ব্যক্তি নয় আগামীর সিনেমার তারকা হবে গল্প: বিধান রিবেরু

|

যমুনা নিউজের সাথে একান্ত সাক্ষাৎকারে চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু।

ঈদের সিনেমা ‘পরাণে’ বুদ হয়ে আছেন বাংলাদেশের সিনেমাপ্রেমীরা। ধারণা করা হচ্ছে, শুক্রবার (২৯ জুলাই) মুক্তির অপেক্ষায় থাকা আলোচিত সিনেমা ‘হাওয়া’ বদলাবে ইন্ডাস্ট্রির হাওয়া। সত্যিই কী তবে সুদিন ফিরবে বাংলা সিনেমার? এদিকে বাড়ছে আধুনিক সিনেমা হল। কমছে সিঙ্গেল স্ক্রিনের সংখ্যা। কি হবে সিঙ্গেল স্ক্রিনের ভবিষ্যৎ? সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির এমন নানা বিষয় নিয়ে যমুনা নিউজ মুখোমুখি হয়েছিল চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রেবেরুর।  

বাংলা সিনেমার সেই সুদিন আর নেই-এ কথা এখন বেশ পুরোনো। করোনার থাবা শেষ পেরেক মেরেছিল সে পুরোনো সঙ্কটে। করোনার ধকল কাটিয়ে গত ঈদুল ফিতরের সিনেমা কিছুটা আশার আলো দেখিয়েছে। সে আলো তীব্রতর হয়েছে ঈদুল আজহার সিনেমায়। আগামীকাল মুক্তি পেতে যাওয়া ‘হাওয়া’ সিনেমাটি ইঙ্গিত দিচ্ছে আরও আশা জাগানিয়া গল্পের।

উৎসব-পার্বণে সিনেমা নিয়ে এমন উন্মাদনা থাকলেও অন্য সময়ের চিত্র ভিন্ন। বছরের অন্য সময় মুক্তি পাওয়া সিনেমার পরিসংখ্যান কিংবা প্রাপ্তি সে কথাই বলে। এর মূল সঙ্কট আসলে কোথায়? এ প্রসঙ্গে চলচ্চিত্র সমালোচক বিধান রিবেরু বলেন, দেখুন বাংলাদেশের চলচ্চিত্র বলতে আমরা কিন্তু বিএফডিসিকেও বুঝি। তারাও মূলধারার বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র বানাচ্ছেন। কিন্তু তারপরও দেশে চলচ্চিত্রের সুদিন ফিরছে না। এই সুদিন না ফেরার দুইটা কারণ আছে বলে আমি মনে করছি। এক. তারা যদি আরেকটু দূরদৃষ্টি সম্পন্ন হন এবং জানাশোনার পরিধিটা যদি একটু বাড়িয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণে আসেন বা নতুন চিন্তাভাবনা করছে এমন তরুণদের যুক্ত করেন, তাহলে দেশে ভাল চলচ্চিত্র হবে। আর দ্বিতীয়ত, বাংলাদেশে চলচ্চিত্র পাইরেসি হয়, যা রোধ করতে প্রশাসনের আরও শক্ত ভূমিকা পালন করা উচিত। এ ইস্যুগুলোকে অ্যাড্রেস করা ও ব্যবস্থা নেয়া খুবই জরুরি।

৭৫তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে বাংলাদেশের একমাত্র জুরি হিসেবে আয়োজনে যুক্ত হয়েছিলেন চলচ্চিত্র সমালোচক ও সাংবাদিক বিধান রিবেরু। জানালেন নানা দেশের নানা ধরনের সিনেমার সাথে বাংলাদেশের সিনেমার পার্থক্য। 

কানে নিজের অভিজ্ঞতা নিয়ে বিধান রিবেরু বললেন, কান চলচ্চিত্র উৎসব হলো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের তীর্থস্থান। তো স্বাভাবিকভাবেই তীর্থস্থান থেকে ঘুরে আসার অনুভূতি হচ্ছে আমার। সেখানে বিভিন্ন দেশের সিনেমা দেখতে দেখতে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে তা হলো, বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের সাথে অন্যান্য দেশের চলচ্চিত্রের মূল পার্থক্যটা হয় মূলত কারিগরী দিকে। ওই ছবিগুলো কারিগরী দিক থেকে একদম নিখুঁত হয়। যেমন ধরুন- গল্পের ন্যারেশন, লাইটিং, এডিটিং, কালার গ্রেডিং, অভিনয় কোথাও কোনো কমতি থাকে না।

এদিকে, দেশে বাণিজ্যিক সিনেমার সূতিকাগার সিঙ্গেল স্ক্রিনের সংখ্যা কমতে কমতে ঠেকেছে তলানিতে। ক্রমান্বয়ে বাড়ছে আধুনিক সিনেমা হল। সিঙ্গেল স্ক্রিনের ভবিষ্যৎ নিয়ে বিধান রিবেরু বললেন, দেখুন আগেকার সেই টাইপরাইটার কিন্তু আর নেই। দিন বদলেছে মানুষের সেই সাথে চাহিদাও বদলেছে। মানুষের বিনোদনের যে অরিয়েন্টেশন সেটিও পাল্টে গেছে। এখন মানুষের বিনোদনের অরিয়েন্টেশন এমন যে-মানুষ কোথাও ঘুরতে যাবে, সেখানকার ফুডকোর্টে খাবে, সেখানেই একটা সিনেমা দেখবে সেই সিনেমা দেখে তারা ঘরে ফিরবে। অর্থাৎ, তারা এখন একসাথে অনেককিছু চায়। যুগ পরিবর্তনের যে ব্যাপারটা সেটি কিন্তু মানতেই হবে। দেখুন একসময়কার খুব জরুরি ঝর্ণা কলম বা টাইপরাইটারের মতো জিনিসগুলো কিন্তু এখন আর নেই। এগুলোর জন্য আমরা আক্ষেপ করছি না, করার প্রয়োজনও নেই। ঐতিহ্যের অংশ হিসেবে কিছু সিঙ্গেল স্ক্রিন রাখা যেতে পারে, কিন্তু সেটি যে বাণিজ্যিকভাবেও সফল হবে তা কিন্তু বলা যাচ্ছে না। তবে এগুলো যেহেতু আমাদের ঐতিহ্যের অংশ। তাই এগুলোকে সংরক্ষণ করতে শিখতে হবে। মানুষ এখন ক্রমশ মাল্টিস্ক্রিনের দিকে ঝুঁকছে, আর একাধিক স্ক্রিন থাকলে নৈর্ব্যক্তিকভাবে সিনেমা পছন্দ করে দেখতে পারে। এটা অনেক বড় একটা ব্যাপার, এ সুবিধা কিন্তু সিঙ্গেল স্ক্রিনে নেই। মানুষ এখন অপশন পছন্দ করে। মানুষের বিনোদনের ধারণা যে পাল্টেছে এই ব্যাপারটা বুঝতে হবে। মানুষের হাতে যে টিভি তাতে একশোটা চ্যানেল আছে বড় বড় অনেক ওটিটি প্ল্যাটফর্ম আছে। এসবের মানে কিন্তু এই নয় যে সিঙ্গেল স্ক্রিন আবারও ফিরে আসবে, এটা আর সম্ভব না।

গত ঈদে মুক্তি পায়নি শাকিব খানের কোনো সিনেমা। অথচ গত ১৬ বছর ঈদের সিনেমা ছিল তারই দখলে। এমন বাস্তবতায় আগামীর তারকা নিয়ে নানা জন বলছেন নানা কথা। বিধান রিবেরু বললেন, দেখুন বাংলাদেশের সিনেমার প্যারাডাইম কিন্তু চেঞ্জ হয়ে গেছে। এখন কিন্তু শ্রমজীবী বা মধ্যবিত্তদের আগের মতো মারামারি-যৌন সুড়সুড়ি দিয়ে হলে আনা যাবে না। যারা মূলধারার চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন তারা কিন্তু আর নতুন কিছু আনতে পারছেন না। একধরনের ব্যর্থতার বৃত্তে ঢুকে পড়েছেন তারা, এটা তাদের স্বীকার করতেই হবে। যেমন ধরুন-বাংলাদেশের এক নম্বর নায়ক শাকিব খানের কোনো সিনেমা কিন্তু এবারের ঈদে মুক্তি পায়নি। তারমানে উনিও বুঝতে পারছেন যে, বাংলাদেশে কমার্শিয়াল ফিল্মের মার্কেট আর নেই। এখন বাংলাদেশের মধ্যবিত্তরা ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্ম মেকারদের চলচ্চিত্র দেখতে শুরু করেছেন। কারণ ইনডিপেন্ডেন্ট ফিল্মমেকাররা যে সিনেমা বানাচ্ছেন সেগুলো এখনকার মধ্যবিত্তের রুচিকে প্রতিফলিত করছে। মধ্যবিত্তের সিনেমা বানানো হচ্ছে বলেই মধ্যবিত্ত হলে ফিরছে।

গল্প, কারিগরি উন্নয়ন,অভিনয় কিংবা নির্মাণ আরো আধুনিক হলে বিশ্বায়নের এই সময়ে হয়তো  বাংলা সিনেমা নিজ সীমানা ছাড়িয়ে বিশ্বমানিত্রে জানান দিবে নিজের অবস্থানের। কিন্তু, কবে?   

/এসএইচ 


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply