বৈরী বার্বাডোসে গিলক্রিস্ট ম্যাজিক, অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ জয়

|

মেহেদী হাসান রোমান

২০ জুন, ১৯৯৯। এরপর অস্ট্রেলিয়া একটি জিনিস ভুলে গেলো। সেটি হলো বিশ্বকাপে কিভাবে ম্যাচ হারতে হয়। এরপরের এক যুগে অস্ট্রেলিয়া যে টানা তিন বিশ্বকাপ জিতেছে তা নয়। উপমহাদেশকে হ্যাটট্রিক কান্না করিয়েছে অজিরা। ১৯৯৯ সালে পাকিস্তান, ২০০৩ সালে ভারত আর ২০০৭ শ্রীলঙ্কা। দক্ষিণ এশিয়ার তিন দেশকে টানা তিন বিশ্বকাপের ফাইনালে হারিয়েছিলো স্টিভ ওয়াহর উত্তরসূরিরা। অনেকটা ২০০৬ থেকে ২০১৪ টানা তিন ফিফা বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনাকে যেভাবে কাঁদিয়েছিল জার্মানি, অনেকটা সেরকম। পার্থক্য হলো আর্জেন্টিনা একটি দেশ ও দক্ষিণ এশিয়া একটি সাবকন্টিনেন্ট।

রিকি পন্টিংয়ের দল সেবার ক্যারিবীয় দ্বীপপুঞ্জে গিয়েছিলো আরও এক মিশনে। ব্রায়ান লারার দল গ্রুপ পর্বে সবগুলো ম্যাচ জিতলো। সুপার এইটে কুফা শুরু হলো অস্ট্রেলিয়ার সাথে হার দিয়ে। লারার নিজের দেশের মাটিতে সেবার বাংলাদেশ সবগুলো গ্রুপ পর্বের ম্যাচ খেলেছিলো, বি গ্রুপের ম্যাচগুলো হয়েছিলো কুইন্স পার্ক ওভাল, ত্রিনিদাদে। সেই লারার শেষ বিশ্বকাপেও বিবর্ণের শুরুটা দেখিয়েছিলো অস্ট্রেলিয়া।

দ্য ফিনালে স্টার্ট।

এবার ফাইনালের গল্প শুরু করি। হাতের ভেতর স্কোয়াশ বল রাখা গিলক্রিস্ট বার্বাডোসের কেনসিংটন ওভালে যে টর্নেডো তুলেছিলেন সেটি ৩৮ ওভারের ম্যাচের জন্য যথেষ্ট নয় বরং বাড়াবাড়িই ছিলো। ১৪৯ রানের প্রতিটা শট যেভাবে জয়াবর্ধনের দলের ফিল্ডারদের খাটিয়েছিলো তা গিলক্রিস্ট তার অটোবায়গ্রাফিতে লিখবেন বোধহয়। বৈরী আবহাওয়া শুরুতেই ১২ ওভার কমিয়ে দিলো ফাইনালের। ১৭২ রানের ওপেনিং জুটি ভেঙে ম্যাথু হেইডেন যখন আউট হলেন, তখন তার রান মাত্র ৩৮। পন্টিংয়ের ব্যাট সেদিন সৌরভ গাঙ্গুলির দলের বিপক্ষে জোহানেসবার্গ ফাইনালের মতো হাসেনি। সাইমন্ড কিংবা তখনকার তরুণ ওয়াটসন-ক্লার্ক সবাইকে ছাপিয়ে অজি ইনিংসের টপ পারফর্মার গিলক্রিস্ট। আগেই ঘোষণা দিয়েছিলেন সেটি হতে যাচ্ছে তার শেষ বিশ্বকাপ ম্যাচ। এরচেয়ে বর্ণিল শেষ কি হয়?

দুর্দান্ত গিলক্রিস্ট ১৪৯ (১০৪)

আবহাওয়া বাধ সাজলো জয়াবর্ধনের দলের। শ্রীলঙ্কার ফাইনাল কুফাটা সেদিন থেকেই শুরু। এরপর ২০০৯ বিশ্ব টি-টোয়েন্টি, ২০১১ বিশ্বকাপ, দেশের মাটিতে ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনাল হেরেছিলো দ্বীপরাষ্ট্রটি। অস্ট্রেলিয়ার হ্যাটট্রিক বিশ্বকাপ যেখানে শেষ হয় শ্রীলঙ্কার হ্যাটট্রিক ফাইনাল হারের গল্প সেখান থেকেই শুরু। এই ফাইনাল হারের জুজু অবশ্য বিদায় নেয় ঢাকায়, ২০১৪ সালে।

বার্বাডোসের অন্ধকার আকাশ, সেই বিশ্বকাপে একটাও দিবারাত্রীর ম্যাচ ছিলো না। এর কারণ হতে পারে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মাঠগুলোতে ফ্লাডলাইট না থাকা। তাই ফাইনালের দিন স্টেডিয়ামে অনেকটা সূর্যগ্রহণ দেখতে হয়েছিলো ২০ হাজার ১০৮ জন দর্শকদের, যারা এসেছিলেন কেনসিংটন ওভালে।

লঙ্কান ইনিংসের শেষ আর শুরু এরকমই।

৩৮ ওভারে লঙ্কানদের টার্গেট দাঁড়ায় ২৮২ রান। নাথান ব্র্যাকেন থারাঙ্গাকে ফিরিয়ে শুরু করলেও সাঙ্গাকারা-জয়াসুরিয়ার ১১৬ রানের জুটি কলম্বো, গল কিংবা ক্যান্ডির কোনো বালকের মনে ভালোলাগার হরমোন প্রবাহিত করছিলো। সেই জুটি যতক্ষণ ছিলো অর্জুনা রানাতুঙ্গাও ভাবছিলেন হয় এবার আরেকটা আসছে। কিন্তু না। লঙ্কায় আর শিরোপা যায় নি। একমাত্র শন টেইট ছাড়া সবাই যেনো সুষমভাবে শ্রীলঙ্কাকে চেপে ধরেছিলো সেদিন। সে ছাড়া সব অজি বোলার উইকেট পেয়েছিলো সেদিন।

ফাইনালের ফাইনাল ড্রামা শুরু হয় শ্রীলঙ্কার ব্যাটিংয়ের ২৪ তম ওভারে। বৃষ্টি এবং অন্ধকারে ছেয়ে যায় বার্বাডোসের আকাশ। খেলা বন্ধ থাকে কিছুক্ষণ। শ্রীলঙ্কা হারায় ২ ওভার, সেইসাথে নতুন টার্গেট ৩৬ ওভারে ২৬৯। ৩৩ ওভারের পর আবহাওয়া তার দ্বিতীয় ক্লাইম্যাক্স দেখায় আরেকবার দুদলকেই মাঠের বাইরে বের করে দিয়ে। একবার ডিএল মেথডে রেজাল্ট পাবলিশডও হয়। সেটি আবার বাতিল হয়, আবার নামে লঙ্কান ব্যাটাররা। কিন্তু কেনসিংটনের অন্ধকারে শ্রীলঙ্কার স্বপ্নভঙ্গ হয়। আটলান্টিকে সলিল সমাধি ঘটে বিশ্বকাপ জয়ের। এরপর মুম্বাইতেও একই ঘটনা ঘটে বছর চারেক পর।

টানা তিন।

টুর্নামেন্ট শেষ হবার পর শ্রীলঙ্কা সেই ম্যাচ নিয়ে তাদের অসন্তোষের কথা জানায় আইসিসিকে । গিলক্রিস্টের হাতের ভেতর রাখা স্কোয়াশ বল, রিজার্ভ ডে না রাখা কিংবা বৈরী আবহাওয়ায় খেলতে বাধ্য করা।

নবম বিশ্বকাপের পর্দা নেমেছিলো ২০০৭ সালের এই দিনে। সেই বিশ্বকাপে বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড চমক দেখিয়েছিলো। ভারত-পাকিস্তানের বিদায় কিংবা বব উলমারের মৃত্যু, অন্ধকারচ্ছন্ন ফাইনাল। কিন্তু দিনশেষে অজি রুপকথার টানা তৃতীয় বিশ্বকাপ জয়, ম্যাকগ্রার অতিমানবীয় পারফরম্যান্স, রিকির দলের অপরাজিত-অপ্রতিরোধ্য তকমা ক্রিকেট ইতিহাসে কম কিসের। রিকির যুগের সেই অস্ট্রেলিয়া কি ‘অস্ট্রেলিয়ারই সর্বকালের সেরা অস্ট্রেলিয়া’ কি না-এটিও প্রশ্ন।

এই ফ্রেম অনেক দামি।

সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply