লাপাতা লেডিস: মিষ্টি প্রেমের মোড়কে নারীর বঞ্চনার গল্প

|

আল মাহফুজ

২০০১ সাল। প্রত্যন্ত গ্রাম নির্মল প্রদেশ। ভিড়ে ঠাসা একটা ট্রেনের কামরা। ভেতরে কয়েক জোড়া সদ্য বিবাহিত দম্পতি। সব নববধূর গায়ে জড়ানো লাল শাড়ি, বিয়ের অলংকার। ঘোমটা টানা কনেদের আলাদা করা যায় না। দেখে সবাইকে একই রকম লাগে। নিজের স্বামী ছাড়া অন্য পুরুষকে মুখ না দেখানোই এখানকার ‘নিয়ম’। তাই বিভ্রান্তি ঘটে। ভুল করে ভুল কনের হাত ধরে ট্রেন থেকে নেমে যায় এক বর (দীপক)। দর্শক দেখে– এক কনে (জয়া) পরপুরুষের সঙ্গে রওনা দেয় অজানা এক গ্রামে, আর অন্য কনের (ফুল কুমারী) গন্তব্য হয় অজ্ঞাত স্টেশনে। দুই কনের হারিয়ে যাওয়ার গল্প নিয়েই ‘লাপাতা লেডিস’ সিনেমার যাত্রা।

হরিয়ানা, উত্তরাখন্ডসহ ভারতের অনেক অঞ্চলে মুখ আবৃত করে রাখার সামাজিক রেওয়াজ আছে। এই ঘোমটা দিতে হয় শুধু কি তাদের মুখ ঢাকতে? নাকি অস্তিত্বহীনতার সিঁদ কাটতে? সেখানে বিবাহিত নারীদের স্বামীর নাম মুখে আনা বারণ। যেন স্বামীর নাম উচ্চারণ করলে তাদের সম্ভ্রমহানি হবে! এ এক অন্য বাস্তবতার দুনিয়া! যেখানে সরল নারীদের খাঁচার ভেতর আটকে থাকাকেই জীবনের সার্থকতা মনে করা হয়। কেউ খাঁচার বাইরে বেরোতে চাইলে তাকেও টেনে হিঁচড়ে খাঁচায় পোষ মানানোর আয়োজন করা হয়।

‘লাপাতা লেডিস’ প্রসঙ্গে আসা যাক। এই সিনেমায় সমাজ বা সমাজবদ্ধ মানুষের প্রতি অনেকগুলো প্রশ্ন ছুড়ে দেয়া হয়েছে। শুধু ভারতেই নয়, এই উপমহাদেশের পুরুষ শাসিত বহু অঞ্চলে নারীদের শিক্ষা বা সামাজিক অধিকার, এমনকি মানবাধিকারও অনুপস্থিত। এসব অধিকার একজন ব্যক্তির প্রাপ্য। কিন্তু অজস্র নারীদের এই অধিকার ভোগ করতে কঠিন লড়াইয়ে নামতে হয়। একারণে, বহু নারীকেই যেতে হয়েছে নিদারুণ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে। এখনও যেতে হয়। কেউ কেউ এই প্রতিকূল স্রোত সাঁতরাতে সাঁতরাতে পা হড়কায়। তেমনই এক পা হড়কানো গল্পের অবতারণা করেছেন কিরণ রাও, তার ছবি লাপাতা লেডিসে। তবে সেটা মোলায়েমভাবে, উইটি বজায় রেখে। যত্নের সঙ্গেই তাদের গল্প তুলে ধরেছেন পরিচালক। তাই এই ছবি কখনও হাসাবে, কখনও কাঁদাবে। কখনও আপনার চিন্তা উদ্রেক করবে।

লাপাতা লেডিসে কিছু দৃশ্য রয়েছে, যেগুলো আয়রনিক সংলাপের জোরে হয়েছে একইসঙ্গে হিউমারাস, আবার ভাবনার খোরাক জোগানো। দুয়েকটা উদাহরণ দেয়া যাক– ফুল কুমারীকে খুঁজে পেতে এক দোকানিকে ছবি দেখানো হলে সে বলে, ‘মুখ দেখেই তো একজন মানুষকে চেনা যায়। মুখ ঢাকা মানে তো নিজের আইডেন্টিটি ঢাকা!’ এর পরপরই বোরখা-নেকাব পরিহিত তার অর্ধাঙ্গিনীর স্ক্রিনে আবির্ভাব!

‘লাপাতা লেডিস’ সিনেমার আয়রনিক দৃশ্য। ছবি: ফেসবুক

পুলিশ অফিসারটি (মনোহর) জয়ার ব্যাপারে তার সহকারীকে বলে, ‘এই মেয়েটা অনেক দূর যাবে’। তখন সহকারী বলে ওঠে, হ্যাঁ স্যার, মেয়েটা অনেক কিলোমিটার দূরে যাবে! এমন আরেকটি দৃশ্যের কথা বলা যায়– জয়া দীপকের মাকে নিজের পছন্দের খাবার রান্না না করা প্রসঙ্গে জিজ্ঞেস করে। তখন মা হাসতে হাসতে বলেন, পরিবারের পুরুষের পছন্দ অনুযায়ী হেঁসেল ঠেলতে ঠেলতে নিজের পছন্দ-অপছন্দই সেই কবে-ই ভুলে গেছে! আহা.. দীপকের মা এই সংলাপ বলেন হাসতে হাসতে। অথচ আমাদের কান্না পায়। আমাদের মায়েদেরও বুঝি এই দশা। নিজের পছন্দের খাবারের কথা তারা হয়তো ভুলে যান। অনেক অনেক বছর নিজের স্বপ্নসাধ চেপে রাখেন। চেপে রাখতে রাখতে হয়তো সেসব ভুলে যান সচেতনভাবেই। মনে পড়ে যায়—
‘আমরা ছোট ছিলাম, কিন্তু বছর বছর বড় হতে থাকি,
আমাদের মা বড় ছিল, কিন্তু বছর বছর মা ছোটো হতে থাকে..।

হারিয়ে যাওয়া দুই নারীর গল্প লিখেছেন বিপ্লব গোস্বামী। স্ক্রিপ্টে ছিলেন স্নেহা দেশাই। রসবোধসম্পন্ন অ্যাডিশনাল সংলাপ লেখা দিব্যনিধি শর্মার। ছবির গল্প উপস্থাপিত হয়েছে ‘মাল্টিপাল ন্যারেটিভ’-এ। বিখ্যাত ফিল্মমেকার আলেহান্দ্রো ইনারিতু এই টেকনিকে বেশ সফল। হংকংয়ের ওং কার-ওয়াইও এক্ষেত্রে দারুণ হাত পাকিয়েছেন। ‘ধোবি ঘাট’-এও এই কাঠামোটি হয়ে উঠেছিল ভীষণ অর্থপূর্ণ। সেটা ছিল বাস্তবতার খুব কাছে এবং সিনেমার তৃতীয় অঙ্কে ধরে রেখেছিল উত্তেজনার লাগামও। তবে এই অনুষঙ্গে লাপাতা লেডিস উৎরাতে পারেনি। অনেক জায়গায় সংলাপ আরোপিত লেগেছে। সিনেমাটা কিছু ক্ষেত্রে ‘শিক্ষামূলক’ হয়েছে। নির্ঝরের মতো বলি– বস্তুসাপেক্ষে নিখাদ কল্পনা আর ম্যাজিককে ঠিকঠাক প্রকট করতে পারলেই শিল্প হয়ে যায়। এই ছবিতে সেটার খামতি ছিল।

লাপাতা লেডিসের গানগুলো শ্রুতিমধুর। নন্দিত শিল্পী শ্রেয়া ঘোষালের কণ্ঠে একটা গান আছে– ‘ধীমে ধীমে চালে পুরবাইয়া’। বারবার শোনার মতো অনিন্দ্য সুন্দর। তবে লক্ষণীয় বিষয়, ২৬৪ মিলিয়ন সাবস্ক্রাইবারের চ্যানেলটিতে এই গানের ভিউ এক লাখ ছুঁতে পারেনি। তবে হ্যাঁ, সুন্দর সৃষ্টি বা শিল্পের বিচার্যে ভিউ বা হিটই শেষ কথা নয়। আরেকটি গান রয়েছে, অরিজিৎ সিং-এর গাওয়া ‘ও সাজনি রে’। সেটাও অতি চমৎকার! কানে বা মনে লেগে থাকার মতো।

‘লাপাতা লেডিস’-এর একটি দৃশ্য। প্রধান দুই চরিত্র। ছবি: আইএমডিবি

ছবির গল্প গাঁথা হয়েছে মূলত তিন চরিত্র ঘিরে। প্রধান এই চরিত্রগুলোতে অভিনয় করেছেন স্পর্শ শ্রীবাস্তব (দীপক কুমার), প্রতিভা রাংটার (জয়া) এবং নীতাংশি গোয়েল (ফুল কুমারী)। তারা জুতসই ছিলেন, ক্যারেক্টারের প্রতি ইনসাফ করেছেন। একারণে বাহবা পেতে পারেন কাস্টিং ডিরেক্টর। তবে নজর কেড়েছে ছায়া কদমের অভিনয় (স্টেশনের বৃদ্ধা)। ছবিটা যদিও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অসংগতিকে ব্যঙ্গ করে, তবে রেলস্টেশনের ‘আম্মা’র সংলাপগুলো ছবিটার বার্তা আরও পোক্ত করে নিঃসন্দেহে।

‘লাপাতা লেডিস’-এর সেরা প্রাপ্তি রবি কিষাণের অভিনয়। থানার ঘুষখোর বড় বাবু শ্যাম মনোহরের চরিত্রে তিনি জীবনের সেরা অভিনয়টাই করলেন কি? এর আগে তার সিনেমা দেখা হয়েছে। কিন্তু মনে দাগ টানার মতো কোনো কাজ আমার চোখে পড়েনি। তার চরিত্রটি কিছুটা গ্রে শেডের। মানে সাদা নয়, কালোও নয়, মাঝামাঝি কিছু একটা। যেমনটা ‘দাবাং’-এর চুলবুল পাণ্ডে অথবা ‘মহানগর’-এর ওসি হারুনের মাঝে দেখা যায়।

বলাই বাহুল্য, এই পুলিশ অফিসারের চরিত্রটি প্রথমে করতে চেয়েছিলেন আমির খান। যিনি লাপাতা লেডিসের প্রযোজক। অনেকেই জানেন, কিরণ রাও আমির খানের প্রাক্তন স্ত্রী। পরিচালক কিরণ আমিরকে অডিশনের কথা বললেন। অডিশন দিলেন ‘মিস্টার পারফেকশনিস্ট’। অডিশন দেখে কিরণ জানিয়ে দিলেন, তার চেয়ে ভোজপুরী অভিনেতা রবি কিষাণের অডিশনই বেশি ভালো হয়েছে। পরিচালকের ভিশন বলে কথা!

২০১০ সালে ‘ধোবি ঘাট’ নামে দুর্দান্ত এক সিনেমার মাধ্যমে ফিল্ম ডিরেকশনে অভিষেক ঘটে কিরণ রাওয়ের। ধোবি ঘাটে ছিলেন আমির খান। ১৪ বছর পর কিরণ বানালেন ‘লাপাতা লেডিস’। এখানে আমির আছেন, আবার নেইও। প্রথম ছবির তুলনায় অনেকটাই হালকা মেজাজে বানানো এই ছবি। এই ছবি মিষ্টি প্রেমের মোড়কে নারীর বঞ্চনার গল্প বলে। শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত এক মুহূর্তের জন্যও গল্প থেকে সরেনি সিনেমাটা। তবে দুটো সিনেমা দেখে এখন বলতেই হচ্ছে– কিরণ, আপনি লাপাত্তা না হলেও পারতেন!


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply