ছবি: ফাইল
দেশের হারানো গৌরব আর সম্মান ফিরিয়ে আনার প্রত্যয় নিয়ে ২০২০ সালে বিশ্বের সবচেয়ে বড় পরাশক্তি, যুক্তরাষ্ট্রের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত হন ৭৮ বছর বয়সী জো বাইডেন। সকল ভেদাভেদ ভুলে জাতীয় স্বার্থে ঐক্যের ডাক দেন তিনি। কথা ছিলো করোনায় হওয়া ক্ষত সারিয়ে দেশ পুনর্গঠন করবেন জো বাইডেন। কিন্তু, ক্ষমতা শেষে প্রশ্ন উঠছে নিজ লক্ষ্যে কতটুকু সফল হতে পেরেছেন বিদায়ী এই মার্কিন প্রেসিডেন্ট?
জো বাইডেনের ক্ষমতার চার বছরে নজিরবিহীন সংঘাতের মধ্যপ্রাচ্য দেখেছে বিশ্ব। রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ঘিরে উত্তাপ ছড়িয়েছে ইউরোপেও। যুদ্ধ-বিগ্রহে অর্থকড়ি ছড়ানোর জেরে নিজ দেশে নাকাল হতে হয়েছে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি আর মূল্যস্ফীতির কাছে। বেড়েছে বেকারত্ব। পড়তে হয়েছে তীব্র সমালোচনা, বিক্ষোভ কিংবা নজিরবিহীন ছাত্র আন্দোলনের মুখে। সব মিলিয়ে খুব একটা সুখকর ছিল না বাইডেনের আমল। তলানিতে ঠেকেছে জনপ্রিয়তা। বয়সের ভারে কাবু হয়ে শেষমেষ নির্বাচনী দৌঁড় থেকেই সরে দাঁড়াতে হয় ৮২ বছর বয়সী প্রেসিডেন্টকে।
বাইডেন শাসনামলের সবচেয়ে বিব্রতকর বিষয় হিসেবে বিবেচনা করা হয়ে থাকে আফগানিস্তান থেকে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি। ট্রাম্পের আমলে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত এলেও ২০২১ সালে তা খুবই বিশৃঙ্খলভাবে বাস্তবায়ন করে বাইডেন প্রশাসন। কমপক্ষে ৬৯ শতাংশ মার্কিনীই মনে করেন খুবই বাজেভাবে সেনা প্রত্যাহারের বিষয়টি পরিচালনা করেছেন তিনি। মূলত এর রেশ ধরেই কমতে থাকে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা। ফলাফল- ৫৬ শতাংশের জনপ্রিয়তা কমে দাঁড়ায় ৪৩ শতাংশে।
ভাটা পড়তে থাকা এই জনপ্রিয়তায় যেন শেষ পেরেক ঠুকে দেয় রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ। বাইডেনের আমলেই নজিরবিহীন সংঘাতে জড়ায় দুই প্রতিবেশী রাশিয়া-ইউক্রেন; অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে গোটা ইউরোপ। বাইডেন প্রশাসনের ব্যর্থ কূটনীতির কারণে প্রায় তিন বছরেও শেষ হয়নি সে যুদ্ধ। উল্টো, অর্থনীতির কথা বিবেচনা না করে সময়ে সময়ে সাহায্যের নামে কিয়েভকে শুধু সামরিক সহায়তাই দিয়ে গেছেন জো বাইডেন। প্রায় ৬৬ বিলিয়ন ডলারের সহায়তার পরও থামেনি সে প্রচেষ্টা।
একই চিত্র মধ্যপ্রাচ্যেও। ২০২৩ সালে শুরু হওয়া গাজায় ইসরায়েলি আগ্রাসনের জেরে তলানিতে গিয়ে ঠেকে জো বাইডেনের জনপ্রিয়তা। সর্বশেষ জরিপ অনুযায়ী যার পরিমাণ মাত্র ৩৬ শতাংশ। তবুও, ইসরায়েলের আত্মরক্ষার অধিকারের নামে নিরীহ ফিলিস্তিনিদের ওপর চালানো হত্যাযজ্ঞের যেন বৈধতাই দিয়ে গেছে বাইডেন নেতৃত্বাধীন প্রশাসন। হামাস নির্মূলের নামে অবরুদ্ধ উপত্যকার প্রায় ৪৭ হাজার মানুষ নিশ্চিহ্ন হলেও থামেনি তেলআবিবকে ওয়াশিংটনের অস্ত্র সহায়তা। বরং রেকর্ড পরিমাণে বেড়েছে বাইডেনের ইসরায়েলপ্রীতি।
শুধু তাই নয়, বাইডেনের আমলেই আরেক পরাশক্তি চীনের সাথেও দূরত্ব বাড়ে যুক্তরাষ্ট্রের। বেইজিংয়ের বিরুদ্ধে যেন ট্রাম্পের দেখানো বাণিজ্যযুদ্ধের নীতির পথেই হেঁটেছে বাইডেন প্রশাসন। যুক্তরাষ্ট্রের মাটিতে খালিস্তানপন্থি শিখ নেতা হত্যাচেষ্টা ইস্যুতে নয়াদিল্লির সাথেও সম্পর্কে টানাপোড়েন দেখা দেয় ওয়াশিংটনের। সবশেষ মোদি ঘনিষ্ঠ ভারতীয় ধনকুবের আদানীর বিরুদ্ধে চলা বিচারকে কেন্দ্র করেও সম্পর্কে ফাটল দেখা দেয় ভারত-যুক্তরাষ্ট্রের।
সীমান্ত নীতির কারণেও গেল চারবছরে ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেন জো বাইডেন। তার আমলেই যুক্তরাষ্ট্রে অস্বাভাবিক হারে বেড়েছে অবৈধ অভিবাসন। বেড়েছে অভিবাসনজনিত অপরাধের ঘটনাও। এবারের নির্বাচনে ডেমোক্রেটদের পরাজয়ের অন্যতম কারণ হিসেবে দেখা হয় এই বিষয়টিকে। শুধু তাই নয়, অর্থনৈতিক খাতেও ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছেন জো বাইডেন। মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে সফল হতে পারেনি বাইডেন-কমালার প্রশাসন। ক্ষমতার প্রথম দু’বছরেই ৯.১ শতাংশে পৌঁছায় যুক্তরাষ্ট্রের মূল্যস্ফীতি। এছাড়াও, বাইডেন আমলেই বেড়েছে সরকারি ঋণের পরিমাণ; রেকর্ড পরিমাণে ছাড়িয়েছে বেকারত্বের হার।
বয়স বিতর্কে ক্ষমতার শুরু থেকেই জর্জরিত ছিলেন জো বাইডেন। এবারের নির্বাচনে যেন সেই বিতর্কেই নতুন করে জড়াতে হয়েছে তাকে। প্রেসিডেনশিয়াল ডিবেটে ট্রাম্পের কাছে লজ্জাজনক হারে মানসিকভাবে আরও ভেঙে পড়েন তিনি। শেষমেষ বয়সের কাছে হার মেনে প্রত্যাহার করে নিতে হয়েছে প্রেসিডেন্টের প্রার্থিতাও।
উল্লেখ্য, ২০২০ সালের নির্বাচনে ট্রাম্পকে হারিয়ে প্রেসিডেন্ট পদে বসেন আগের দুই মেয়াদে (২০০৮-২০১৬) বারাক ওমাবার ডেপুটি হিসেবে ভাইস প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব পালন করা বাইডেন। যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নানা ইস্যু, আন্তর্জাতিক পররাষ্ট্রনীতির পাশাপাশি নিজের বয়স— সব মিলিয়ে রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে অনেকটা মিশেলে অভিজ্ঞতা নিয়ে দায়িত্ব ছাড়ছেন বাইডেন। মঙ্গলবার (২০ জানুয়ারি) নিজের শেষ মেয়াদে আগামী চার বছরের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মসনদে বসবেন ডোনাল্ড ট্রাম্প।
/এমএইচআর
Leave a reply