বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে এক হাজারের মধ্যেও দেশের বিশ্ববিদ্যালয় না থাকায় রাষ্ট্রপতির ক্ষোভ

|

বিশ্ব র‍্যাঙ্কিংয়ে প্রথম ১০০০ এর মধ্যেও বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর অস্তিত্ব খুঁজে না পাওয়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিদায়ী রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। বললেন, সনদসর্বস্ব শিক্ষা দিয়ে দেশ ও দশের উন্নয়ন সম্ভব না। প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার সাথে বাস্তব জীবনের যোগসূত্র স্থাপন করতে পারলে তবেই সেই শিক্ষা সফল হয়েছে বলা যায়।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) ‘ষষ্ঠ সমাবর্তন-২০২৩’ অনুষ্ঠানে দেয়া বক্তব্যে হতাশা প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ববিদ্যালয়সমূহের আচার্য আবদুল হামিদ।

বক্তব্যের শুরুতে তিনি বলেন, প্রিয় গ্র্যাজুয়েট বৃন্দ, আমার গলাটা বসে আছে কিন্তু। আগেই বলেছি। সুতরাং বক্তৃতা দিতে কিছু সময় লাগবে। অনেকদিন পর এসেছি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই ২০১৫ সালে এসেছিলাম। উনারা আমাকে আনেন নাই। আমি কী করবো। খুব সম্ভবত, এটা আমার শেষ সমাবর্তন বক্তব্য। আর কদিন পরেই আমার সময় শেষ। জানি না আরও কোথাও যাওয়া হবে কিনা।

আবদুল হামিদ বলেন, আমাদের লক্ষ্য একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করা। এ লক্ষ্য অর্জনে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নিজেদের শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। প্রযুক্তি ক্ষেত্রে স্বনির্ভরতা অর্জন করতে হবে। এজন্য সংশ্লিষ্ট ক্ষেত্রে গবেষণা প্রয়োজন। আমাদের তরুণরা যথেষ্ট মেধাবী। নানা প্রতিকূলতা অতিক্রম করে বিশ্বের নানা প্রান্তে তারা তাদের সক্ষমতা প্রমাণ দিয়ে যাচ্ছে। এসব তরুণদের যথাযথ পরিচর্যার জন্য আমাদের প্রতিটি বিশ্ববিদ্যালয়কে বিশ্বমানের করে গড়ে তুলতে হবে।

পরিবেশ, প্রতিবেশ, সমাজ ও সংস্কৃতির শিক্ষা নিয়ে মানুষ বেড়ে উঠে উল্লেখ করে রাষ্ট্রপতি বলেন, এসবের আশপাশের সবকিছুকে ভালোবাসার মধ্য দিয়ে মানুষের অন্তর্গত মনুষ্যত্ব ও মূল্যবোধের বিকাশ ঘটে। আমি আশা করি, তোমরা কর্মক্ষেত্র, সমাজ ও সংসারে ন্যায়-নীতি ও যুক্তির চর্চা করবে। আমাদের সকলেরই পরিমিত, সহিঞ্চু, পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সংবেদনশীল হওয়া জরুরি। এসবের মধ্য দিয়ে সমাজ এগিয়ে যায়। প্রথাগত রীতি-নীতির পাশাপাশি সংস্কারমূলক চিন্তা করতে হবে। পরিমিত, পরিশীলিত আচার-আচরণ এবং নিজের ব্যক্তিত্বকে ফুটিয়ে তুলতে হবে। তোমাদের এ অবদানের পেছনে বাবা-মা, শিক্ষক, দেশ ও দেশের মানুষের ভূমিকা রয়েছে। তাই জাতির কল্যাণে তোমাদের ভূমিকা রাখতে হবে। জগৎ সংসার ও কর্মক্ষেত্রে বাধা-বিপত্তি আসতে পারে। এ অচল অবস্থা দূর করতে সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত নিতে নিজেকে প্রস্তুত রাখতে হবে।

সমাবর্তন বক্তৃতায় আবদুল হামিদ বলেন, তোমরাই আগামী দিনের ভবিষ্যৎ। তোমাদের মধ্যে কেউ রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী, শিল্পপতি, আইনজীবী, আমলা হবে। মনে রাখতে হবে, তোমাদের সমন্বিত উদ্যোগেই দেশ এগিয়ে যায়। এর ব্যত্যয় দেশ ও জাতির জন্য বয়ে আনে বিপদ। দখলবাজি আর চাঁদাবাজির কারণে ছাত্ররাজনীতিকে এখন আর মানুষ আগের মতো সম্মানের চোখে না দেখে, নেতিবাচকভাবে দেখে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাও ব্যবসা শুরু করেই নীতি-নৈতিকতাকে বাদ দিয়ে কীভাবে শুধু নিজে বড়লোক হতে পারবে সেই চিন্তাভাবনায় ব্যস্ত থাকেন। বড় বড় ব্যবসায়ী শিল্পপতিরাই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপী হন। খেলাপি ঋণের এক শতাংশের জন্যও সাধারণ মানুষ দায়ী নয়। বড় বড় ব্যবসায়ী-শিল্পপতিরাই বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান থেকে ঋণ নিয়ে স্বেচ্ছায় ঋণখেলাপি হন। তারা ঋণ নেন-ই না দেয়ার জন্য। অবশ্য এর সাথে একশ্রেণির ব্যাংকাদেরও যোগসাজস থাকে।

চাকরিজীবীদের উদ্দেশে তিনি বলেন, চাকরিতে ঢুকেই কীভাবে গাড়ি-বাড়ির মালিক হওয়া যায় সেই চিন্তায় বিভোর থাকেন অনেকে। নিজের ক্ষুদ্র স্বার্থের জন্য অনেক সময় দেশ ও জাতির বড় স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিতেও পিছপা হন না। দেশকে জাতির পিতা স্বপ্নের সুখী ও সমৃদ্ধ সোনার বাংলা গড়তে এবং একটি উন্নত ও স্মার্ট বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠা করার লক্ষ্য রাষ্ট্রের বিবেকবান নাগরিক হিসেবে স্নাতকরা তাদের মেধাশক্তি ও মানবিকতা দিয়ে কাজ করবেন বলে বিশ্ববিদ্যালয় আচার্য আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষসহ সংশ্লিষ্ট সকলকে সচেতন থাকার আহ্বান জানিয়েছেন। বলেন, দুর্নীতি আমাদের উন্নয়ন ও অগ্রগতির পথে অন্যতম বড় অন্তরায়। তাই দুর্নীতির বিরুদ্ধে সকলকে সচেতন থাকতে হবে।

রাষ্ট্রপতি আরও বলেন, ইদানিংকালে পত্রপত্রিকা খুললেই দেখা যায় বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়োগ বাণিজ্য ও টেন্ডারবাজির নেতিবাচক খবর। নিজেদেরকে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতির ঊর্ধ্বে রাখবেন। শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দলীয় লেজুড়বৃত্তির ঊর্ধ্বে উঠে রাজনীতি করারও আহ্বান জানান।

গণমাধ্যমকর্মীদের উদ্দেশে রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, এখানে মিডিয়ার ভাই-বোনেরা আছেন। আপনারা কাউকে আকাশে তুলেন, আবার কাউকে মাঠিতে নামান। কিছুদিন আগে বঙ্গভবনে আমার একটি বইয়ের মোড়ক উন্মোচন করা হয়। সেখানে আমি, প্রধানমন্ত্রী, আমার স্ত্রীসহ আরও অনেকে বক্তব্য রাখেন। আপনারা লিখলেন, ফার্স্ট লেডি ফার্স্ট। মানে আমার স্ত্রীর ব্ক্তব্য সেরা হয়েছে। অথচ, আমি নিজে নিয়মিত বক্তৃতা দিই। প্রধানমন্ত্রীও দিনে একাধিক বক্তব্য রাখেন। অথচ আমার সাথে তার ৬০ বছরের সংসার জীবনে ৬০টাও বক্তব্য দেয় নাই সে। আর তার বক্তব্য নাকি ফার্স্ট। কাউকে হাইলাইট করা আর অন্যদের অবজ্ঞা করা কী ঠিক? মিডিয়ার ভাইয়ারা এটা বুঝে নিয়েন।

এবারের সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারী মোট ১৫ হাজার ২১৯ জন শিক্ষার্থীর মধ্যে স্নাতক ও স্নাতকোত্তর শ্রেণিতে তিনটি ক্যাটাগরিতে ১৬ জন শিক্ষার্থীকে স্বর্ণপদক দেন রাষ্ট্রপতি। তাদের মধ্যে নিয়মিত স্নাতক ও স্নাতকোত্তর সম্পন্নকারী ১১ হাজার ৪৪৪ জন, উইকেন্ড প্রোগ্রামের ৩ হাজার ৪৬১ জন, এমফিল ডিগ্রির ৩৪ জন এবং পিএইচডি সম্পন্নকারী ২৮০ জন।

/এমএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply