‘পরাজয়কে ঘৃণা করার অভ্যাসটা আমি আর্জেন্টিনা থেকেই নিয়ে এসেছি’

|

লিও মেসির বেড়ে ওঠা। ছবি: লাইফ ব্লগার

আমার জন্ম রোজারিওতে, আর্জেন্টিনার সান্তা ফে প্রদেশের সবচেয়ে বড় শহর ওটা। শহরের দক্ষিণে ব্যারিও লা হেরাসে সুন্দর সাদামাটা একটা ঘরে থাকতাম আমরা। সেই বাড়িটা এখনও আছে। যদিও ছোটবেলায়ই সেখান থেকে চলে আসি আমি।

আমাকে যখন প্রথমবার ফুটবল দেয়া হয় তখন আমি খুবই ছোট, তিন কী চার বছর হবে। এটা ছিল একটা উপহার। আর সেই থেকে ক্রিসমাস, জন্মদিন বা অন্য যেকোনো উপলক্ষ্যেই আমি কেবল ওই একটি উপহারই চাইতাম, ফুটবল। প্রথম দিকে ফুটবল আমি বাইরে নিয়ে যেতে চাইতাম না। ভয় পেতাম, কেউ যদি সেটা নষ্ট করে ফেলে!

সেই সময় হয়তো একজন নারীই কেবল বিশ্বাস করতেন, তার ছেলে একদিন সর্বকালের সেরা ফুটবলারদের একজন হবে। ছবি: সংগৃহীত

বাড়ির চারপাশটা ছিল সবুজ। কিন্তু খেলার কোনো মাঠ ছিল না। একটা পরিত্যাক্ত সামরিক ঘাঁটি ছিল কাছেই, সেখানে বেড়ার মাঝখানে খেলতাম আমরা। কিন্তু আমাদের খেলা বেশি জমতো রাস্তায়। তখন রাস্তা ছিল কাঁচা, পুরোটাই মাটির। আমি খেলতাম প্রতিবেশীদের সাথে। ওরা যে খুব একটা ভালো ছিল তা না, তবে সবাই সবাইকে চিনতো। আমাকে নিয়ে তাই মা দুশ্চিন্তা করতেন না।

ডান পায়ের দিকে দেখুন, বাঁ পায়ের চেয়ে ছোট। ফুটবল খেলতে গিয়ে আহত হওয়া হয়তো চার বছর বয়স থেকেই শুরু মেসির।
ছবি: সংগৃহীত

পাঁচ বছর বয়সে খেলতে শুরু করি আমি। শুরুতেই বড়দের সাথে খেলার অনুমতি পাইনি আমি। ভাইয়ারা আমাকে খেলায় নিতে চাইতো না। ছোট ছিলাম সে জন্য নয়, বরং অন্য বড় ভাইয়েরা আমার কাছ থেকে বল কেড়ে নিতে পারতো না বলে রেগে গিয়ে লাথিও মেরে বসতে পারে সেই ভয়ে।

রাস্তায় খেলতে শুরু করার সময়েই এলাকায় আমাদের ছোট্ট ক্লাব, গ্রান্দোলিতে যোগ দেই আমি। আমাদের পুরো পরিবারই ক্লাবটির সাথে যুক্ত ছিল। সবাই কখনো না কখনো সেখানে খেলেছে। আমার বাবাও ছিলেন সেখানকার একজন কোচ। বাবা আর কাজিনদের সাথে আমি রোজারিওর দুই পেশাদার ক্লাব নিউয়েল আর ওল্ড বয়েজের খেলা দেখতে যেতাম।

মা-বাবার সাথে ফুটবল হাতে লিও মেসি। ছবি: সংগৃহীত

গ্রান্দোলিতে দেড় বছর খেলার পর নিউয়েলে অনুশীলন শুরু করি আমি। সেখানে দল ছিল সাতজনের। নিউয়েল বেশ বড় ক্লাব আর সেখানেই প্রথম বড় মাঠে ১১ জনের দলে খেলার সুযোগ মেলে আমার। আর লম্বায় ছোট ছিলাম বলে সেখানেই প্রথম ডাক্তারের কাছে যেতে হয় আমাকে। সমবয়সীদের তুলনায় আমি সব সময়ই ছিলাম খাটো। কিন্তু ফুটবল খেলতে নামলেই সব ভুলে যেতাম। আমার উচ্চতার কারণে খেলার শুরুতে সবাই তাকিয়ে থাকতো আমার দিকে। তখন কিছুটা অস্বস্তি যে হয়নি, তা নয়। কিন্তু কিক অফের পর তারাই তাকিয়ে দেখতো আমাকে, কীভাবে আমি খেলি। উচ্চতা নিয়ে সমস্যাও দূর হয়ে যায় তখন।

অবর্ধনশীল হরমোনের উপস্থিতির কারণে সমবয়সীদের চেয়ে খাটো ছিলেন মেসি। ছবি: সংগৃহীত

নিউয়েল আমাকে পাঠালো একটি ক্লিনিকে। সেখানে অনেকগুলো টেস্ট করার পর ডাক্তার জানালেন, আমার শরীরে অবর্ধনশীল হরমোন থাকায় আমি বেড়ে উঠছিলাম স্বাভাবিকের চেয়ে ধীরগতিতে। ডাক্তার আরও বললেন, চিকিৎসার দরকার আমার, যাতে স্বাভাবিক গতিতে বেড়ে উঠতে পারি আমি। আমার চিকিৎসা শুরু হলো, বয়স তখন ১২ কী ১৩। আর্জেন্টিনায় এক বছর সেই চিকিৎসা করিয়েছি আমি। সে খরচ দিয়েছেন বাবা। তারপর আসলাম ইউরোপে। বার্সেলোনা এসবের সবই জানতো আর শুরু করলো আমার চিকিৎসার খরচ বহন করা। তখনো আমি ১৩ বছরের এক ছেলে। প্রথমে বাবা সেখানে গিয়ে খোঁজখবর করে আসলেন। তারপর আমি গেলাম ট্রায়াল দিতে, ১৫ দিনের জন্য। ফিরেও এলাম আর্জেন্টিনায়। কয়েক মাস পর আমরা পুরো পরিবার চলে গেলাম বার্সেলোনায়। শুরু হলো ন্যু ক্যাম্পে আমার জীবন।

অন্যদের চেয়ে এতোটাই খাটো ছিলেন মেসি যে তাকে খুঁজে পাওয়াটাই কঠিন। ছবি: সংগৃহীত

সেখানকার সবকিছুই ছিল দারুণ, কিছুটা অদ্ভুতও বটে। ঘরে যা যা করার অভ্যাস আমার ছিল তার কিছুই ছিল না এখানে। তাই বলতে হয়, অনেক কিছু কঠিনও লাগতো। না আছে রাস্তার খেলা, না আছে আমাদের সেই ফুটবল ম্যাচ। সেখানে যেসব ছেলের সাথে পরিচয় হয়েছিল আমার, তাদের চালচলন কথাবার্তা ছিল অন্যরকম। ঘর থেকে বেরিয়ে দৌড়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করা আর খেলার ইচ্ছেটা পূরণ করতে পারতাম না আমি। আর্জেন্টিনার কোনোকিছুই ছিল না সেখানে। তবে আর্জেন্টিনা থেকে একটি জিনিস আমি নিয়ে গিয়েছিলাম বার্সেলোনায়, পরাজয়ের প্রতি ঘৃণা। হারতে আমি অপছন্দ করতাম, সেটা যাই হোক, যেখানেই হোক। মাঠে আমি সব সময়ই উজ্জীবিত থাকি। আমার মনে পড়ে, প্রথম যখন স্পেনে যাই আমরা একটা প্র্যাকটিস ম্যাচ খেলেছিলাম। সেখানে দেখি, এলাকার ছেলেরা খেলায় হেরে যাওয়াকে পাত্তাই দিচ্ছে না! আমি বুঝতেই পারলাম না, ওরা কীভাবে এমনটা পারলো!

বার্সেলোনার যুবদলে মেসির ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলেন সেস ফ্যাব্রেগাস ও জেরার্ড পিকে। ছবি: সংগৃহীত

আমি এখনো মনে প্রাণে অনুভব করি, আমি একজন আর্জেন্টাইন। আমার অভ্যাস এবং জীবনযাপন আর্জেন্টাইনদের মতো। বন্ধুদের সাথে দেখা হলেই চা খাই। প্রতি ক্রিসমাস ও গ্রীষ্মে যাই রোজারিওতে। আর যখন জাতীয় দলের খেলা থাকে তখন তো অবশ্যই। ব্যারিওতে গিয়ে এখনো দেখা করি বন্ধুদের সাথে। তবে বাচ্চাদের জন্য ব্যারিও আর আগের মতো নেই। বাচ্চাদের নিরাপত্তা নিয়ে মানুষজন দুশ্চিন্তা করে সেখানে। তাই রাস্তায় আমরা যেমন ছোট ছোট ফুটবল ম্যাচ খেলতাম, তেমনটা আর দেখা যায় না এখন।

তথ্যসূত্র: টম ওয়াটের ‘আ বিউটিফুল গেম’ বই থেকে অনূদিত

/এমই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply