নিউরোদর্শন: নিউরনে আলোড়ন তোলা এক বই

|

আল মাহফুজ

থিসিয়াস ছিলেন গ্রিক মিথোলজির রাজা। আর মিনোয়ার ক্রিটের পৌরাণিক জন্তু হলো মিনোয়াতোর (অর্ধেক মানুষ, অর্ধেক ষাঁড়)। থিসিয়াস মিনোয়াতোরের বিরুদ্ধে যুদ্ধে জয়লাভ করে মিনোয়ার থেকে যে জাহাজে এথেন্সে ফিরেছিলেন, সেই বিখ্যাত জাহাজের নাম ‘শিপ অব থিসিয়াস’।

থিসিয়াস যখন এথেন্সে ফিরে আসেন, তখন তার ঐতিহাসিক যুদ্ধজাহাজটি মেমোরিয়াল হিসেবে সংরক্ষণ করার সিদ্ধান্ত নেয় শহরের মানুষ। সংরক্ষণের পর থেকে সময়ে সময়ে কাঠের তৈরি জাহাজটির বিভিন্ন অংশে পচন ধরে। যখনই টুকরোগুলো ক্ষয় হতো, জাহাজের পুরোনো কাঠগুলো বদলে দেয়া হতো।

এভাবে কাঠ বদলাতে বদলাতে সময় গড়াতে থাকে বছরে, আর বছর গড়াতে থাকে শতাব্দীতে। অবশেষে জাহাজের সমস্ত কাঠ একদিন পরিবর্তন হয়ে যায়। অর্থাৎ আসল ‘শিপ অব থিসিয়াস’ জাহাজের কোনো অংশই তখন আর অবশিষ্ট নেই। ফলে প্রশ্ন ওঠে– জাহাজটি কি এখনও থিসিয়াসের সেই একই জাহাজ রয়েছে, যেটি তিনি যুদ্ধজয়ে ব্যবহার করেছিলেন? এটাকে কি এখনও ‘শিপ অব থিসিয়াস’ বলা চলে?

মনুষ্যমনের সাধারণ প্রবৃত্তি হলো, অল্প কিছু জিনিস বা মুহূর্ত বাদ দিলে সে প্রকৃতিতে সবকিছুকে স্থির বা কনস্ট্যান্ট হিসেবে দেখে। কিন্তু আসলেই কি সব কিছু স্থির? আপনি চাইলেও কি এক নদীতে দুবার ঝাঁপ দিতে পারবেন?

এ প্রসঙ্গে গ্রিক দার্শনিক হিরাক্লিটাসের বিখ্যাত একটি উক্তি আছে– ‘একই নদীতে দুবার গোসল করা অসম্ভব। এমনকি একবারও সম্ভব নয়। কারণ, স্রোতের অংশ বিশেষ স্পর্শ করার পূর্বেই সে স্রোত বাহিত হয়ে যায়।’

তার এই উক্তির পেছনেও একটি চিরন্তন সূত্র কাজ করেছে– জগতের সবকিছু পরিবর্তনশীল। কোনো কিছুই স্থির নয়। সে কথার সূত্র ধরে বহু দার্শনিক এ সিদ্ধান্তে পৌঁছে যান– জগতের জীব বা জড়বস্তু প্রতিনিয়ত পরিবর্তনশীল। সেই পরিবর্তন যতো ধীরই হোক না কেন, কোনো কিছুই আপন অস্তিত্বে স্থায়ী নয়।

বইটির প্রচ্ছদ

বিজ্ঞান ও দর্শনের চোখ দিয়ে মনুষ্য মনোজগতের বিভিন্ন দিক নিয়ে লেখক শরিফুল ইসলাম তার ‘নিউরোদর্শন’ বইয়ে অল্প বিস্তর আলোচনা করেছেন। উল্লেখিত প্যরাগ্রাফের মতো কখনও তিনি দার্শনিকদের চিন্তাসূত্রের শরণাপন্ন হয়েছেন, কখনও বিজ্ঞানের কোনো টার্মের ওপর ভর করে এগিয়ে নিয়েছেন বর্ণনার পথ। বোঝানোর সুবিধার্থে আশ্রয় নেয়া হয়েছে সিনেমা বা মিথোলজির কোনো ঘটনারও।

জীবনের কোনো না কোনো সময়ে (বা অসময়ে) আপনার চেতন বা অবচেতন মনে নিশ্চয়ই প্রশ্ন জেগেছে– মানুষের মন কীভাবে কাজ করে? মানুষের মন ও দেহ কি একই জিনিস? নাকি দুটোর মাঝে ফারাক বিদ্যমান? মনকে কি শরীর প্রভাবিত করে বা করতে পারে? এসব প্রশ্নের উত্তর বুঝতে নিউরোদর্শন সহায়ক হতে পারে।

রেনে দেকার্তের বিখ্যাত বাণী রয়েছে— ‘আমি চিন্তা করি, তাই আমি অস্তিত্বশীল’। একে কেন্দ্র করে পশ্চিমা দর্শনে ‘মাইন্ড-বডি প্রবলেম’ বিষয়ে বিস্তর বিতর্ক হয়েছে। সেসব আলোচনা ডালপালা গজিয়ে ছড়িয়েছে মানুষের দেহ, মন, চিন্তা, চৈতন্য কিংবা আত্মার আলাপে। সেগুলোকে একপাশে সরিয়ে আমরা যদি দেহ-মনের অনুভূতির ওপর কম্পাস ধরি, তাহলে দেখতে পাব– কাঁটাটি ইন্ডিকেট করছে মস্তিষ্ককে। আর মস্তিস্ক সংযুক্ত স্নায়ুতন্ত্রের সঙ্গে।

মস্তিষ্কের ভেতর চলে বহুবিধ চিন্তার খেলা। সেই খেলার খেলোয়াড় অসংখ্য নিউরন। তারা কখনও সামনে এগোয়, কখনও পেছায়; কখনও বল পাস করার মতো এক নিউরন তথ্য পাস করে আরেক নিউরনকে। এভাবে এগোতে থাকে চিন্তার নির্মাণ বা বিনির্মাণের প্রক্রিয়া। সেই প্রক্রিয়া কখনও গোলের পূর্ণতা পায়, কখনোবা আছড়ে পড়ে গোলপোস্টের বাইরে।

‘নিউরোদর্শন’-এ মন ও মস্তিষ্কের ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া দর্শন ও মনোবিজ্ঞানের আলোকে বিশ্লেষণ করা হয়েছে। লেখকের ভাষ্য, মানুষের মন কীভাবে পরিবেশ বা সংস্কৃতির মাধ্যমে প্রভাবিত হয়ে নানা রূপ ধারণ করে এবং একই মন একই সময়ে কত ধরনের স্ববিরোধিতা নিয়ে যে হাজির হতে পারে, সেগুলো নিয়েই মূলত এই বই লেখা।

প্রকাশনীতে নিউরোদর্শন

বইটিতে ক্ষুদ্র পরিসরে আলোচিত হয়েছে– মন, মূর্খতা ও স্ববিরোধিতা; ডিনায়াল; ম্যানিপুলেশন; শিপ অব থিসিয়াস; স্বার্থপরতা; আইডেন্টিটি ক্রাইসিস; বিশ্বাস, যুক্তি ও আবেগ; ইমপোস্টার সিনড্রোম; চৈতন্য ও প্লাসিবো ইফেক্ট; নেগেটিভিটি বায়াসনেস; কগনিটিভ ডিসোন্যান্স বা ফ্রেম; মেধাতন্ত্রের ভ্রম; সাবজেক্টিভিটি ও ভাষার সীমাবদ্ধতা; মানুষের স্বপ্ন; ইগোর বিবর্তনসহ আরও অনেক অধ্যায় নিয়ে।

প্রতিটি অধ্যায় চিন্তার খোরাক জাগানিয়া। নিউরন নৌকায় ঝড় তোলার মতো এক অনন্য অভিজ্ঞতা। মনোবিজ্ঞানের নতুন কোনো দিক আবিষ্কৃত হয় পাঠকের কাছে। পাঠক নিজের ভেতর খানিকক্ষণ সাইলেন্ট হয়ে থাকে। ‘নিউরোদর্শন’ অথবা এর বেশ কিছু অধ্যায় পড়া শেষে জীবনকে দেখার ধরন বা পদ্ধতি বদলে যাবে পাঠকের– এ কথা নির্দ্বিধায় বলা যায়।

বইটি প্রথম প্রকাশিত হয় ২০২৩-এ, কলকাতার তবুও প্রয়াস প্রকাশনী থেকে। ২০২৪-এর নভেম্বরে বাংলাদেশের আদর্শ প্রকাশনী থেকে বইটির পরিবর্ধিত সংস্করণ প্রকাশিত হয়। অর্থাৎ এবারের ‘বইমেলার পাঠক’ শরিফুল ইসলামের লেখা ‘নিউরোদর্শন’ বইটি প্রথমবারের মতো হাতে পেতে যাচ্ছেন। 


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply