এমপি আনার হত্যাকাণ্ড: ভারতে আটক ২, জানা গেলো যেসব তথ্য

|

ছবি: সংগৃহীত।

সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা:

ঝিনাইদহ-৪ আসনের সংসদ সদস্য (এমপি) আনোয়ারুল আজীম আনার খুনের ঘটনায় জড়িত সন্দেহে দুইজনকে আটক করেছে পশ্চিমবঙ্গ পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগ। এদেরমধ্যে আটককৃত জিয়াদকে পশ্চিমবঙ্গের উত্তর ২৪ পরগনা জেলার বনগা থেকে আটক করা হয়। ইতোমধ্যে তাদেরকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছে সিআইডি। যাতে বেরিয়ে এসেছে নানা তথ্য।

জানা গেছে, জিয়াদই আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ও এমপি আনারের বন্ধু আক্তারুজ্জামান শাহীনের সহযোগী। জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আটক করা হয়েছে আরেক গাড়িচালককে। তার নাম জুবের (২৩)। গত ৩০ এপ্রিল অনলাইন রেন্টালের মাধ্যমে খুনের ঘটনায় ব্যবহার করা সাদা রঙের একটি মারুতি গাড়ির চালক ছিলেন তিনি। সেটিও জব্দ করেছে সিআইডির কর্মকর্তারা।

ভারতের পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, আটককৃত জিয়াদকে জিজ্ঞাসাবাদ করেই এমপি আনারের মরদেহ উদ্ধার করতে চান তদন্তকারী কর্মকর্তারা। কারণ হিসেবে বলা হয়েছে, পরিকল্পিতভাবে হত্যার পর জিয়াদ মধ্য কলকাতায় লুকিয়ে ছিলেন। কিন্তু বুধবার (২২ মে) খুনের ঘটনা সামনে আসার পরেই বনগা সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশের চেষ্টা করছিলেন তিনি।

সিআইডি সূত্রে আরও জানা গেছে, এমপি আনারের হত্যাকাণ্ড সফল করতে অবৈধভাবে ভারতে এসেছিল জিয়াদ। গত ৩০ এপ্রিল ভারতে প্রবেশের পর মুম্বাই চলে যান তিনি। এরপর গত ১২ মে কলকাতার বরানগরের মন্ডলপাড়ায় পূর্ব পরিচিত গোপাল বিশ্বাসের বাড়িতে ওঠেন এমপি আনার। তার আগেই জিয়াদ মুম্বাই থেকে ফের চলে আসেন কলকাতায়।

পুলিশ জানিয়েছে, ১৩ মে নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটেই শ্বাসরোধ করে খুন করা হয় আনোয়ারুল আজিমকে। জিয়াদের দায়িত্ব ছিলো ওই মরদেহের টুকরোগুলোকে বিভিন্ন জায়গায় সরিয়ে দেয়া। কারণ, ওই আবাসনের নির্দিষ্ট ফ্ল্যাট থেকে বেশকিছু প্লাস্টিক ব্যাগ পাওয়া গেছে। প্রাথমিকভাবে পুলিশের ধারণা, ওই ব্যাগগুলোতেই আনারের খণ্ডিত মরদেহ ভরে লাগেজে করে বাইরে ফেলা হয়েছে।ী

সিআইডির বরাতে আরও জানা গেছে, ১৪ মে এক নারী ও দুই ব্যক্তিকে স্যুটকেসসহ অ্যাক্সিস শপিং মলের সামনে নামায় গাড়িটি সিসিভিটি ফুটেজে দেখা গেছে, অ্যাক্সিস শপিং মলে নামানোর আগে নজরুল তীর্থর কাছে ১৫ মিনিট দাঁড়িয়ে ছিলো গাড়িটি। সেই সময় আনারের খণ্ডিত মরদেহ কোথায় ফেলা হবে তা নিয়েই গাড়িতে মিটিং হয়। তাদের সেই আলোচনা গাড়িচালক শুনতে পারেন। এরপর ড্রাইভার তাদের অ্যাক্সিস শপিং মলের সামনে নামিয়ে দেয়।

ফলে, সিআইডির সন্দেহ চালক হয়তো অনেক কিছুই জানে, কিন্তু সে বলছে না। তদন্তের স্বার্থে ওই চালককে এখনও আটকে রেখেছে পুলিশ। ইতোমধ্যে এম্পি আনারের খুনের ঘটনায় নিউটাউন থানায় একটি হত্যা মামলাও দায়ের করা হয়েছে।

এদিকে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ব্যবহৃত আরও একটি গাড়ি জব্দ করা হয়েছে। বুধবার (২২ মে) সন্ধ্যায় গাড়ির ভেতর থেকে আলামত সংগ্রহ করে ফরেনসিক টিম। জানা যায়, গাড়িটি ভাড়ায় ব্যবহার করতে দিয়েছিলো গাড়ির মালিক। তদন্তের স্বার্থে গাড়ির মালিককেও জিজ্ঞাসাবাদ করছে পশ্চিমবঙ্গের পুলিশ।

এছাড়া তদন্তে উঠে আসছে আরও নতুন নতুন তথ্য। এমপি আনারকে নির্মমভাবে হত্যার নেপথ্যে স্বর্ণ চোরাচালানের বিপুল অর্থ ভাগাভাগি নিয়ে দ্বন্দ্ব হতে পারে বলেও ধারনা পুলিশের। নিউটাউনের ওই ফ্ল্যাটের ভাড়াটে যুক্তরাষ্ট্র প্রবাসী আক্তারুজ্জামান শাহীন নিজেও একজন স্বর্ণ চোরাচালানকারী। এমপি আনোয়ারুল আজিমের বিরুদ্ধেও স্বর্ণ চোরাচালানের অভিযোগ রয়েছে। কলকাতায় শাহীন ও আজীমের যৌথ ব্যবসা রয়েছে বলেও জানা গেছে।

প্রাথমিকভাবে আরও জানা গেছে, অভিযুক্ত আক্তারুজ্জামান শাহীন আনারের ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার ছিলেন। হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারীও তিনি। এমপি আনারকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকা দেয়ার চুক্তি করেন শাহীন। যারমধ্যে হত্যাকাণ্ডের আগে পরিশোধ করা হয় কিছু টাকা। বাকি টাকা দেয়ার কথা ছিলো হত্যাকাণ্ডের পর।

হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেয়া হয়েছিল আরেক বন্ধু ও চরমপন্থি নেতা আমানুল্লাহ আমানকে। কলকাতায় হত্যার পরিকল্পনা করে বাংলাদেশে চলে আসে শাহীন। পরে আমানসহ ছয়জন মিলে এমপি আজীমকে প্রথমে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। পরে মরদেহ কেটে টুকরো টুকরো করে স্যুটকেসের ঢুকিয়ে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে ফেলে দেয়।

অন্যান্য সূত্রে জানা গেছে, গত ৩০ এপ্রিল আক্তারুজ্জামান শাহীন, আমানুল্লাহ আমান, সিলিস্তা রহমান নামে নিজের এক বান্ধবীকে নিয়ে কলকাতা যান। সেখানে আগে থেকেই ভাড়া করে রাখা নিউটাউনের সঞ্জীবা গার্ডেনের ফ্ল্যাটে ওঠেন তারা। এর আগ থেকেই কলকাতায় অবস্থান করছিলো শাহীনের দুই সহযোগী সিয়াম ও জিহাদ। সেখানে বসে তারা এমপি আনারকে হত্যার পরিকল্পনা করে।

হত্যার পুরো দায়িত্ব আমানকে বুঝিয়ে দিয়ে গত ১০ মে দেশে চলে আসেন শাহীন। এরপর, পরিকল্পনা অনুযায়ী আমান বাংলাদেশ থেকে আরও দুই ভাড়াটে কিলারকে নিয়ে যায় কলকাতায়। তারা হলেন, ফয়সাল আলী শাজী ও মোস্তাফিজুর রহমান।

সূত্রগুলো আরও জানায়, কলকাতার ১০ নম্বর সদর স্ট্রিটে ‘হোটেল প্লাজায়’ একটি ঘর ভাড়া নেয় ফয়সাল আলী শাজি ও মোস্তাফিজুর রহমান। ওই হোটেলের একটি রুমে অবস্থান করেন তারা। হোটেলের রেজিষ্টারেও তার প্রমাণ রয়েছে।

এমপি আনারের ১২ মে কলকাতা যাবার খবর আগে থেকেই জানতো শাহীন। সে অনুযায়ী তাকে হত্যার জন্য সঙ্গীদের প্রস্তুত থাকতে বলেন শাহীন। পরে ১৩ মে, গোপাল বিশ্বাসের বাসায় থাকা এমপি আনারকে কৌশলে নিউ টাউনের সেই ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে যায় হত্যাকারীরা। বিকেলের দিকে এমপি আনার সেই ফ্ল্যাটে প্রবেশ করেন।

এরপর অভিযুক্ত আমান, তার সহযোগী ফয়সাল, মোস্তাফিজ, সিয়াম ও জিহাদ মিলে এমপিকে জিম্মি করে। এসময় তারা এমপি আনারের কাছে শাহীনের পাওনা টাকা পরিশোধের কথাও বলে। বিষয়টি নিয়ে বাকবিতণ্ডার একপর্যায়ে সবাই মিলে আনারকে জাপটে ধরে বালিশ চাপা দিয়ে হত্যা করে। হত্যার পর শাহীনকে ফোন করে বিষয়টি জানায় আমান।

এমএইচ/আরআইচ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply