সুকান্ত চট্টোপাধ্যায়, কলকাতা প্রতিনিধি:
শতাব্দীর প্রাচীন ও দূষণহীন ট্রাম পরিবহনের ইতি টানলো কলকাতা। ফলে আধুনিকতার কোপে পরে কালের নিয়মেই যবনিকা পতন হলো কলকাতার ঐতিহ্যবাহী ট্রাম পরিবহনের।
পশ্চিমবঙ্গের পরিবহন মন্ত্রী স্নেহাশীষ চক্রবর্তী মঙ্গলবার (২৪ সেপ্টেম্বর) সংবাদ সম্মেলন করে এ ঘোষণা দেন।
তিনি বলেন, আবেগ দিয়ে নয়, যানজট মুক্ত যানবাহন চলাচলকেই গুরুত্ব দিতে হেরিটেজ বা ঐতিহ্যবাহী একটি ট্রামকেই চালাবে রাজ্য পরিবহন দফতর। বাকি সমস্ত রুটের সমস্ত ট্রাম চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া হলো।
ভারতের প্রাক স্বাধীনতা যুগের ১৮৭৩ সালে কলকাতা শহরে ঘোড়ায় টানা ট্রামের পথ চলা শুরু হয়। তারপর কলকাতায় বিদ্যুৎ পরিষেবা স্বাভাবিক হওয়ায় নিয়ম মেনেই পরিবর্তন হয় ট্রামের পথ চলা। গ্রামের বৈদ্যুতিকরণ হয় গোটা শহর জুড়ে।
সেই সময় থেকেই আজ পর্যন্ত বর্তমানে কলকাতা শহরে চলে বৈদ্যুতিক ট্রাম। কিন্তু ধীরে ধীরে কলকাতার রাস্তা থেকে হারিয়ে যাবে ঐতিহ্যবহী ট্রাম সেটা কেউ কখনো কেউ ভাবতে পারেনি।
১৯৪৭ সালে ভারতের স্বাধীনতার পর ডাক্তার বিধান চন্দ্র রায়ের আমলে ট্রাম ব্রিটিশ কোম্পানির হাত থেকে পশ্চিমবঙ্গ সরকারের হাতে আসে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় বামফ্রন্ট আসার পর সেই শিল্পের শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। আবার বামফ্রন্টের রাজত্বের শেষকালে রাম শিল্পকে আধা সরকারি করে সেই ট্রাম শিল্পেরই অন্তর্জলী যাত্রা সূত্রপাত ঘটায়।
একের পর এক জাম কোম্পানির জায়গাগুলি বিক্রি করে দেয়া হয় বহুজাতিক সংস্থাকে শপিংমল ও পার্কো ম্যাট(মাটির নিচে শতশত গাড়ি পার্কিং করার ব্যবস্থা) করার জন্য। তখন থেকেই ট্রামের সংখ্যা অনেকটা কমতে থাকে।
মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ২০১১ সালে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতায় আসার পর বামফ্রন্টের পথেই পুনরায় হাঁটেন। ভবিষ্যতে পুরোপুরি ট্রাম পরিবহন বন্ধ করে দেয়ার জন্য ট্রাম কোম্পানিগুলির পরে থাকা বাকি জমি জায়গা, কার্সেড সব কিছু মমতার রাজ্য সরকার অন্য বহুজাতিক সংস্থাকে ফের হস্তান্তর করেন।
১৮৮৩ সালে কলকাতাসহ ভারতের ১৫ টা শহরে যাত্রা শুরু করেছিল ট্রাম। তবে কালের নিয়মে গতির সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে অনেক পিছিয়ে পড়ছে ট্রাম যাত্রা।
কলকাতা ছাড়া বাকি সমস্ত শহরেই ইতোমধ্যেই বন্ধ হয়ে গিয়েছে ট্রাম চলা। ষাটের দশক থেকে কলকাতা ও হাওড়ার মধ্যে গঙ্গা নদীর এপার থেকে ওপারে যাওয়ার জন্য হাওড়া ব্রিজে দিয়ে যে ট্রাম লাইন ছিলো। যানজটের অজুহাত তুলে আশির দশকে সেই হাওড়া ব্রিজ দিয়ে ট্রাম চলাচল বন্ধ করে দিয়েছিল তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকার।
কলকাতা হাইকোর্টে ট্রাম চলাচলের এ বিষয়টি বিচারাধীন অবস্থায় আছে। আগামী দিনে পরিবহন দফতরের পক্ষ থেকে এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত একটি মাত্র ট্রামকেই হেরিটেজ হিসেবে চালানো হবে বলে জানিয়েছেন পরিবহণমন্ত্রী।
রাজ্য সরকারের বক্তব্য দ্রুত গতির যুগে ট্রাম কোথাও চলে না। ট্রামের কারণে যানজট হচ্ছে। তাই বন্ধ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত হয়েছে। এসপ্ল্যানেড থেকে ময়দান পর্যন্ত একটি মাত্র ট্রামকেই হেরিটেজ হিসেবে চালানো হবে। মাত্র সাড়ে তিন কিলোমিটার পথই এবার ট্রামে চড়া যাবে।
একটা সময় কলকাতার লাইফলাইন ছিল ট্রাম। কিন্তু আজ হারিয়ে যাওয়ার মুখে। মেট্রো তৈরি হয়েছে। রাস্তায় গাড়ির সংখ্যা বেড়েছে। কিন্তু সেই পরিমাণ রাস্তা নেই। তাই শহরকে দ্রুত গতির করতেই এই সিদ্ধান্ত বলে জানিয়েছেন পশ্চিমবঙ্গ সরকারের পরিবহন মন্ত্রী।
এদিকে ট্রাম শিল্পকে ধ্বংস এবং ট্রাম পরিবহনকে বিলুপ্ত করার অভিযোগে নানা রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন কলকাতার বাসিন্দারা। পশ্চিমবঙ্গে খাদ্য আন্দোলন থেকে শুরু করে বাংলা সাহিত্যের কবি জীবনানন্দ দাশের ট্রামে কাটা পড়ে মৃত্যু, এমনকি ১০ পয়সা কাম ভাড়া বৃদ্ধিতে উত্তাল হওয়া কলকাতার রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট আজ সব ইতিহাস রাম শিল্পের যবনিকা পতনে।
/এমএইচ
Leave a reply