শেষ হলো ৬০তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ডামাডোল। নির্বাচনী এ লড়াইয়ে ডেমোক্রেট প্রার্থী কমালা হ্যারিসকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হয়েছেন রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প। আগামি চার বছরের জন্য হোয়াইট হাউজের বাসিন্দা তো বটেই, বিশ্বরাজনীতির সবচেয়ে ক্ষমতাধর দেশটির হেড অব দ্য স্টেট পদ অলঙ্কিত করবেন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প।
এরইমাঝে ট্রাম্পের দ্বিতীয় মেয়াদের মন্ত্রিসভায় কারা স্থান পেতে পারেন, এ নিয়ে শুরু হয়েছে জল্পনা-কল্পনা। প্রতিরক্ষা, গোয়েন্দা, পররাষ্ট্র, বাণিজ্য, অর্থনীতি, অভিবাসনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখভালের জন্য ট্রাম্পের পছন্দের সম্ভাব্য তালিকায় কোন কোন ব্যক্তি স্থান পেতে পারেন, তার একটা ধারণা দিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স।
স্কট বেসেন্ট, সম্ভাব্য ট্রেজারি সেক্রেটারি (অর্থমন্ত্রী):
ট্রাম্পের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা বেসেন্ট। ট্রেজারি সেক্রেটারি পদে তাকেই বেছে নিতে পারেন ট্রাম্প। বেশ কয়েক বছর ধরে তিনি ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করছেন।
স্কট বেসেন্ট দীর্ঘসময় ধরে ‘লেইস-ফেয়ার’ নীতির পক্ষে। যে নীতি আসলে ব্যক্তিগত ব্যবসায় সরাসরি সরকারী হস্তক্ষেপের বিপক্ষে। রিপাবলিকান পার্টিতে এই নীতি জনপ্রিয়। সমঝোতার হাতিয়ার হিসেবে শুল্কের ব্যবহার বিষয়ে ট্রাম্পের নীতির পক্ষে তাকে কথা বলতে দেখা গেছে। তিনি নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক দর্শনের প্রশংসা করেছেন।
জন পলসন, সম্ভাব্য ট্রেজারি সেক্রেটারি:
বিলিয়নিয়ার হেজ ফান্ডের ম্যানেজার এবং ট্রাম্পের প্রধান ডোনার জন পলসন ট্রেজারি সেক্রেটারি পদে আরেক শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি বলেছেন, এই পদে (ট্রেজারি সেক্রেটারি) তিনি আগ্রহী।
পলসন প্রকাশ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে এবং বিদেশে অন্যায্য বাণিজ্য অনুশীলনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি সরঞ্জাম হিসাবে ‘লক্ষ্যযুক্ত শুল্ক’কে সমর্থন করেছেন।
ল্যারি কুডলো, সম্ভাব্য ট্রেজারি সেক্রেটারি:
ফক্স বিজনেস নেটওয়ার্কের তালিকায় অন্যতম ব্যক্তিত্ব ল্যারি কুডলো। তিনি ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদের বেশিরভাগ সময় জাতীয় অর্থনৈতিক কাউন্সিলের পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন। তারও ট্রেজারি সেক্রেটারি হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
রবার্ট লাইটহাইজার, সম্ভাব্য ট্রেজারি সেক্রেটারি:
তৎকালীন প্রেসিডেন্টের পুরো মেয়াদে ট্রাম্পের মার্কিন বাণিজ্য প্রতিনিধি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা লাইটহাইজারকে প্রায় নিশ্চিতভাবেই মন্ত্রিসভায় আমন্ত্রণ জানানো হবে। যদিও বেসেন্ট এবং পলসনের ট্রেজারি সেক্রেটারি হওয়ার সুযোগ অনেক বেশি।
ট্রাম্পের মতো লাইটহাইজারও শুল্কে দৃঢ় বিশ্বাসী। চীনের সঙ্গে ট্রাম্পের বাণিজ্য যুদ্ধ এবং ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে মেক্সিকো ও কানাডার সঙ্গে নর্থ আমেরিকান ফ্রি ট্রেড এগ্রিমেন্ট নিয়ে নতুন করে দরকষাকষির অন্যতম প্রধান ব্যক্তি ছিলেন তিনি।
রিচার্ড গ্রেনেল, সম্ভাব্য জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা:
গ্রেনেল ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক উপদেষ্টাদের একজন। নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের প্রথম চার বছরের মেয়াদে তিনি জাতীয় গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক এবং জার্মানিতে মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। গত সেপ্টেম্বরে ট্রাম্প যখন ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট জেলেনস্কির সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন, তখন গ্রেনেল একান্ত বৈঠকে বসেছিলেন।
বিদেশি নেতাদের সঙ্গে গ্রেনেলের ব্যক্তিগত যোগাযোগ আছে। তাকে জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার শীর্ষ প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এই পদের জন্য সিনেটের অনুমোদনের প্রয়োজন হয় না।
রবার্ট ও’ব্রায়েন, সম্ভাব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী:
প্রথম মেয়াদে ট্রাম্পের শেষ জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা রবার্ট ও’ব্রায়েন নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্টের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে। তারা দুজন প্রায়ই মার্কিন জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়ে কথা বলেন। তিনি পররাষ্ট্রমন্ত্রী বা অন্যান্য শীর্ষ পররাষ্ট্রনীতি এবং জাতীয় সুরক্ষামূলক পদের দৌড়ে এগিয়ে রয়েছেন।
ট্রাম্প ক্ষমতা ছাড়ার পর থেকের তিনি বিদেশি নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ বজায় রেখেছেন। গত মে মাসে ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর সঙ্গেও বৈঠক করেছেন।
ট্রাম্পের কিছু উপদেষ্টার চেয়ে তার মতামত কিছুটা বেশি কট্টরপন্থী। রবার্টই যুক্তরাষ্ট্রে টিকটক নিষিদ্ধ করার প্রবক্তা।
বিল হ্যাগার্টি, সম্ভাব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী:
টেনেসির একজন মার্কিন সিনেটর, যাকে সেক্রেটারি অফ স্টেটের শীর্ষ প্রতিযোগী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তিনি প্রথম ট্রাম্প প্রশাসনে জাপানে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছিলেন।
হ্যাগার্টির নীতি মোটামুটি ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। বছরের শুরুতে তিনি ইউক্রেনের জন্য একটি বড় সামরিক সহায়তা প্যাকেজের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন।
মার্কো রুবিও, সম্ভাব্য পররাষ্ট্রমন্ত্রী:
ফ্লোরিডার সিনেটর ও ২০১৬ সালের রিপাবলিকান প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী রুবিও হতে পারেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তার নীতি ট্রাম্পের নীতির সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পৃক্ত। হ্যাগার্টির মতো তিনিও ২০২৪ সালের ট্রাম্পের রানিংমেট হওয়ার দৌড়ে এগিয়ে ছিলেন।
রুবিও দীর্ঘদিন ধরে সিনেটে বৈদেশিক সংশ্লিষ্ট বিষয়ে যুক্ত ছিলেন, বিশেষত ল্যাটিন আমেরিকার সাথে সম্পর্কিত। পুরো পার্টির মধ্যে তার দৃঢ় প্রভাব রয়েছে।
মাইক ওয়াল্টজ, সম্ভাব্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী:
মাইক ওয়াল্টজ ফ্লোরিডার কংগ্রেসম্যান। তিনি নিজেকে হাউস অফ রিপ্রেজেন্টেটিভসের ‘চীনা বাজপাখি’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। চীন সম্পর্কিত বিভিন্ন পদক্ষেপে তার ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদের দৌড়ে অনেকটাই এগিয়ে আছেন।
মাইক পম্পেও, সম্ভাব্য প্রতিরক্ষামন্ত্রী:
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে সিআইএ পরিচালক ও পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করা পম্পেওকে প্রতিরক্ষামন্ত্রী পদের শীর্ষ প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে বিবেচনা করা হয়। তবে তিনি প্রতিরক্ষামন্ত্রী না হয়ে জাতীয় নিরাপত্তা, গোয়েন্দা বা কূটনীতির অন্য কোনো পদেও থাকতে পারেন।
তিনি ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ মিত্র হলেও ‘ইউক্রেনের সবচেয়ে উগ্র রক্ষক’ হিসাবে পরিচিত। ইউক্রেনের পক্ষে তার এ অবস্থানের কারণে নিজ দলের উচ্চপদস্থ অনেকের সঙ্গে তার মতবিরোধ রয়েছে।
কিথ কেলোগ, জাতীয় সুরক্ষা পদের সম্ভাব্য প্রার্থী:
জাতীয় সুরক্ষা কাউন্সিলের চিফ অফ স্টাফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করা অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল কেলোগ ট্রাম্পের ঘনিষ্ঠ হিসেবেই পরিচিত।
নির্বাচনী প্রচারণার সময় তিনি ট্রাম্পের কাছে ইউক্রেন যুদ্ধ শেষ করার একটি পরিকল্পনা উপস্থাপন করেছিলেন। তার পদক্ষেপের মধ্যে ছিল, রাশিয়া-ইউক্রেন উভয় পক্ষকে আলোচনার টেবিলে বসাতে বাধ্য করা।
টম হোমান, সম্ভাব্য হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী):
ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে দেড় বছর অভিবাসন ও কাস্টমস এনফোর্সমেন্টের ভারপ্রাপ্ত পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করা হোমল্যান্ড স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর জন্য একজন প্রতিদ্বন্দ্বী। ট্রাম্প অবৈধ অভিবাসন দমনকে তার নির্বাচনী প্রচারণার কেন্দ্রীয় উপাদান বানিয়েছেন এবং গণহারে বিতাড়িত করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন।
ট্রাম্প নির্বাচনী প্রচারের সময় প্রায়ই হোমানের প্রশংসা করেন এবং হোমানও সমর্থকদের সঙ্গে সমাবেশ করার সময় অভিবাসন ইস্যু নিয়ে কথা বলেন। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে হোমান ‘চাইল্ড সেপারেশন পলিসি’র আইনজীবী ছিলেন।
চ্যাড উলফ, সম্ভাব্য হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী):
ট্রাম্পের প্রথম প্রেসিডেন্সির সময় প্রায় ১৪ মাস হোমল্যান্ড সিকিউরিটির ভারপ্রাপ্ত সেক্রেটারি হিসেবে দায়িত্ব পালন করা উলফ এবারও সে দায়িত্বে আসতে পারেন।
উলফ ট্রাম্পের কট্টরপন্থী অভিবাসন নীতি বাস্তবায়ন করেছিলেন। তিনি পোর্টল্যান্ড-ওরেগন দাঙ্গার সময় বিক্ষোভ নিয়ন্ত্রণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন বলে মনে করা হয়।
মার্ক গ্রিন, সম্ভাব্য হোমল্যান্ড সিকিউরিটি সেক্রেটারি (স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী):
সেনাবাহিনীর সাবেক কর্মকর্তা এবং হাউস হোমল্যান্ড সিকিউরিটি কমিটির বর্তমান চেয়ারম্যান মার্ক গ্রিনকে ট্রাম্পেরই কিছু অনুসারী হোমল্যান্ড সিকিউরিটির দায়িত্বে দেখতে চান। গ্রিনকে ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে সেনাবাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালনের জন্য মনোনীত করেছিলেন।
মন্ত্রিসভার বাইরে দেশটির বিচার বিভাগেও মন দেবেন ট্রাম্প। মার্কিন মুলুকের অ্যাটর্নি জেনারেল পদে জন র্যাটক্লিফকে বাছাই করতে পারেন ট্রাম্প। তিনি সাবেক কংগ্রেস সদস্য ও প্রসিকিউটর। ট্রাম্পের প্রথম মেয়াদে তিনি ন্যাশনাল ইন্টেলিজেন্সের পরিচালকের দায়িত্ব পালন করেছিলেন। এই পদে বিবেচনায় আরও আসতে পারেন সাবেক প্রসিকিউটর মাইক লি। তিনি উটাহ অঙ্গরাজ্যের বর্তমান সিনেটর।
উল্লেখ্য, দেশটির চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী নভেম্বরের প্রথম মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত হয় দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচন। সেইসাথে পরের বছরের জানুয়ারি মাসের ২০ তারিখে শপথ নেন দেশটির নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। এরপরই তিনি গঠন করবেন তার পূর্ণাঙ্গ মন্ত্রিসভা।
/এমএইচআর
Leave a reply