মেগা প্রজেক্টের নামে ভুয়া কাগজ বানিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি (ভিডিও)

|

প্রতারক ও কথিত অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট কমান্ডার মহিউদ্দিন মজুমদার

আলোচিত প্রকল্পের ভুয়া কাগজপত্র বানিয়ে ভয়াবহ জালিয়াতি করেছেন মহিউদ্দিন মজুমদার নামে এক প্রতারক। নিজেকে পরিচয় দিতেন সশস্ত্র বাহিনী বা রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুত কেন্দ্র বা মেট্রোরেল অথবা সিপিটিইউ এর কর্তা ব্যক্তি হিসেবে। তার দেয়া কাগজপত্রে বিশ্বাস রেখে, এখন মাথায় হাত অনেক ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীর। কারণ, পণ্য সরবরাহের জন্য চেক পেলেও বিপরীতে কোনো অর্থ তুলতে পারেননি তারা। ভুক্তভোগীরা জানান, বছরের পর বছর এমন অপকর্ম চললেও প্রতারক পর্যন্ত পৌছতে পারেননি তারা কেউই।

বিল্ডবাড়ি বিডি নামে কনস্ট্রাকশন ম্যাটেরিয়ালস সাপ্লাই করেন মোহাম্মদ ফারহান লতিফ নামক এক ব্যবসায়ী। সম্প্রতি হোয়াটসঅ্যাপে অফার আসে সরকারি প্রকল্পের জন্য ক্যাবল সাপ্লাইয়ের। কথাবার্তার পর ওয়ার্ক অর্ডার, পারচেজ অর্ডার দেখে পণ্য সরবরাহ করেন লতিফ।

বিল্ডিবাড়ি বিডির সিইও ফারহান লতিফ বলেন, আমাকে বলা হয়েছিল যে, বাংলাদেশের সাবমেরিন ক্যাবলের যে ক্যাবল তার কাজে লাগবে। সিবিটিএর যে ওয়ার্ক অর্ডারের কাগজপত্রগুলো লাগে একদম হুবহু সেরকম কাগজে ও প্যাড দেখিয়ে অর্ডার দিয়েছিল প্রতারক।

বিস্তারিত দেখুন: মেগা প্রকল্পের ভুয়া কাগজ ও চেক; কোটি কোটি টাকার পণ্য লোপাট

বিল্ডিবাড়ির সিএমও বিডির ফয়সাল আহমেদ বলেন, অফিস ওয়ার্কের ক্ষেত্রে মোতামুটি নাইন্টি পারসেন্ট ওকে এমন কাগজপত্র নিয়ে এসেছিল। দেখে বিশ্বাস না হওয়ার কোনো উপায় ছিল না।

এর আগে, সৌখিন পলি এন্ড অ্যাকসেসরিজ নামের প্রতিষ্ঠান ৫শ কেজি পলি রোল এবং ৫শ রোল গান টেপ সাপ্লাই করে। তারা জেনেছে, এ পণ্য সরবরাহ করা হচ্ছে, রূপপুর পারমানবিক বিদ্যুত কেন্দ্র প্রকল্পে। এখানেও একই ব্যক্তি যোগাযোগ করে।

