পঞ্চগড় প্রতিনিধি:
পঞ্চগড়ের তেঁতুলিয়ায় দিনদিন বৃদ্ধি পাচ্ছে মাদকাসক্ত ও মলমপার্টির উৎপাত ও দৌরাত্ম্য৷ রাত হলেই বিভিন্ন সড়ক কিংবা বাসা-বাড়িতে ঘটছে চুরির ঘটনা৷ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন স্থানীয়রা, এমন চুরির আতঙ্কে দিনরাত্রি পার করছেন তারা। গত তিন মাসে উপজেলার ভজনপুর এলাকায় চারটি বাড়িতে রাতের আধারে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে টাকাসহ গয়নাপত্র চুরির ঘটনা ঘটছে৷ এমন তৎপরতা ঠেকাতে এখন রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছেন স্থানীয়রা।
জানা যায়, জেলার তেঁতুলিয়া উপজেলার ভজনপুর ও দেবনগড় ইউনিয়নের বিভিন্ন এলাকায় ঘুম ও চেতনানাশক ওষুধ দিয়ে রাতের আঁধারে পরিবারের সকল সদস্যদের ঘুম পাড়িয়ে টাকা, গয়না, জমির দলিল, গুরত্বপূর্ণ কাগজপত্র ও আসবাপত্র চুরি করে নিয়ে যাচ্ছে চক্রটি৷ অনেকেই পুলিশের কাছে আটক হলেও স্থানীয় কিছু প্রভাবশালী ব্যক্তি তাদের জামিনের ব্যবস্থা করেন বলে অভিযোগ ভুক্তভোগীদের।
ভুক্তভোগীরা জানান, যে চক্রটি এমন ঘটনা ঘটাচ্ছে তারা স্থানীয় মাদকাসক্ত যুবক, তাদের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে। তার মধ্যে দুই একজন পালাতকও রয়েছেন৷ মূলত বসতবাড়িতে চুরির জন্য স্থানীয়রা ওই মাদকাসক্ত যুবকদের বিভিন্ন এলাকা থেকে চোর ভাড়া করে নিয়ে এসে এলাকার প্রভাবশালী ও ব্যবসায়ীদের বাড়িতে সুযোগ বুঝে এমন চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। তারা বলেন, চক্রটি তাদের স্থানীয় সোর্সের মাধ্যমে কোন বাড়িতে চুরি করবে সেটা নিশ্চিত হয়ে প্রথমেই গোপনে ও কৌশলে সেই বাড়িতে প্রবেশ করে। পরে রান্নাঘরের চা, চিনি, হলুদ-মরিচের গুঁড়া, পানি, লবণসহ বিভিন্ন মসলার সাথে চেতনানাশক মিশিয়ে রাখে৷ পরে সেই উপকরণ দিয়ে রান্না করার পর পরিবারে সদস্যরা রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে দীর্ঘ কয়েক ঘণ্টা অচেতন হয়ে থাকে সবাই। সেই সুযোগে রাতের আঁধারে সেই বাড়িতে প্রবেশ করে টাকা-পয়সা, দলিলপত্রসহ বিভিন্ন আসবাপত্র চুরি করে নিয়ে যায় তারা৷ এভাবে উপজেলায় কয়েকটি এলাকায় চুরির ঘটনা ঘটেছে। এতে জীবনের অর্জিত সব সম্বল হারিয়ে পথে বসেছে অনেকেই৷
ওই এলাকার ব্যববসায়ী, দোকানদার থেকে শুরু করে ইউনিয়ন পরিষদের গ্রাম চৌকিদারের বাড়িতেও এমন চুরির ঘটনা ঘটেছে৷ হঠাৎ বাড়িতে চুরি হয়ে পথে বসেছেন এমন কয়েক জন ভুক্তভোগী তেঁতুলিয়া মডেল থানায় অভিযোগ করলেও এতে কোনো সুরাহা পাননি। ফলে ধরাছোঁয়ার বাইরে থাকছে চক্রটির সদস্যরা৷
স্থানীয় সূত্রে জানা যায়, একসময় করতোয়া নদী ও সমতল ভূমি থেকে প্রচুর পরিমাণে পাথর উত্তোলন হতো। কিন্তু পরিবেশ রক্ষার স্বার্থে অবৈধ ড্রেজার মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন বন্ধ রেখেছে সরকার৷ অন্যদিকে বেকার হয়ে পড়ায় অনেক যুবক মাদকাসক্ত ও বিভিন্ন অসমাজিক অপকর্মে লিপ্ত হয়েছে৷ তারা শুধু মাদক সেবনই নয়, ভারত থেকে নিয়ে মাদক এনে তা বিক্রিও করে। এছাড়া অবৈধ পথে গরু পারাপার, রাতের আঁধারে বিভিন্ন সড়কে মানুষকে জিম্মি করে অর্থ আদায় এবং চেতনাশাষক ওষুধ খাইয়ে বাড়ি ও ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানে চুরিও করছে তারা। কোনো আয়ের পথ না থাকলেও কিছু দিনের মধ্যে চক্রটির সদস্যরা ধনী বনে গেছেন৷ দামি ফ্লাটসহ আলিশান বাড়ি, মোটরসাইকেল ও বিলাসী চলাফেরা করছেন তারা। কিছুদিন পর পর বিভিন্ন এলাকায় ধরা পড়ে জেলহাজতে গেলেও দুদিনের মাথায় জামিনে মুক্তি পয়ে পুনোরায় একই কাজে লিপ্ত হচ্ছে তারা৷ ফলে দিন দিন তাদের অত্যাচারে অতিষ্ঠ ও আতংকে দিনরাত্রি পার করছে উপজেলার সাধারণ মানুষরা৷
ভুক্তভোগীরা ভজনপুর এলাকার সাহিরুল ইসলাম, তারেক, হানিফ বাবু, জাকের, নজমুল ইসলাম, হাসনুর ও বকুলসহ বেশ কয়েকজনকে সন্দেহ করছেন। এর মধ্যে কয়েক জনের বিরুদ্ধে থানায় একাধিক মামলাও রয়েছে, তবে তারা ধরাছোঁয়ার বাইরে। তাদের কোনো কাজ না থাকলেও চলাফেলা রাজকীয়। মূলত তারাই বিভিন্ন এলাকা থেকে চোর ভাড়া করে নিয়ে এসে এমন ঘটনা ঘটাচ্ছেন বলে অভিযেগা স্থানীয়দের।
এবিষয়ে কথা হয় অভিযুক্ত হানিফ বাবু নামে একজনের সাথে, তিনি বলেন, এলাকার কোনো মানুষের বাড়িতে চুরি হলেই পুলিশ আমাকে ধরে মামলা দেয়৷ আমি এর থেকে মুক্তি চাই। কিন্তু তাকেই কেন সন্দেহ করা হয়? এমন প্রশ্নে তিনি বলেন, আমি আগে মাইক্রোবাস চালাতাম, অনেকেই আমাকে ভাড়া নিয়ে যেতো। তাই তাদের সাথে আমার যোগাযোগ থাকায় আমি বিষয়গুলো খুটিনাটি জানতাম৷ এখন তাদের সাথে যোগাযোগ নেই৷ আমার নানার বাড়িতে মায়ের কিছু সম্পদ পেয়েছি সেগুলো থেকে কিছু টাকা পেয়ে আমি ব্যবসা করে চলছি৷
ভজনপুর ইউনিয়নের গ্রাম চৌকিদার সেকেন্দার আলী বলেন, আমি সাধারন মানুষের নিরপত্তার জন্য কাজ করি। অথচ আমার বাড়িতে চুরি হয়েছে। আমার বাড়িতে মলমপার্টি ঢুকে তালা ভেঙে টাকা পয়সা নিয়ে পালিয়ে যায়। কয়েকদিন পর পর এমন ঘটনা ঘটছে। আমরা তাদের ভয়ে রাত জেগে বাড়ি পাহারা দিচ্ছি।
ভজনপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান মসলিম উদ্দিন জানান, আমি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পর মাদক, চুরিসহ বিভিন্ন অসামাজিক কাজের বিরুদ্ধে একাধিকবার অভিযান চালিয়েছি। এমন অভিযানে আমার ইউনিয়নে অনেকখানি কমে গেছে। তবে যারা মাদকাসক্ত তারাই মূলত মলমপার্টি বা বাড়িতে চুরির ঘটনা ঘটাচ্ছে। যারাই এমন কাজে জড়িত থাকুক না কেন আমরা বিষয়টি গভীরভাবে তদন্ত করছি। গ্রামের গ্রামে গ্রাম পুলিশের তৎপরতা বৃদ্ধি করা হয়েছে।
তেঁতুলিয়া মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবু সাঈদ চৌধুরী বলেন, আমি যেদিন থেকে মডেল থানায় যোগদান করেছি সেদিন থেকেই মাদক, চুরি, জুয়াসহ বিভিন্ন সমস্যা রোধে অভিযান পরিচালনা করছি। তেঁতুলিয়ায় যেন কোনো মানুষের বাড়িতে চুরি কিংবা হয়রানির শিকার না হয় তার জন্য আমরা কাজ করে যাচ্ছি। মলমপার্টি চক্র যদি থেকে থাকে আমরা তাদের অব্যশই খুঁজে আইনের আওতায় নিয়ে আসবো৷
/এডব্লিউ
Leave a reply