৫০০ দিন পেরিয়ে গেল, ছুটির ঘণ্টা বাজে না…

|

ছুটি ঘণ্টা না বাজার ৫০০ দিন পেরিয়ে গেল।

শাহরিয়ার নোবেল:

প্রতিদিন ভোর ছয়টায় ক্রিং ক্রিং করে ওঠা তুলির টেবিল ঘড়িটির ব্যাটারি এখন আর কেউ পাল্টায় না। ঘরের এক কোণায় নির্বাক পড়ে আছে ঘড়িটি। দীর্ঘদিন তুলির স্কুল বন্ধ; প্রয়োজন ফুরিয়েছে সকাল সকাল উঠে স্কুলে যাওয়ার। প্রতিদিনের সঙ্গী অ্যালার্ম ঘড়ির নাম উঠেছে বাতিলের খাতায়।

তুলির মতন এমন প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থীর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ৫০০ দিন পার হলো। এত লম্বা সময় ছুটির ঘণ্টা না বাজার ইতিহাসই যে নেই এই ভূমিতে। পাঠশালার ছুটি বরাবরই শিক্ষার্থীদের মনে আনন্দের পারদ চড়ালেও করোনার এই দীর্ঘ ছুটি তাদের কাছে বিষাদের, হতাশার।

বিশ্বব্যাপী তাণ্ডব চালানো প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের উপস্থিতি বাংলাদেশে প্রথম খুঁজে পাওয়া যায়, গত ২০২০ সালের ৮ মার্চ। এরপর ধীরে ধীরে সংক্রমণ বাড়তে থাকায় সামাজিক সংক্রমণ ঠেকাতে সে বছরের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ ঘোষণা করা হয় সরকারি-বেসরকারি সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।

শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা বলছেন, দীর্ঘ এই ছুটিতে পড়াশোনার ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকার অনলাইন ক্লাস বা অ্যাসাইনমেন্টের মতো বিষয়গুলো চালু করলেও নানা জটিলতায় এসব উদ্যোগের সুফল পাচ্ছে না শিক্ষার্থীরা। এ বছর উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেবে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় কলেজের শিক্ষার্থী খালিদ সাইফুল্লাহ। সে জানায়, কলেজ বন্ধ থাকায় তার যথাযথ প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। অনলাইনে যেসব ক্লাস হয় তার মাত্র ২০-৩০ শতাংশে সে অংশ নিতে পারে। ইন্টারনেট জটিলতায় বাকিগুলো ভেস্তে যায়।

করোনাকালের এই বন্ধে শিক্ষার্থী ঝরে পড়ার উদাহরণও কম নয়। কুড়িগ্রামের কালেক্টরেট স্কুল এন্ড কলেজের শিক্ষার্থী নওশীন প্রমি জানায়, আমার অনেক ছেলেবন্ধু পড়াশোনা থেকে দূরে সরে গেছে। করোনায় পরিবারের আর্থিক অবস্থা দুর্বল হয়ে পড়ায় কেউ বাবার সাথে দোকানে বসছে বা অন্য শহরে কাজ নিয়েছে। অনেক মেয়ে বন্ধুর বিয়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পরিবার।

শুধু অ্যাকাডেমিক ক্ষতিই যে হচ্ছে তা নয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় সহশিক্ষা কার্যক্রমে অংশ নিতে না পারায় শিক্ষার্থীদের যথাযথ বিকাশ হচ্ছে না বলে মনে করছেন অভিভাবকরা। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের অভিবাবক ফোরামের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল মজিদ সুজন বলেন, এই করোনাকালে সবকিছু অনলাইন হওয়ায় শিক্ষার্থীদের মোবাইল আসক্তি বাড়ছে। আমার চেনা বেশিরভাগ অভিভাবকই বলছেন, স্কুলে যেতে না পেরে অফুরন্ত এই সময় কাটাতে শিক্ষার্থীরা সারাদিন গেম খেলছে বা নানা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সময় কাটাচ্ছে।

১৭ মার্চ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণার পর থেকে আজ পর্যন্ত শিক্ষালয়ের বারান্দায় আর পা পড়েনি শিক্ষার্থীদের। এরই মাঝে সংক্রমণের রেখা গত বছরের আগস্ট থেকে জানুয়ারি পর্যন্ত কিছুটা নিম্নমুখী থাকায় শিক্ষার্থীরা নানাভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি জানালেও পরিস্থিতির কারণে তাদের সেই দাবিতে সায় দেয়নি সরকার। করোনা সংক্রমণের নিম্নগামিতা দেখে কয়েক দফায় শিক্ষামন্ত্রীর তরফ থেকে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার ঘোষণা আসলেও অল্পদিনের ব্যবধানে সংক্রমণ হারের বেরসিক উঠানামায় সেই ঘোষণা আর কার্যকর হয়ে ওঠেনি। বরং বৃহস্পতিবার ছুটি বাড়িয়ে আগামী ৩১ আগস্ট পর্যন্ত করার ঘোষণা এসেছে।

শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে আয়োজিত নানা কর্মসূচির সাথে যুক্ত থাকা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী আল মুজাহিদ ইমু যমুনা টেলিভিশনকে জানান, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান না খোলায় আমরা অনেক পিছিয়ে পড়েছি। দীর্ঘ জট তৈরি হয়েছে। চাকরি নিয়ে বা বিসিএস নিয়ে যেসব পরিকল্পনা ছিল সেগুলোও এখন অগোছালো হয়ে গেছে। অনেকেই হতাশায় মাদকাসক্ত হয়ে পড়েছে, আত্মহত্যার ঘটনাও ঘটছে।

সম্প্রতি বাংলাদেশ পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশান রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভলপমেন্ট (বিআইজিডি) কতৃক যৌথভাবে পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, দীর্ঘ এই বন্ধের ফলে শিক্ষার্থীরা পড়াশোনার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। তাদের গবেষণাটি বলছে, দেশে শিখতে না পারার ঝুঁকিতে আছে প্রাথমিক পর্যায়ের ১৯ শতাংশ ও মাধ্যমিক পর্যায়ের ২৫ শতাংশ শিক্ষার্থী রয়েছে। আর এই হার গ্রাম এলাকায় থাকা মাধ্যমিক শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে আরও বেশি।

শিক্ষাবিদরা বলছেন, দীর্ঘ বন্ধে শিক্ষাখাত অনেক পিছিয়ে গেছে। শিক্ষার এই ক্ষতির দাগ দগদগে থাকবে পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার পরও।

বরেণ্য শিক্ষাবিদ অধ্যাপক ড. মো. কায়কোবাদ যমুনা নিউজকে বলেন, করোনা সংক্রমণ ঠেকাতে সরকারের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার সিদ্ধান্ত যৌক্তিক। তবে, এই শিক্ষার্থীরা যে বাড়িতে থাকছে সেই সময়ে তারা কীভাবে পড়াশোনার মাঝে থাকবে তা নিয়ে পরিকল্পিত পদক্ষেপের ব্যাপক অভাব রয়েছে। সরকার তাদের নেওয়া অ্যাসাইনমেন্ট বা অনলাইন ক্লাসকে দূরশিক্ষণের ক্ষেত্রে ব্যপক কার্যকর বলছে। কিন্তু, এগুলো সত্যিই কার্যকর হচ্ছে কিনা তা তখনই ভালো বলা যাবে যখন দেশের শহর কিংবা প্রত্যন্ত গ্রামের শিক্ষার্থীদের নিয়ে একটি তৃতীয় পক্ষ দিয়ে প্রতিনিধিত্বশীল গবেষণা করে সবার প্রতিক্রিয়া জানা যাবে।

করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে কীভাবে শিক্ষার্থীদের এই ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হবে তার জন্য যথাযথ পরিকল্পনা, সমন্বিত প্রশিক্ষণ এবং শিক্ষাখাতের বাজেট নিয়ে সরকারের এখনই ভাবা জরুরি বলে মন্তব্য করেন এই বরেণ্য শিক্ষক।

মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদফতরের পরিচালক (কলেজ ও প্রশাসন) অধ্যাপক মো. শাহেদুল খবির চৌধুরী বলেন, আমাদের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতি বিবেচনায় একটি সামগ্রিক প্রভাব পড়েছে। তবে শিক্ষার্থীরা বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় যেন পড়াশোনার মাঝে থাকে সেজন্য শিক্ষাকে শিক্ষার্থীদের দোরগোরায় নিয়ে যেতে অনলাইন ক্লাস, টেলিভিশনে ক্লাস, অ্যাসাইনমেন্টসহ নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। প্রযুক্তির ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। পাবলিক পরীক্ষাগুলো যেন নেয়া যায় সেজন্যও কিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।

তার মতে, করোনা পরবর্তী সময়েও প্রযুক্তি ব্যবহার করে শিক্ষাদান ধীরে ধীরে স্থায়ী রূপ নেবে। শিক্ষার্থীরা পুরো পাঠ্যক্রম শেষ না করে পরবর্তী ধাপে চলে যাওয়ায় তাদের জ্ঞানের যে অপূর্ণতা তৈরি হচ্ছে সে ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পরিবর্তিত ও কার্যকর শিখন পদ্ধতি এবং কারিকুলামে পরিবর্তন আনার ব্যাপারে ভাবা হচ্ছে বলে জানান তিনি।

অটোপাস পাওয়া বা সংক্ষিপ্ত সিলেবাসে পরীক্ষা দিয়ে পাস করা শিক্ষার্থীরা যেন চাকরির বাজারে পিছিয়ে না পড়ে সেজন্য তাদের প্রাযুক্তিক এবং বাস্তবিক জ্ঞান বৃদ্ধিতে কর্মসূচি হাতে নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে বলেও জানান এই কর্মকর্তা।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply