রিমন রহমান:
এতদিন আমদানিনির্ভর কেজিপ্রতি আপেল, কমলা কিংবা মাল্টার জন্য সরকারকে শুল্ক-কর দিতে হতো ১০১ টাকা। কিন্তু ঢালাও শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এখন দিতে হচ্ছে ১১৬ টাকা। গেল বৃহস্পতিবার রাতে আমদানিনির্ভর ফলে শুল্ক কর বাড়িয়ে দেবার পর ফলের বাজারে শুরু হয়েছে অস্থিরতা। রাজধানীর বাজারে কেজিতে সব ধরণের ফলের দাম বেড়েছে ৫০ টাকা পর্যন্ত।
শুধু ফলই নয়, শুল্কবৃদ্ধির নেতিবাচক প্রভাব স্পষ্ট হয়েছে বাজারে। পণ্য এবং সেবায় ভোক্তাকে গুণতে হচ্ছে বাড়তি অর্থ। কমেছে বিক্রি, চাহিদার লাগাম টেনেছে ভোক্তা। নজিরবিহীন ভ্যাট বৃদ্ধিতে জীবনযাত্রায় ঘটেছে ছন্দপতন। আইএমএফের চাপে হঠাৎ করে এমন শুল্ক বৃদ্ধি করা কতটা নৈতিক? বিকল্প কি আর কোনো উপায় ছিল না? বিশ্লেষকরা বলছেন, কোনো পক্ষের সঙ্গে আলোচনা ছাড়া এমন সিদ্ধান্ত টেকসই পন্থা নয়। এর ফলে মূল্যস্ফীতি উস্কে যাবে। আরও কঠিন হবে জীবনধারণ। তার সরকারের এমন সিদ্ধান্তে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে ক্রেতা-বিক্রেতারা।
রাজধানীর বাজারে এক ফল ক্রেতা বলেন, এভাবে যদি ফলের দাম বাড়ে তাহলে আমরা মধ্যবিত্ত পরিবাররা সন্তানদের ফলমূল কখনও আর খাওয়াতে পারবো না। দ্রব্যমূল্যের উর্ধ্বগতির এই সময়ে শুল্কের বোঝা চাপিয়ে দেয়া হলো।
খুচরা এক ফলের দোকানি বলেন, নীল আপেল গতকাল যেটা ৫ হাজার ১০০ টাকায় নিয়েছিলাম, আজকে সেটি নিতে হয়েছে চারশ টাকা বেশি দিয়ে। মোকাম থেকে বলেছে একদাম। নিলে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা দিয়েই কিনতে হবে।
রেস্তোরাগুলোতেও কার্যকর হয়েছে ভ্যাটের নতুন হার। ১০০ টাকা খেলে ভোক্তাতে দিতে হচ্ছে বাড়তি ১৫ টাকা। এতে ক্রেতা-বিক্রেতার মধ্যে তৈরি হচ্ছে বিতণ্ডা।
বিষয়টি নিয়ে রেস্তোঁরা মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বলেন, রেস্তোঁরা ব্যবসা ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এটিকে বাঁচানোর তো কোনো পথ দেখায়নি, উল্টো মরার ওপর খাড়ার ঘাঁ হিসেবে ১৫ শতাংশ ভ্যাট জুড়ে দেয়া হয়েছে। কার সাথে আলোচনা করে তিনগুণ ভ্যাট কার্যকর করা হলো— সেই প্রশ্ন রাখেন এই ব্যবসায়ী নেতা।
শতাধিক পণ্য এবং সেবায় নানাধরণের শুল্ক বৃদ্ধি করে অধ্যাদেশ জারি করেছে সরকার। সহজ পন্থায়, ক্রেতার পকেট থেকে কমপক্ষে হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়াই উদ্দেশ্য। প্রশ্ন হচ্ছে আইএমএফের চাপে এমন শুল্ক বৃদ্ধি কতোটা নৈতিক?
বিষয়টি নিয়ে বিআইআইসিসির গবেষণা পরিচালক ড. মাহফুজ কবীর বলেন, হঠাৎ করে অতিরিক্ত পরিমাণ রাজস্ব আদায় করার যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে সেটি সামাজিক নায্যতাকে লঙ্ঘণ করেছে— এতে কোনো সন্দেহ নেই। যারা নতুনভাবে বিনিয়োগ করতে চাচ্ছেন, তাদেরকে বিনিয়োগে বঞ্চিত করাও আরেক ধরনের অনায্যতা
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, সরকারের চোখ জনগণের টাকায়। যে পরিমাণ রাজস্ব প্রয়োজন, তারা সিদ্ধান্ত নিয়েছে জনগণের পকেট থেকেই সেই সাড়ে ১২ হাজার কোটি টাকা বা যে পরিমাণ দরকার তা তুলে নিতে পারবে। বাস্তবে এর পরিমাণ কতটুকু হবে তা নিয়ে যতেষ্ট সন্দেহ আছে।
পরিবর্তিত অবস্থায়, বাজেট বাস্তবায়নে হিমশিম খাচ্ছে সরকার। সরকারি কর্মচারিদের মহাজ্ঞভাতাসহ নানাক্ষেত্রে দেয়া হচ্ছে পদোন্নতি। অর্থের বাড়তি চাপ সামাল দিতেই এই সহজ পন্থা। তবে, বিকল্প কি কোন উৎসই ছিল না?
এ নিয়ে ড. মাহফুজ কবীর বলেন, ব্যাংকগুলো যেহেতু তারল্য সংকট আছে, তাই সেখান থেকে সরকার ঋণ নিতে পারছে না। যতটুকু বিদেশি সহায়তার প্রয়োজন, সেটিও সেভাবে আসছে না। বাজেটের সাপোর্টও মিলছে না। বাস্তবিক অর্থে সরকারের হাতে টাকা নেই। যদি সবপক্ষের সাথে আলাপ-আলোচনা করে যদি সিদ্ধান্ত নিতো তাহলে সামাজিক সকল দলই কিন্তু সরকারকে সহযোগিতা করতো।
অর্থনীতিবিদ ড. মুস্তফা কে মুজেরি বলেন, ভ্যাট বৃদ্ধির যে চাপ, সেটি পুরোপুরি জনগণের ওপর আসবে। এর পুরোটা অংশ সরকারের কাছে যাবে না, ফাঁকফোকর দিয়ে অনেকটা অংশ বের হয়ে যাবে। ফলে জনগণের বোঝা আরও বাড়বে।
এই দুই বিশেষজ্ঞর মতে, শুল্ক বৃদ্ধি করে বাড়তি রাজস্ব আদায় টেকসই কোনো পন্থা নয়। বলছেন, এর ফলে আর্থিক টানাপোড়েনে থাকা মানুষের মধ্যে অস্থিরতা আরও বাড়বে।
/এনকে
Leave a reply