মেট্রোরেল প্রকল্পের নাম করেও বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে পণ্য ক্রয় করা হয়। কখনো, হোয়াইট প্লেইন ইলাস্টিক, কখনোবা গাম টেপ বা পলিরোল। পণ্য সরবরাহকারীকে দেয়া কাগজে ব্যবহার করা হয়, সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দপ্তরের নাম-ঠিকানা ও সিলমোহর। এমনকি বিক্রেতাদের ব্যাংকের চেকও দেয়া হয়, মূল্য হিসেবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত একটি টাকাও তুলতে পারেননি সরবরাহকারী ব্যবসায়ী। একজন ব্যবসায়ী বলছেন, সে ডিল করার পর একটা চেক দিয়েছিল আমাদের, যা ছিল ভুয়া। এমনকি উনি আমাদের ট্রান্সপোর্টও ব্যবহার করতেন না। যে গুডসগুলো আমরা ডেলিভারি দিয়েছি সেগুলো ওনার ট্রান্সপোর্ট এসে আমাদের ফ্যাকটরি থেকে নিয়ে গেছে। ব্যাংকে চেক যাওয়ার পর বাংলাদেশ ব্যাংকে যাওয়ার আগ পর্যন্ত যে সময় সাধারণত সে সময়ের মধ্যেই ব্যালেন্স অ্যাড হয়ে যায়, তো পরেরদিন যখন রিভাইস হলো ব্যালেন্স তখন ব্যাংক জানালো যে, চেকে যে নম্বর দেয়া আছে তারা ফোন রিসিভ করছে না এবং ওই অ্যাকাউন্টে কোনো ব্যালেন্স ছিল না।

প্রশ্ন হচ্ছে, আসলে কী কোনো প্রকল্পে পণ্য সরবরাহ করেছিলেন তারা? উন্নয়ন প্রকল্পে বিভিন্ন ধরনের পণ্য- ভুয়া কাগজ তৈরি- চেক ডিজঅনার; সবক্ষেত্রেই যোগাযোগকারী একজন ব্যক্তি। যিনি নিজেকে কখনও সাবেক সামরিক কর্মকর্তা, কখনও মেট্রোরেলের চিফ লিয়াঁজো অফিসার, কখনও রূপপূরের প্রধান নিরাপত্তা কর্মকর্তা বা সিপিটিইউ’র মত স্পর্শকাতর প্রতিষ্ঠানের সিএসও হিসেবে পরিচয় দিয়েছেন। ব্যবসায়ীদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জনে ব্যবহার করেছেন, এসব পদের ভিজিটিং কার্ড। অবশ্য প্রতারণার শিকার বেশিরভাগ ব্যবসায়ী সাক্ষাৎও পাননি তার।


ইউলাইন টেপ কোম্পানির সত্ত্বাধিকারী এ এম কুতুব উদ্দিন বলেন, উনি যখন ভিজিটিং কার্ড দিলেন তখন দেখলাম যে উনি বাংলাদেশ আর্মির লেফটেনেন্ট কমান্ডার মহিউদ্দিন মজুমদার, মেট্রোরেল প্রোজেক্টে কর্মরত। এটা দেখলে স্বাভাবিকভাবেই একটা আস্থা চলে আসে যে উনি বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্য আবার মেট্রোরেলের মতো এত বড় প্রোজেক্টে কাজ করছেন।

প্রতারণার শিকার হওয়া শোভা প্রিন্টিং এন্ড প্যাকেজিংয়ের সত্ত্বাধিকারী তাপস কর্মকার বলেন, উনি আমাদেরকে ক্যান্টনমেন্টের ক্যাফেটেরিয়াতে ডেকে বললেন যে, মেট্রোরেলের ৩০ হাজার পাউন্ডের অর্ডার আছে তাই প্রতি সপ্তাহে তার তিনশ থেকে পাঁচশ পাউন্ড করে লাগবে। আমরা তার অফার নিলাম, সে অনুযায়ী মাল ডেলিভারিও করলাম। মাল ডেলিভারির আধাঘণ্টা পর থেকে উনি আর ফোন ধরেননি।

মেট্রোরেলের কথিত প্রধান লিয়াঁজো কর্মকর্তা মহিউদ্দিন মজুমদারকে খুঁজতে ইস্কাটনের ডিএমটিসিএল কার্যালয়ে গিয়ে জানা গেলো, কেউ নেই এ নামে। সিপিটিউ এরও একই কথা। প্রতারিত অনেকে যোগাযোগ করেছেন এসব প্রতিষ্ঠানে।

অনুসন্ধানের নথিপত্র দেখাতে চাই পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রীকে। মেগাপ্রজেক্টের নামে এমন ভুয়া কাগজপত্র তৈরি ও প্রতারণার কথা জেনে বিস্ময় প্রকাশ করলেন তিনি। নিজেই খোঁজ নিলেন, কী ব্যবস্থা নিয়েছে সিপিটিইউ।

পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী ড. শামসুল আলম বলেন, কীভাবে পারলো এটা করার সাহস করতে! এত বড় জালিয়াতি করেছে, সরকারের ওপর তো দোষ আসবে এটার জন্য। কেন ব্যবস্থা নিচ্ছে না এখনও? এরকম একটা প্রতারককে কেন ধরছে না এখনও?

আমরাও যেতে চাই শেরে বাংলানগর থানায়, যেখানে মৌখিকভাবে জানিয়েছিল সিপিটিইউ। পুলিশ হেডকোয়ার্টার ও ডিএমপিতেও প্রতারণার কথা লিখিত জানিয়েছিল সিপিটিইউ। কী করলেন তারা?

এমন প্রশ্নের জবাবে ডিএমপির ডিসি (মিডিয়া) মো. ফারুক হোসেন বলেন, মামলা না করলে তো আমরা আসামি ধরতে পারতেছি না। আইনগতভাবে কাজ শুরু করার আগে পুলিশকে অবশ্যই আগে অভিযোগ পেতে হবে, তা জিডি হোক বা মামলা হোক যেকোনো এক ধরনের অভিযোগ পেতে হবে পুলিশকে। শুধু যদি অভিযোগ লিখে চিঠিও পাঠায় তাহলে আমরা ওই চিঠির ভিত্তিতে একটা অনুসন্ধান চালাতে পারি।

কথিত অবসরপ্রাপ্ত লেফট্যানেন্ট কমান্ডার মহিউদ্দিন মজুমদারের সঙ্গে যোগাযোগের বেশিরভাগ নম্বরই বন্ধ। সর্বশেষ ব্যবহার করা নম্বরগুলো খোলা থাকলেও রিসিভ করেন না কেউ।

আমরা যাচাই করতে চাই, অনুসন্ধানে পাওয়া যায় প্রতারক মহিউদ্দিন মজুমদারের জাতীয় পরিচয়পত্র। স্থায়ী ঠিকানা কুমিল্লার, চৌদ্ধগ্রাম উপজেলার মজুমদার বাড়ি। জানা গেলো, বেআইনি কর্মকাণ্ডের কারণে র‍্যাব থেকে চাকরিচ্যুত হয়েছিলেন তিনি। নানামুখী প্রতারণার শিকার ভুক্তভোগীরাও যোগাযোগের চেষ্টা করেছেন স্থায়ী ঠিকানায়।

দু’একজন কথা বললেও অনেকেই ভয়ে মুখ খুলতে চান না মহিউদ্দিনের বিরুদ্ধে। কয়েক বছর ধরে এমন প্রতারণা করে, কীভাবে পার পাচ্ছে প্রতারক? এ ব্যাপারে কী মনে করে টিআইবি? জানতে চাইলে টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, প্রথমত, সরকারের হাইপ্রোফাইল মেগা প্রজেক্টের একটা সুনাম, মর্যাদা ও আকর্ষণ আছে। এই আকর্ষণকেই ব্যবহার করেছে প্রতারক। প্রতারক নিজের পরিচয়ও দিচ্ছে এটাকে ব্যবহার করেই। দ্বিতীয়ত, তার যে ব্যক্তিগত পরিচয় সেটিকেও ব্যবহার করছে। দুটোই কিন্তু প্রতারণা ও অপরাধ। এটা সে করতে পারে না।

ভুক্তভোগীরা চান, যেসব মেগা প্রকল্পের নামে ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে প্রতারণা করা হয়েছে, তাদের তরফ থেকে আইনি পদক্ষেপে কঠিন সাজা হোক প্রতারকের।

/এসএইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply