স্টাফ করেসপনডেন্ট, রংপুর:
গজলডোবার গেট খুলে দেয়ায় উজানের ঢল এবং বর্ষণে তিস্তার পানি ডালিয়া ব্যারাজ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। তিস্তার বাড়ন্ত পানি ঢুকেছে অববাহিকার চরাঞ্চল ও নিম্নাঞ্চলে বাসা-বাড়িতে। তলিয়ে গেছে বাদামসহ বিপুল পরিমাণ উঠতি ফসল। দুর্গত মানুষের পাশে এখনও পৌছেনি কোনো সহায়তা। স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জানিয়েছেন তাদের অসহায়ত্বের কথা।
রংপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী আহসান হাবীব জানিয়েছেন, বৃষ্টিপাত এবং উজানের ঢলের কারণে তিস্তার ডালিয়া ব্যারেজ পয়েন্টে বুধবার (১৫ জুন) রাত ৯টা থেকে তৃতীয় দফায় পানি বেড়ে বৃহস্পতিবার (১৬ জুন) দুপুরে তা বিপদসীমার ৫ সেন্টিমিটার দিয়ে প্রবাহিত হতে থাকে। এই পানি বিকেলে কিছুটা কমে রাতে আবারও বিপদসীমার অনেক ওপরে থাকবে বলে জানান তিনি।
পাউবোর এ কর্মকর্তা আরও জানান, এ পূর্বাভাস আমরা গত দুই সপ্তাহ থেকে সংশ্লিষ্টদের জানাচ্ছি। যাতে নদী অববাহিতকার লোকজন গবাদিপশুসহ অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস সরিয়ে নিরাপদ জায়গায় অবস্থান নিতে পারেন।
এদিকে, রংপুর আবহাওয়া অফিসের সহকারী আবহাওয়াবিদ মোস্তাফিজার রহমান জানান, বৃহস্পতিবার বিকেল ৩টা পর্যন্ত আগের ২৪ ঘণ্টায় রংপুর অঞ্চলে ৩৫ দশমিক ৩ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত হয়েছে, যা অব্যাহত থাকবে।
সরেজমিনে বন্যা দুর্গত বিভিন্ন এলাকা এবং নদীপাড়ের মানুষের কাছ থেকে পাওয়া তথ্য মতে, তিস্তায় পানি বৃদ্ধি শুরু হওয়ায় নীলফামারীর ডিমলার ছাতনাই এলাকা থেকে জলঢাকা, লালমনিরহাটের পাটগ্রাম হাতীবান্ধা, কালিগঞ্জ, আদিতমারি, সদর, রংপুরের গঙ্গাচড়া, কাউনিয়া, পীরগাছা, কুড়িগ্রামের রাজারহাট, উলিপুর, চিলমারি, এবং গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জের হরিপুরের ব্রহ্মপুত্র নদ পর্যন্ত অববাহিকার ৩৫২ কি.মি. এলাকার চরাঞ্চল এবং নিম্নাঞ্চলে পানি উঠেছে। কোথাও কোথাও বাড়িতে কোমর অবধি পানি উঠেছে।
এসব এলাকার উঠতি বাদাম, আমনের চারা, পাট, সবজিসহ বিভিন্ন ফসল নিমজ্জিত হয়েছে। অনেক স্থানে রাস্তাঘাট ভেঙ্গে যাচ্ছে পানির স্রোতে।
এদিকে, দুর্গত এলাকায় মানুষ খুবই বিপদে পড়েছেন। কোথাও পৌঁছেনি কোনো সহযোগিতা। বিশেষ করে বৃদ্ধ ও শিশুদের কষ্ট চরমে পৌঁছেছে। গবাদি পশু নিয়ে বিপাকে পড়েছেন গৃহস্থরা।
বৃহস্পতিবার বেলা ১১টায় সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, গঙ্গাচড়ার শেখ হাসিনা তিস্তা সেতু এলাকায় স্থানীয় চেয়ারম্যান আব্দুল্লাহ আল হাদি নিজেই মাইকিং করে পানি বৃদ্ধির সতর্কতা জানাচ্ছেন এলাকাবাসীকে। তিনি মাইকিং করে এলাকাবাসীকে আশ্রয় কেন্দ্র ও উঁচু স্থানে অবস্থান নেয়ার আহবান জানাচ্ছেন।
চেয়ারম্যান হাদি জানান, সকাল থেকে তিস্তার পানি বিপদসীমার উপরে যাওয়ায় আমরা মাইকিং করছি। আমার ইউনিয়নের ৫ টি ওয়ার্ডের ১ হাজার বাড়িঘর ইতোমধ্যেই তলিয়ে গেছে। সেখানকার বৃদ্ধ, নারী ও শিশুদেরকে আমরা রেসকিউ করে নিরাপদ স্থানে আনছি। গত বছর অনেক প্রাণহানী হয়েছিল, এবার যেন সেটি না হয় সেজন্য আমরা বিভিন্ন পয়েন্টে নৌকায় করে সতর্কতামূলক কার্যক্রম চালাচ্ছি।
তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত পানিবন্দী কোনো মানুষকে আমরা সহযোগীতা করতে পারিনি। তবে, ইউএনও মহোদয়কে সার্বিক পরিস্থিতি বিস্তারিতভাবে জানানো হয়েছে। তবে আমরা সরকারের ওপর ভরসা করে থাকবো না। আগামীকাল থেকে আমরা নিজস্ব তহবিল থেকেই পানিবন্দী মানুষের কাছে শুকনা খাবার পৌছে দিবো যতোটা পারি।
স্থানীয় ৩নং ওয়ার্ডের মেম্বার মনোয়ারুল ইসলাম জানান, আমরা নৌকা দিয়ে বৃদ্ধ এবং শিশুদের উঁচু স্থানে নিয়ে আসছি। এছাড়া আর কোনো সহযোগীতা এখনও করতে পারি নাই। ওপরে জানিয়েছি, তারা এখন পর্যন্ত আসেননি।
পানিবন্দী পশ্চিম ইচলি এলাকার বয়োবৃদ্ধা ফাতেমা জানালেন, হারা (আমরা) ১৫ দিন হলো পানিত থাকি। মেম্বর-চেয়ারম্যান কেউ আইসে নাই। বাঁচি আছি না মরি গেছি কেউ পুসও করে নাই (জিজ্ঞেস করেনি)। তোমরা খালি ফটো তুলি নিয়া যান, হামার জইন্যে কিছু করেন বাবা।
একই এলাকার পানিবন্দি নাসিমা বেগমের বাড়ি নদী থেকে আর মাত্র ৫ গজ দূরে আছে। যেটুকু বাড়ি এখনও অবশিষ্ট আছে সেটুকুই দূরে কোথাও নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিলেন তিনি। তিনি জানালেন, হামার আর কিচুই থাইকলো না। ঘরকোনা সরে নিয়া যাওসি। চেয়ারম্যান ঘর কোনা তুইলার কইছে। ওট্টই নিয়া যায়া থোমো, রাইত কোনা যে কি হয়!
এদিকে, সরেজমিনে দেখা গেছে পানি উন্নয়ন বোর্ড আর মহিপুরসহ বিভিন্ন স্থানে আপদকালীন বালুভর্তি জিও ব্যাগ রেখে দিয়েছেন। সম্ভাব্য ভাঙ্গন ঠেকাতে এসব জিও ব্যাগ আগাম মজুদ করা হয়েছে বলে জানিয়েছে পাউবো। এছাড়াও বিনবিনিয়ায় স্থানীয়দের নির্মিত দুটি বাঁধ রক্ষা করতে পানি উন্নয়ন বোর্ড বাঁশের স্পার ও জিও টিউব ব্যাগ ফেলছে।
/এসএইচ
Leave a reply