সালাহ জাদুতে ২৮ বছর পর বিশ্বকাপ মাতাবে মিসর

|

বিশ্ব ফুটবলে মিসরকে মোটামুটি শক্তিশালী দল হিসেবেই বিবেচনা করা হয়। তবে, বিশ্বকাপের মতো আসরে একদমই অনিয়মিত ফারাওরা। মাত্র দু’বার ফুটবলের সর্বোচ্চ মঞ্চে দেখা গেছে তাদের। অথচ, ১৯৩৪ সালে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে বিশ্বকাপে নাম লেখায় মিসর। ১৬ দলের সেই বিশ্বকাপে প্রথম পর্বের একমাত্র নকআউট ম্যাচে হাঙ্গেরির কাছে ৪-২ গোলে হেরে বিদায় নেয় তারা। এর পর রাজনৈতিক কারণে ৪ বার বিশ্বকাপের মঞ্চ থেকে দূরে ছিল মিসর। তাদের বিশ্বকাপ অভিযাত্রার বন্ধ্যাত্ব ঘুচে ১৯৯০ সালে। সেবার গ্রুপ পর্বে প্রজাতন্ত্রী আয়ারল্যান্ড ও শক্তিশালী হল্যান্ডের সাথে ড্র করলেও আরেক জায়ান্ট ইংল্যান্ডের কাছে ১-০ গোলে হেরে বিদায় নেয় নীল নদের দান-মিসর। এরপর আবারও দীর্ঘ প্রতীক্ষা। একেকটা বিশ্বকাপ ফুটবল আসে আর যায়, মিসরীয়দের দীর্ঘশ্বাস ক্রমেই ভারি হতে থাকে। অবশেষে, এক পরশ পাথরের ছোঁয়ায় জেগে উঠেছে মিসর। বলাই বাহুল্য, এই পরশ পাথরের নাম- মোহাম্মদ সালাহ।

এরই মধ্যে রাশিয়া বিশ্বকাপের ২৯ সদস্যের প্রাথমিক দল ঘোষণা করেছে মিসর। অবশ্যম্ভাবীভাবেই সেখানেই জ্বলজ্বল লিভারপুল সুপারস্টার সালাহ’র নাম। এছাড়াও জায়গা পেয়েছেন আর্সেনালের মোহাম্মদ এলনেনি, স্টোক সিটির রামাদান সোভি। জায়গা হারিয়েছেন বিডভেস্ট উইটসের স্ট্রাইকার আমর গামাল।

মিসরের সর্বত্র এখন সালাহ বন্দনা। ইতিমধ্যে, ‘মিসরের রাজা’ খ্যাত মোহাম্মদ সালাহ দুর্দান্ত এক ফরোয়ার্ড। ইংলিশ প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব লিভারপুলে অবিশ্বাস্য এক মৌসুম কাটালেন। ২০১৭-১৮ মৌসুমেই অভিষিক্ত হয়ে গড়েছেন সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ড। প্রথম কোনো খেলোয়াড় হিসেবে এক মৌসুমেই তিনবার মাসের সেরা খেলোয়াড় হয়েছেন। লিগের সর্বোচ্চ গোলের নতুন রেকর্ড গড়ে জিতেছেন গোল্ডেন বুট। চ্যাম্পিয়নস লিগেও লিভারপুলকে এনে দিয়েছেন দারুণ সাফল্য। ইতিমধ্যেই, মেসি-রোনালদোর সাথে তুলনা শুরু হয়ে গেছে তার! এক কথায়, স্বপ্নময় এক সময় পার করছেন মিসরীয় মহারাজ।


সালাহ-তেই ভর করে প্রথম আফ্রিকান দেশ হিসেবে এবারের রাশিয়া বিশ্বকাপের টিকিট কেটেছে মিসর। আগামী ২৬ মে কুয়েতের সাথে প্রীতি ম্যাচ দিয়ে শুরু হবে তাদের বিশ্বকাপ যাত্রা। এরপর বেলজিয়ামের সঙ্গে ৬ জুন আরও একটি প্রীতি ম্যাচ খেলবে পিরামিডের দেশ মিসর। বিশ্বকাপের গ্রুপ-এ তে পড়েছে মিসর, যেখানে তাদের প্রতিপক্ষ স্বাগতিক রাশিয়া, সৌদি আরব ও উরুগুয়ে। ১৫ জুন উরুগুয়ের সাথে ম্যাচ দিয়ে রাশিয়া বিশ্বকাপের মূল মঞ্চে দেখা মিলবে মিসরের। আর সেই দিনটিই কিনা মোহাম্মদ সালাহ’র জন্মদিন!

১৯৯২ সালের ১৫ জুন বাসইয়ুন শহরের নাগরিগ গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মিসরের জাদুকর। ফুটবলে হাতেখড়ি ভাইয়ের মাধ্যমে। কঠিন পরিশ্রম করেই আজকের জায়গায় এসেছেন সালাহ। প্রাথমিক স্তরে পড়ার সময়ই গ্রাম থেকে আধা ঘণ্টা দূরের এক ক্লাবে নাম লেখান। কিছুদিন পর যোগ দেন আরও দূরের আরেক ক্লাবে। ১৪ বছর বয়সেই যোগ দিলেন কায়রোর আরব কন্ট্রাক্টরসে। প্রতিদিন সাড়ে চার ঘণ্টা পথ পাড়ি দিয়ে ক্লাবের অনুশীলনে যেতেন। কখনো তিনটি, কখনো চার-পাঁচটি বাস বদলাতে হতো। অনুশীলন শেষে সন্ধ্যায় গ্রামের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করতেন। পৌঁছাতে পৌঁছাতে রাত গভীর হয়ে যেত। কিন্তু পরদিনও যে একই রুটিন! কঠিন পরিশ্রম ও নিয়মের ছকে কাটিয়েছেন শৈশব। এর ফলও পেয়েছেন। মাত্র ১৭ বছর বয়সে মিসরের পেশাদার ফুটবলে অভিষিক্ত হন সালাহ!

২০ বছর বয়সে ইউরোপে চলে আসেন সালাহ। এফসি বাসেলের হয়ে চ্যাম্পিয়নস লিগে দুর্দান্ত খেলে ইউরোপের বড় বড় ক্লাবগুলোর নজরে পড়েন। ২০১৪ সালে সালাহকে দলে টানে চেলসি। কিন্তু দেড় মৌসুমে মাত্র তিন গোল এবং খেলার সুযোগ না পেয়ে ইতালিতে পাড়ি জমান সালাহ। রোমার হয়ে দুর্দান্ত দুই মৌসুম কাটিয়ে আবারও ফুটবল বসদের নজর কাড়েন সালাহ। দর্শকরাও ততদিন তাকে চিনতে শুরু করেছে। দুর্দান্ত গতি ও ড্রিবলিং ক্ষমতা তো আছেই, পাশাপাশি মেসির মতো বাম পায়ে নানা ধরনের ম্যাজিক দেখাতে থাকেন সালাহ। ‘মিসরের মেসি’ খেতাবও জুটে যায়। ২০১৭ সালে ৪২ মিলিয়ন ইউরোতে নাম লেখান লিভারপুলে। তারপর যা করলেন তা এখন রেকর্ড বুকে। ভালোবেসে সালাহকে নিয়ে দারুণ সব গান বেঁধেছেন লিভারপুল সমর্থকরা। মিসরের বিশ্বকাপ নিশ্চিত করা ম্যাচে কঙ্গোর বিপক্ষে দুটি গোলই করেন জাদুকর সালাহ। তবে, এসব রেকর্ড নিয়ে একদমই ভাবছেন না বিনয়ী সালাহ। প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপের দ্বিতীয় পর্বে ওঠাই যে এখন তার মূল সংকল্প।

২০১৩ সালে বিয়ে করেন মোহাম্মদ সালাহ। পরের বছর কন্যা সন্তানের জনক হন তিনি। পবিত্র নগরী মক্কার নামে রেখেছেন কন্যার নাম। যারা সালাহকে তেমন জানেন না, এতক্ষণে তাদেরও বুঝে যাওয়ার কথা, সালাহ একজন সাচ্চা মুসলমানই বটে!

বিশ্বকাপে মিসরের ২৯ সদস্যের প্রাথমিক দল:

গোলরক্ষক: ইসাম এল-হাদারি, মোহাম্মদ এল-শেনাওয়ায়ি, শেরিফ ইকরামি ও মোহাম্মদ আওয়াদ।

রক্ষণভাগ: আহমেদ ফাথি, সাদ সামির, আয়মান আশরাফ, মাহমুদ হামদি, মোহামেদ আবদেল শাফি, আহমেদ হেগাজি, আলি গাবর, আহমেদ এল-মোহাম্মাদি, করিম হাফেজ, ওমর গাবের ও আমরো তারেক।

মধ্যমভাগ: তারেক মাহমুদ, মাহমুদ আবদেল আজিজ, শিকাবালা, আব্দুল্লাহ সাঈদ, স্যাম মোর্সি, মোহাম্মদ এলনেনি, কাহরাবা, রামাদান সোবহি, মাহমুদ তেরেজিগুয়েত হাসান ও আমর ওয়ার্দা।

আক্রমণভাগ: মারওয়ান মোহসেন, আহমেদ গোমা, আহমেদ কোকা মাহগুব ও মোহাম্মদ সালাহ।

 

গ্রন্থনা: তোয়াহা ফারুক
যমুনা অনলাইন: টিএফ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply