কেমন ছিল পেলের মুখোমুখি হওয়া; প্রতিপক্ষের অভিজ্ঞতার বয়ান

|

ছবি: সংগৃহীত

ইতিহাসের একমাত্র ৩টি বিশ্বকাপ জয়ী ফুটবলার পেলে। ১৯৫৮, ১৯৬২ ও ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ জয় করে সর্বকালের সেরা হিসেবেই নিজের নাম স্বর্ণাক্ষরে লিখে গেছেন ব্রাজিলের এই কিংবদন্তি। কেমন ছিল পেলের মুখোমুখি হওয়ার অভিজ্ঞতা- ‘দ্য গার্ডিয়ান’র প্রতিবেদন অনুসারে তিনজন ফুটবলারের বয়ানে দেখুন সেই অভিজ্ঞতার স্বরূপ।

১৯৫৮ বিশ্বকাপ:

সুইডেন বিশ্বকাপের আগে খুব কম মানুষই পেলের কথা জানতো। ফাইনাল ম্যাচে দুইটি গোল যখন করেন পেলে, তার বয়স মাত্র ১৭! আর এই আসরের পর ঘর গৃহস্থালিতেও পরিচিত হয়ে উঠেছিল তার নাম। সে সময়ের অন্যতম সেরা উইঙ্গার সুইডিশ ফুটবলার কার্ট হ্যামরিন পেলের প্রসঙ্গে জানান, প্রচণ্ড নম্র ও বিনয়ী এই ছেলে ছিল দুর্লভ এক প্রতিভা। তিনি বলেন, ১৯৫৮ সালে সুইডেনের কেউ তাকে চিনতো না। টুর্নামেন্টের শুরুতে তার চোট ছিল। তাই গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচের আগে মাঠেও নামেনি। ফাইনালের আগে তাকে চিনতামও না। শুনেছিলাম, ১৭ বছর বয়সী এই লেফট উইঙ্গার আছে, যে ৩ ম্যাচে করেছিল ৪ গোল। কিন্তু সত্যি কথা বলতে, আমরা ব্রাজিলের অন্যান্য খেলোয়াড় যেমন ভাভা, গারিঞ্চাদের নিয়েই বেশি উদ্বিগ্ন ছিলাম।

হ্যামরিন বলেন, ফাইনালের পর আমরা শিখেছিলাম, পেলেকে গুরুত্ব দেয়া উচিত ছিল। দুইটি গোল করেছিল সে, যার মধ্যে ছিল দুর্দান্ত এক ভলি। এত কম বয়সে তার নিখুঁত খেলা দেখে বিস্মিত হয়েছিলাম। তবে ফাইনালের সেরা খেলোয়াড় সে ছিল না। দিদি ও গারিঞ্চা সেই আলো কাড়লেও বুঝতে কষ্ট হয়নি, পেলে এক দুর্লভ প্রতিভা।

এরপর যখন পেলেকে দেখেছি, সে তখন বিশ্বের সেরা খেলোয়াড়। ১৯৬৬ বিশ্বকাপের আগে স্টকহোমে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে এক প্রীতি ম্যাচ খেলেছিল সুইডেন। এমন এক কাণ্ড করেছিল পেলে, যা এর আগে কখনও দেখিনি। মাঠের মাঝবিন্দু থেকে কিক অফের সময়ই গোলপোস্ট লক্ষ্য করে শট নেন পেলে। গোলকিপার ছিলেন পোস্ট থেকে কিছুটা সামনে দাঁড়ানো। দ্রুত পিছিয়ে কোনোমতে পাঞ্চ করে সে যাত্রা দলকে গোল হজম করা থেকে বাঁচিয়েছিলেন সেই গোলরক্ষক। কিন্তু দর্শক পেলের এই উদ্ভাবনী শক্তিতে মুগ্ধ হয়েছিল সেদিন।

পেলে ছিল দারুণ নম্র এক মানুষ। বিশ্বকাপে সুইডেনকে হারিয়ে প্রথম বিশ্বকাপ জয়ের পরও সুইডিশ দর্শকদের অভিবাদন জানিয়েছে সে, প্রতিপক্ষকে দিয়েছে সম্মান। ল্যাপ অব অনারের সময় সুইডেনের বিশাল এক পতাকা বহন করেছিল ব্রাজিল স্কোয়াড। আর, গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচগুলো খেলেনি পেলে। তখন সে সুইডেনের ছোট্ট শহরে স্থানীয়দের সাথে সময় কাটাতো। বর্তমান ফুটবল তারকাদের এমনটি করতে খুব বেশি দেখবেন না আপনারা।

১৯৬২ বিশ্বকাপ:

চেকোস্লোভাকিয়ার বিরুদ্ধে গ্রুপের দ্বিতীয় ম্যাচে ইনজুরিতে পড়ে শেষ হয় পেলের সেই বিশ্বকাপ যাত্রা। ব্রাজিল তবুও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়। ব্রাজিলের বিপক্ষে গ্রুপ পর্বের প্রথম ম্যাচ থেকেই মেক্সিকোর ডিফেন্ডার গিলের্মো সেপুলভেদা জানিয়েছেন, কেমন ছিল ‘দানব’র মুখোমুখি হওয়ার সেই অভিজ্ঞতা।

তিনি বলেন, পেলে অন্য কারও মতোই ছিল না। সে ছিল ধ্বংসাত্মক এক ‘দানব’! দারুণ ব্যক্তিত্বের এই খেলোয়াড়ের হেডার ছিল ভালো, বলের নিয়ন্ত্রণও চমৎকার। সতীর্থ হিসেবেও সে ভালো। এমন খেলোয়াড় হওয়া সত্ত্বেও সে ছিল প্রচণ্ড নম্র। আর এমন যুগলবন্দি সাধারণত দেখা যায় না। সতীর্থদের ব্যাপারে কখনও অভিযোগ জানাতো না সে। বরং, সবাইকে অনুপ্রাণিত করতো। তার বিপক্ষে অনেকবারই খেলেছি আমি। নিপাট ভদ্রলোক সে। দুর্দান্ত খেলোয়াড়ের বাইরেও সে ছিল শিক্ষিত।

গিলের্মো সেপুলভেদা আরও বলেন, ১৯৬২ সালে যখন ব্রাজিলের বিপক্ষে খেললাম, তখন তারা বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন। জানতাম, কঠিন এক ম্যাচ অপেক্ষা করছে। ৫৬ মিনিট পর্যন্ত তাদের আক্রমণ প্রতিহিত করেই গেছে আমাদের। তারপর মারিও জাগালো গোল করলো। আর, পেলের কাছে বল গেলে সেটা হয়ে উঠতো এক অসম প্রতিযোগিতা। সে গোলও পেয়ে যায় কিছুক্ষণ পরেই। ম্যাচ তাতেই শেষ হয়ে যায়। পেলের সাথে একসাথে খেলতে পেরে আমি সম্মানিত।

১৯৭০ বিশ্বকাপ:

তারচিসিও বারনিচকে বিবেচনা করা হয় ইতালির সর্বকালের অন্যতম সেরা ডিফেন্ডার হিসেবে। জাতীয় দলের হয়ে ৬৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচের সাথে ৩টি বিশ্বকাপও খেলেছেন তিনি। ১৯৭০ সালের বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের বিরুদ্ধে ইতালির ৪-১ গোলে হেরে যাওয়া ম্যাচেও তিনি ছিলেন মাঠে। বারনিচের বিপক্ষে হেডারে গোল করেছিলেন পেলে। ম্যাচটি নিয়েই ছিল বারনিচের বিখ্যাত সেই কথা, ম্যাচের আগে নিজেকে বুঝিয়েছিলাম, পেলেও রক্ত-মাংসেরই মানুষ। কিন্তু আমার এই ধারণাটাই ভুল!

তারচিসিও বারনিচ আরও বলেন, ১৯৭০ সালকে কে ভুলতে পারে? ফাইনালের আগে আমাদের দলের ভারসাম্য ভালো ছিল না। কারণ, জার্মানি বিপক্ষে ম্যাচের ঘোর আর ক্লান্তি থেকেই আমরা বের হতে পারছিলাম না (সেমিফাইনালে জার্মানির বিপক্ষে অতিরিক্ত সময়ে ইতালির ৪-৩ গোলের জয় পাওয়া ম্যাচটিকে বিশ্বকাপের অন্যতম সেরা দ্বৈরথ হিসেবেও বিবেচনা করা হয়)। ফাইনালের আগের সকালে কোচ ফেরুচ্চিও ভালকারেজ্জি আমাকে জিজ্ঞেস করলেন, কেমন বোধ করছো? আমার জবাব ছিল, ‘আমার কোনো পা নেই।

তারচিসিও বারনিচ বলেন, পেলেকে খেলার বাইরে রাখার জন্য অনেক পরিকল্পনাই করা হয়েছিল। তাদের স্কোয়াডের সবার দিকেই আমরা মনোযোগ দিয়েছি। সমস্ত বিশদ ও ক্ষুদ্র পরিকল্পনা, প্রতিটি পদক্ষেপ- সবকিছু নিয়েই ভেবেছি। তবে, পেলেকে কীভাবে মার্ক করা হবে, তা নিয়ে কিছুটা সংশয় রয়ে গিয়েছিল। সমস্যা হচ্ছে, সে মিডফিল্ডেও চলে আসতো। আর সে সময় পেলেকে মার্কিংয়ের দায়িত্ব ছিল মারিও বার্তিনির উপর। আর যখন উপরে এসে খেলতো, পেলেকে ঠেকানোর দায়িত্ব ছিল আমার। কিন্তু, পেলে ছিল দারুণ বুদ্ধিমান। যখন আমি তার কাছে হাজির হতাম, সে মিডফিল্ডে চলে যেতো বল নিয়ে আসতে। এ কারণে, পরিকল্পনায় বদল আনতে হয়েছিল আমাদের।

তারচিসিও বারনিচ আরও বলেন, নিউইয়র্কে পেলের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকবারই খেলেছি। আমি যা হাত দিয়ে করতে পারতাম, সেটাই সে করতো পা দিয়ে! একটা খেলোয়াড়ের মধ্যে পুরো বিশ্বব্রহ্মাণ্ডই এঁটে গেলে, সেটা পেলে। তার গতি, তার হেডার, তার পা, হোক সেটা ডান বা বাম পা; মারণ আঘাত হানার কোনো না কোনো উপায় ঠিক বের করে ফেলতো পেলে। আমার কাছে, পেলেই সেরা ফুটবলার। অসামান্য এক অ্যাথলেট ও ফুটবলারের বাইরে মানুষ হিসেবেও দারুণ। তার সবই ছিল। চ্যাম্পিয়ন হওয়ার সক্ষমতা, নিখুঁত শরীর, পেশাদারিত্ব- তার ছিল সবকিছু।

আরও পড়ুন: যুক্তির সীমা অতিক্রম করা একমাত্র ফুটবলার পেলে; কিংবদন্তিদের চোখে ফুটবলের রাজা

/এম ই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply