাদে আজম খান আট বছর ধরে বাংলাদেশ থেকে নারী নিয়ে যাওয়ার কথা স্বীকার করেছেন। এ পর্যন্ত এক হাজারের বেশি তরুণীকে দেশ থেকে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে সিআইডি বাদী হয়ে গত ২ জুলাই রাজধানীর লালবাগ থানায় একটি মামলা দায়ের করেছে। মামলাটি সিআইডি তদন্ত করছে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply