সরেজমিন ভাষাণচর: প্রস্তুত নিরাপদ আশ্রয়ণ, রোহিঙ্গাদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা

|

প্রস্তুত ভাষাণচর

মোহসীন-উল হাকিম, বিশেষ প্রতিনিধি:

এক লাখ রোহিঙ্গার বসবাসের জন্য প্রস্তুত স্থায়ী দ্বীপ ভাষাণচর। এখন কেবল মিয়ানমার থেকে পালিয়ে আসা বাস্তুচ্যুতদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষা। সরেজমিন গিয়ে বঙ্গোপসাগরের বুকের এই চরের আমূল পরিবর্তন দেখা গেছে। সেখানে নির্মাণ করা হয়েছে আধুনিক, পরিবেশ সম্মত একটি আবাসন ব্যবস্থা। কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে গাদাগাদি করে থাকা রোহিঙ্গাদের জন্য ভাষাণচরে করা হয়েছে উন্নত জীবনযাপনের ব্যবস্থা।

কক্সবাজারের বিভিন্ন ক্যাম্পে প্রায় ১০ লক্ষ রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর বসবাস। সেখানে জীবনযাপনের মান নিশ্চিত করা রীতিমতো অসম্ভব। সে চিন্তা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিশেষ নির্দেশনায় ভাষাণচর মেগা প্রকল্প নেয়া হয়। ২০১৭ সালের ২৮ নভেম্বর একনেকে প্রকল্পটি পাশ হয়। প্রকল্প ব্যয় ধরা হয়েছিল প্রায় ২ হাজার ৩১২ কোটি টাকা। যেটি পরবর্তীতে সংশোধিত হয়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি।

এরপর, নৌবাহিনীর তত্ত্বাবধানে বেশ জোরেশোরেই শুরু হয় ভাষাণচর প্রকল্পের কাজ। ২ বছরেরও কম সময়ে ১২০টি ক্লাস্টার হাউজ তৈরি করা হয়েছে এই আবাসন প্রকল্পে। দুর্যোগ থেকে রক্ষার জন্য প্রতিটি ক্লাস্টারে রয়েছে একটি করে সাইক্লোন শেল্টার। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোর ঘর বাঁশ আর তারপলিনের তৈরি, ঘিঞ্জি, দুর্যোগ সহনীয় নয়। অন্যদিকে, ভাষাণচরের আবাসন পরিকল্পিত। আধুনিক ক্লাস্টার হাউজ। প্রত্যেকের জন্য প্রায় চার বর্গমিটার থাকার জায়গা।

ভাষাণচরের মোট আয়তন প্রায় ১৩ হাজার একর। দ্বীপটির উত্তর-দক্ষিণে প্রায় ৭.৫ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে ৬.৫ কিলোমিটার প্রসারিত। বর্তমানে ব্যবহার উপযোগী মোট জমি ৬ হাজার ৪২৭ একর । এরমধ্যে, প্রকল্প এলাকা প্রায় ১ হাজার ৭০২ একর, ক্লাস্টার এলাকা প্রায় ৪৩২ একর এবং অব্যবহৃত এলাকা ৯১৮ একর।

কৃষিকাজ করে জীবিকা নির্বাহ করা যাবে এই চরে।

ভাষাণচর নিয়ে যে সকল সংশয় ছিল তার মধ্যে অন্যতম হলো ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগে এই চর কতটা নিরাপদ থাকবে? সরেজমিন দেখা গেছে ভাষাণচরের চারপাশে তৈরী করা হয়েছে শক্তিশালী বাঁধ। আছে ম্যানগ্রোভ বন। গত ১৭৬ বছরের দুর্যোগের ওপর সমীক্ষা চালিয়েছে বিদেশি পরামর্শক এইচ আর ওয়ালিংফোর্ডের মতামতের ওপর ভিত্তি করে এই বাঁধ নির্মাণ করা হয়েছে। প্রকল্পটির আন্তর্জাতিক মান বিবেচনায় বড় আকারের জলোচ্ছ্বাস ও সাইক্লোন হতে দ্বীপের স্থাপনাসমূহ আরোও সুরক্ষিত রাখতে ৯ ফুট হতে ১৯ ফুট উচ্চতায় বাঁধ বর্ধিতকরণ প্রকল্প চলমান আছে।

ভাষাণচরের ঘরগুলোর পরিবেশবান্ধব রান্নাঘরে আছে বায়োগ্যাসের চুলা। রয়েছে নারী-পুরুষদের জন্য পৃথক শৌচাগার ও গোসলখানা। উখিয়া-টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে যেখানে ২০ জনের জন্য ১টি টয়লেট ও ৮০ জনের একটি গোসলখানা সেখানে ভাষাণচরে প্রতি ১১ জনের জন্য আছে একটি শৌচাগার। নারী পুরষের জন্য আলাদা ব্যবস্থা। গোসলখানাও আলাদা। প্রতি ১৬ জনের জন্য আছে একটি গোসলখানা।

ভাষাণচরের ঘরের ভেতরের চিত্র।

দেশি-বিদেশি বত্রিশটি ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান একযোগে কাজ করেছে এই ভাষাণচর প্রকল্পে। প্রকল্প পরিচালক কমোডর আব্দুল্লাহ আল মামুন চৌধুরীর নেতৃত্বে নৌবাহিনী বাস্তবায়ন করেছে এই মেগা প্রকল্প। প্রকল্পের প্রশাসনিক কর্তৃপক্ষ প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। তবে সার্বক্ষণিক প্রত্যক্ষ নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এই আবাসন তৈরিতে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে পরিবেশকে। সেজন্য প্রকল্প এলাকায় রাখা হয়েছে পর্যাপ্ত জলাধার। পরিবেশ সম্মত, আধুনিক ও টেকসই সরঞ্জামে তৈরি প্রতিটি ক্লাস্টার হাউজেও রয়েছে একটি করে জলাধার।

কক্সবাজারের ক্যাম্পগুলোর ঘরে ঘরে বিদ্যুতের ব্যবস্থা নেই। তবে ভাষাণচরে ২৪ ঘণ্টা বিদ্যুতের জন্য রয়েছে সৌরবিদ্যুৎ ও জেনারেটরের ব্যবস্থা। বায়োগ্যাসের মাধ্যমে থাকছে পরিবেশ বান্ধব পয়োনিষ্কাশন ব্যবস্থা। ভাষাণচর প্রকল্পে অভ্যন্তরীণ চলাচলের জন্য আছে ৪২ কিলোমিটার সড়ক। এখানকার ভূগর্ভস্থ পানি বিশুদ্ধ ও সুপেয়। কক্সবাজারের রোহিঙ্গা ক্যাম্পগুলোতে এসব সুবিধার কথা চিন্তাই করা যায় না। সেখানে সুপেয় পানির তীব্র সংকট। প্রচুর চাপের কারণে পানির লেভেল অনেক নিচে চলে গেছে।

জোরপূর্বক বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকদের মানবিক সেবা প্রদানকারী সংস্থা জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রতিনিধিদের জন্যও ভাষাণচরে রয়েছে আলাদা ভবন। শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার অফিস (আরআরআরসি) ও প্রশাসনের প্রতিনিধিদের জন্য আছে পৃথক ভবন। মানবিক সেবাদানকারী সংস্থার জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী পৃথক ভবন নির্মাণের পরিকল্পনাও রয়েছে ভাষাণচর আবাসন প্রকল্পে। এক লাখ মানুষের তিন মাসের খাবার মজুত রাখার জন্য এখানে নির্মাণ করা হয়েছে তিনটি সুরক্ষিত ওয়্যারহাউজ।

ভাষাণচরের আবাসন প্রকল্পে আছে মসজিদ, দুটি বিদ্যালয়। প্রতিটি সাইক্লোন শেল্টারের নিচের তলায় থাকছে শিশুদের জন্য অনানুষ্ঠানিক শিক্ষার ব্যবস্থা। সেখানে ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠান আয়োজনেরও সুযোগ থাকবে। চিকিৎসার জন্য আছে দুইটি বিশ শয্যার হাসপাতাল ও চারটি কমিউনিটি ক্লিনিক। বাস্তুচ্যুত মিয়ানমারের নাগরিকরা নিজ দেশে ফেরত গেলে এদেশের ভূমিহীনদের আশ্রয় হবে এই ভাষাণচরে। আরেকটি উল্লেখ করার মতো বিষয় হলো, ভাষাণচরে সকল অপারেটরের মোবাইল নেটওয়ার্ক আছে। থাকছে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইটের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক ইন্টারনেট ব্যবস্থাও।

প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ভাষাণচর একটি টেকসই বাসযোগ্য ভূমি। এখানে আশ্রয়প্রার্থীদের জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা আছে। উখিয়া টেকনাফের ক্যাম্পগুলোতে রোহিঙ্গাদের তেমন কোনো উৎপাদনশীল কাজ করার নেই। বেকার সময় কাটে। ভাষাণচরে তারা অলস বসে না থেকে জমি চাষ করে ফসল ফলাতে পারবেন, ফলজ বাগানে কাজ করতে পারবেন, মহিষ-গরু-ভেড়া কিংবা ছাগল লালনপালন করতে পারবেন। ভাষাণচরে রয়েছে পুকুর ও লেক। সেখানে মাছ চাষ করতে পারবেন আশ্রয়প্রার্থীরা। কুটির শিল্পে কারো আগ্রহ থাকলে সহযোগিতার আশ্বাস দেয়া হয়েছে সরকারের তরফ থেকে।

হাঁস-মুরগি পালন করার ব্যবস্থা আছে রোহিঙ্গাদের জন্য।

তিন হাজার কোটি টাকায় নির্মিত এই নগরীর সুরক্ষিত এলাকায় প্রয়োজনে আরও দুই লাখ মানুষের আবাসনের ব্যবস্থা করার সুযোগ আছে। সার্বিক নিরাপত্তার জন্য পুরো এলাকা সিসি ক্যামেরা দিয়ে পর্যবেক্ষণ করবে বাংলাদেশ নৌবাহিনী। এছাড়া, নিরাপত্তার নিশ্চিতে পুলিশ, কোস্টগার্ড ও জেলা প্রশাসন একযোগে কাজ করবে। মাদক ও মানবপাচারের হাত থেকে নিরাপদ থাকবে মিয়ানমার থেকে আসা নাগরিকরা।

নৌবাহিনীর চারটি এলসিইউ ও ৮টি জলযান ও দুটি হেলিপ্যাডের মাধ্যমে জরুরি প্রয়োজনে দিন রাত মানুষ স্থানান্তর করার ব্যবস্থাও আছে ভাষাণচর আশ্রয়ণ প্রকল্পে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, নানা ধরনের শঙ্কা ও বিভ্রান্তির কারণে তাদের মধ্যে ভাষাণচরে যাওয়ার আগ্রহ কম। সম্প্রতি রোহিঙ্গাদের একটি প্রতিনিধি দল ভাষাণচরে ঘুরতে গিয়ে ইতিবাচক বার্তা দিলেও কক্সবাজারে ফিরে তাদের উৎসাহে ভাটা পড়তে দেখা গেছে।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে রোহিঙ্গা নেতা মুহিবুল্লাহ যমুনা নিউজকে বলেন, বাংলাদেশের কোনো প্রস্তাবে আমরা না করবো না। সুরক্ষিত থাকতে পারলে নিশ্চয়ই যাবে রোহিঙ্গারা। তবে কিছু বিষয়ে ভীতি আছে। সাগরের মাঝের সেই দ্বীপ সত্যিই নিরাপদ কিনা; দুর্যোগ মোকাবেলার প্রস্তুতি আছে কিনা, এমন কিছু বিষয়ে পরিস্কার ধারণা পেলে অনেকেই যেতে রাজি হবে। এ বিষয়ে বিশদ আলোচনা হওয়া প্রয়োজন।

কক্সবাজারের অতিরিক্ত শরণার্থী ত্রাণ ও প্রত্যাবাসন কমিশনার (এআরআরআরসি) মোহাম্মদ সামছু-দ্দৌজা বলেছেন, ভাষাণচর প্রস্তুত। রোহিঙ্গাদের প্রতিনিধিরা সেটি পরিদর্শনও করেছেন। ৪০ জন মাঝিও পরিদর্শন করে এসেছেন ভাষাণচর। দেখে তারা ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন। সুরক্ষা থেকে শুরু করে সব দিক থেকে ভাষাণচর উপযুক্ত। সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত হলে আমরা তাদের স্থানান্তরের জন্য প্রস্তুত।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply