পিনাক-৬ ডুবির ৪ বছর: বিচার না হওয়ায় নিহতদের পরিবারে ক্ষোভ

|

প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, মাদারীপুর:

ভয়াবহ নৌ দুর্ঘটনা পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবিতে সরকারি হিসেবে ৪৯জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার ও ৫৩জন নিখোঁজ হলেও চার বছরেও বিচার সম্পন্ন হয়নি। বিচার না হওয়ায় এ দুর্ঘটনায় জড়িত সন্দেহে করা ২টি মামলার আসামিরা রয়েছেন জামিনে।

দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজ স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেছে। এমনকি মামলার বাদী তৎকালীন বিআইডাব্লিউটিএ’র টার্মিনাল ইন্সপেক্টর জাহাঙ্গীর হোসেনও মামলার সর্বশেষ অগ্রগতি জানাতে পারেননি।

নিহতদের মধ্যে অনেকেই স্বপরিবারেও নিখোঁজ রয়েছে। লঞ্চটিতে উঠার আগে স্বর্না, হিরাসহ তিন বোনের সেলফিই এখন পরিবারের একমাত্র সম্বল। একই উপজেলার ফরহাদের পরিবারের পরিণতি আরও ভয়াবহ। ফরহাদসহ পরিবারের চার জনের কারোরই লাশ পাওয়া যায়নি। নেই কোন স্মৃতির ছবিও। ছেলে মিজানুর, বৌসহ পরিবারের চারজনকে হারিয়ে বৃদ্ধা মা রিজিয়া বেগম আজও মূর্ছা যান।

নিখোঁজ অর্ধ শতাধিক পরিবারের কাউকেই দেয়া হয়নি কোন অনুদানও। আর অজ্ঞাত হিসাবে ২১ জনের লাশ দাফন হলেও ডিএনএ সংগ্রহ করে নমুনাতেই রয়ে গেছে, মেলেনি পরিচয়। সন্ধান মেলেনি লঞ্চটিরও।

সরেজমিন একাধিক সূত্রে জানা যায়, ২০১৪ সালে ঈদুল ফিতরের পর ৪ আগস্ট ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত আড়াই শতাধিক যাত্রী নিয়ে কাওড়াকান্দি ঘাট থেকে পিনাক-৬ লঞ্চটি উত্তাল ঢেউয়ের কবলে পড়ে মাওয়ার অংশে ডুবে যায়। সরকারি হিসাবে ওই ঘটনায় ৪৯ জন যাত্রীর লাশ উদ্ধার করা হয়। নিখোঁজ থাকে ৫৩ জন।

এ দুঘর্টনার পরপরই মুন্সিগঞ্জের লৌহজং থানা ও মেরিন কোর্টে ২টি মামলা হয়। আসামি লঞ্চ মালিক কালু খান ও তার ছেলে গ্রেফতার হলেও বর্তমানে জামিনে রয়েছেন। তবে ৪ বছর অতিবাহিত হলেও দোষীদের বিচার না হওয়ায় নিহত ও নিখোঁজদের স্বজনদের মাঝে তীব্র ক্ষোভ রয়েছে। এ দুর্ঘটনায় উদ্ধারকৃত ৪৯টি লাশের মধ্যে ২৮টি লাশ পরিবারকে বুঝিয়ে দেয়া হয় আর ২১ জনকে জেলার শিবচর পৌরকবর স্থানে বেওয়ারিশ হিসেবে দাফন করা হয়।

সরকারি হিসেবেই নিখোঁজ থাকে আরও ৫৩ জন। তবে বেসরকারী হিসেবে অন্তত শতাধিক যাত্রী নিখোঁজ রয়েছে। যে সকল পরিবারে এখনও স্বজনরা নিখোঁজ রয়েছেন তাদের ভাগ্যে জোটেনি কোন সরকারি অনুদান। যদিও ২৮জন পরিচয়ধারী নিহতদের তাৎক্ষণিকভাবে ২০ হাজার টাকা করে এবং পরিবর্তিতে ঘোষিত ১ লাখ ৫ হাজার টাকা করে অনুদান দেয়া হয়।

উপার্জনক্ষম ব্যক্তি হারিয়ে অনেক অসহায় পরিবারকে কাটাতে হচ্ছে মানবেতর জীবন যাপন। গত ৪ বছরেও কেউই তাদের খোঁজ নেয়নি। এতে ক্ষোভের অন্ত নেই স্বজন হারা পরিবারগুলোতে।

ঘটনার পর লৌহজং ও শিবচরে স্থাপন করা হয় অভিযোগ ও তথ্য কেন্দ্র। এ ঘটনার পরপরই নৌপরিবহন মন্ত্রনালয় ও সমুদ্র পরিবহন অধিদপ্তর ৭ সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটিও গঠন করে।

নিহত হিরা ও স্বর্নার বাবা নূরুল ইসলাম মিয়া বলেন, ‘লঞ্চের মালিকসহ ঘাট সংশ্লিষ্টদের অবহেলার কারণে লঞ্চটি ডুবে যায়। আমার মেয়েসহ অনেক যাত্রী নিহত ও নিখোঁজ হয়। এ ঘটনার চার বছরেও দোষীদের কোন বিচার হলো না। গ্রেফতার হলেও তারা জামিনে ঘুরে বেড়াচ্ছে।’

মামলার বাদী বিআইডাব্লিউটিএ’র মাওয়া ঘাটের তৎকালীন পরিবহন পরিদর্শক জাহাঙ্গীর হোসেন বলেন, ‘এ ঘটনায় দুটি মামলা হয়েছে। আমার জানামতে চার্জশীট হয়েছে। মামলা আদালতে চলমান থাকায় মেরিন কোর্টের মামলা স্থগিত রয়েছে। মামলায় পুলিশ ২জন আসামি পরিবর্তন করেছে। আমি ২বার হাজিরাও দিয়েছি। তবে বর্তমানে মামলাটি কোন পর্যায়ে রয়েছে তা আমার সঠিক জানা নেই।’

বিআইডাব্লিউটিএ’র কাঁঠালবাড়ি ঘাট পরিদর্শক আক্তার হোসেন বলেন, ‘পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবির পর এই নৌরুটে ব্যাপক পরিবর্তন হয়েছে। আগে একজন পরিবহন পরিদর্শক তিনটি ঘাটের দায়িত্ব পালন করতো। পিনাক দুর্ঘটনার পরে প্রতিটি ঘাটে একজন করে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়াসহ অনেক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।’

শিবচর পৌরসভার মেয়র আওলাদ হোসেন খান বলেন, ‘অজ্ঞাত ২১ জনের লাশ পৌর কবরস্থানে দাফন করা হয়। এ লাশগুলোর ডিএনএ নমুনা সংরক্ষণ করা হয়েছে। পুলিশের মাধ্যমে ডিএনএ শনাক্ত করে যদি কেউ আসে তবে পরিবারের কাছে তাদের লাশ হস্তান্তর করা হবে।’

মাদারীপুর জেলা প্রশাসক ওয়াহিদুল ইসলাম বলেন, ‘পিনাক-৬ লঞ্চ ডুবিতে অনেকে প্রাণ হারিয়েছেন। অনেকে নিখোঁজ রয়েছেন। তবে এ দুর্ঘটনার পর থেকে এই নৌরুটে প্রশাসনের পক্ষ থেকে কঠোর নজরদারী রাখা হচ্ছে। এমন দুর্ঘটনা যাতে আর না ঘটে তার জন্য লঞ্চের চালকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। ঘাট ব্যবস্থাপনার উন্নয়নও করা হয়েছে। কোনভাবেই লঞ্চে ধারণ ক্ষমতার অতিরিক্ত যাত্রী বহন করতে দেওয়া হচ্ছে না। কেউ আইন অমান্য করলে সাথে সাথে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।’

যমুনা অনলাইন: কেআর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply