মৃত্যুও তাদের আলাদা করতে পারলো না!

|

প্রদ্যুৎ কুমার সরকার, মাদারীপুর:

নতুন বৌয়ের সাজেই ছিল লিমা। হাতে সোনার বালা, নাকে নোলক। সাথে ছিল ছোট বেলার খেলার সাথী থেকে প্রেমিক, তারপর স্বামী রাজু। তবে দুজনেরই নিথর দেহ, কালচে মুখ। নাক মুখ দিয়ে গলগল করে ঝরছে রক্ত। কিন্তু শরীরের উপর দিয়ে প্রচণ্ড আঘাত এবং নদীর গভীর তলদেশে গিয়েও কেউ কাউকে ছেড়ে আসেনি তারা। তাদের লাশ দুটি যখন ডুবুরীরা তুলছিল তখনও ছিল তারা একে-অপরের যুগলবন্দী। মৃত্যুও পারেনি তাদের আলাদা করতে।

এমনই এক দৃশ্যই চোখে পড়লো কাঁঠালবাড়ি-শিমুলিয়া নৌরুটে স্পিডবোট ডুবির ঘটনায় পদ্মা নদীর তলদেশ থেকে রাজু-লিমাসহ ৩ জনের লাশ উদ্ধারকালে। রবিবার বিকেলে নৌরুটের চায়না টার্নিং ২৪ যাত্রী নিয়ে স্পিডবোট বিকল হয়ে গেলে ডাম্ব ফেরি ল্যান্টিং এর সাথে ধাক্কা খেয়ে পানিতে ডুবে রাজু-লিমাসহ ৩ যাত্রী নিখোঁজ হয়েছিল।

সরেজমিনে জানা যায়, রবিবার বিকেলে শামীম মাদবরের মালিকানাধীন ২৪ জন যাত্রী নিয়ে স্পিডবোটটি শিমুলিয়া ঘাট থেকে ছেড়ে আসে শিবচরের কাঁঠালবাড়ি ঘাটের দিকে। চায়না টার্নিংয়ে এসে চলন্ত স্পিডবোটটি বিকল হয়ে গেলে ডাম্ব ফেরি ল্যান্টিং এর সাথে ধাক্কা খেয়ে পানিতে ডুবে যায়। তাৎক্ষণিকভাবে নদীতে টহলরত সেনা সদস্যরা ২১ জন যাত্রীকে উদ্ধার করে। এসময় রাজু লিমাসহ ৩ যাত্রী নিখোঁজ থাকে। রাতেই তাদের উদ্ধারে অভিযান শুরু হয়।

সোমবার বেলা ১২ টার দিকে নিখোঁজ হওয়া ৩ জনের লাশ উদ্ধার করে ফায়ার সার্ভিসের ঢাকার ডুবুরী দল, থানা পুলিশ, নৌ পুলিশ, কারা রক্ষীরা। নিহতরা হলেন গোপালগঞ্জ জেলার মুকসুদপুর থানার প্রশন্নপুর গ্রামের আঃ রহমান উকিলের ছেলে মেরাজুল ইসলাম রাজু (২২), মেরাজুলের স্ত্রী সাদিয়া আক্তার লিমা আক্তার (১৮), পটুয়াখালী জেলার বাউফল উপজেলার আমিরাবাদ গ্রামের রুবেল গাজির মেয়ে ফাতেমা আক্তার (৮)।

পারিবারিক সুত্রে জানা যায়, রাজু লিমার ছোট সময় থেকে বেড়ে উঠা ঢাকার মহাখালী বক্ষব্যাধী হাসপাতালের স্টাফ কোয়ার্টারে। রাজুর বাবা ও লিমার মা ওই হাসপাতালের কর্মচারী হওয়ায় ছিল পাশাপাশি বসবাস। ছোট সময়ের সেই বন্ধুত্ব একসাথে বেড়ে উঠা থেকে স্কুল কলেজে ভালবাসায় জড়িয়ে পরে। পরিবারের আপত্তি এদের ভালবাসার কাছে হার মানলে দেড় মাস আগে ধুমধাম করে বিয়ে হয়। মেরাজুল ইসলাম রাজু কিশোরগঞ্জ কারারক্ষী পদে চাকরি করলেও রবিবার ৫দিনের ছুটিতে অসুস্থ দাদাকে দেখতে বাবা ও নতুন বৌকে নিয়ে যাচ্ছিল মাদারীপুরের টেকেরহাটে।

পথিমধ্যে অদক্ষ চালকের ভুলে প্রাণ হারালো রাজু লিমাসহ ৩ জন। নদী থেকে লাশ উদ্ধারকালে তাদের যুগলবন্দী লাশ কাঁদিয়েছে সবাইকে। লিমার দুলাভাই আপন ইসলাম কাঁদতে কাঁদতে বলেন, ‘রাজু লিমা ছোট সময় থেকেই একসাথে বেড়ে উঠে। স্কুল-কলেজে প্রেম। বিয়েতে ২ পরিবারের অসম্মতি থাকলেও ওদের ভালবাসার কাছে হেরে যায়। দেড় মাস হলো বিয়ে হয়েছে। মৃত্যুকালেও ওরা কেউ কাউকে ছাড়েনি। রাজু সাঁতার জানতো। ইচ্ছা করলে বাঁচতে পারতো। কিন্তু দুজনই ওদের বাঁচাতে গিয়েই মনে হয় মারা গেছে। লাশ তোলার সময় দেখলাম ওরা একে-ওপরকে জড়িয়ে ধরা’।

ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরী দলের এক সদস্য বলেন, নদীর তলদেশে গিয়ে দেখি তারা যুগলবন্দী। আমার কাছে মনে হয়েছে মৃত্যুকালেও কেউ কাউকে ছাড়তে চায়নি। নদীর তলদেশেও তারা একে অপরের চোখে তাকিয়ে ছিল।

ঢাকার ফায়ার সার্ভিসের ডুবুরী দলের স্টেশন মাস্টার আঃ রহমান বলেন, গত রাত থেকেই উদ্ধার তৎপরতা চলছিল। রাজু লিমার লাশ দুটি যুগলবন্দী ছিল। আর শিশু ফাতেমার লাশ একটু দুরে ছিল। অভিযানে অংশ নেয়া শিবচর থানার ওসি জাকির হোসেন বলেন, লাশ গুলো উদ্ধার শেষে পরিবারের কাছে দেয়া হয়েছে। স্পীডবোটটির চালকের অদক্ষতায় দুর্ঘটনা ঘটে। এ ব্যাপারে মামলা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply