মেহেদী হাসান রোমান⚫
৩০ জুন, ২০০২। প্রশান্ত মহাসাগরের কোল ঘেঁষে জাপানের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর ও বন্দরনগরী ইয়োকোহামা যেন অপরূপ সৌন্দর্যে সেজেছে। এই প্রথমবার ইউরোপ আর আমেরিকার বাইরে ‘গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ আয়োজন করা হয়েছে এশিয়ায়, একেবারে প্রাচ্যে। আয়োজক জাপান ও দক্ষিণ কোরিয়া। কিছুক্ষণ আগেই শেষ হয়েছে শিরোপা নির্ধারণী মেগা ফাইনাল।
এক ভদ্রলোক বারপোস্টের ধার ঘেঁষে বসে আছেন। খুব মন খারাপ তার। নিজের সর্বোচ্চটা দিয়েও নিয়তি তার দলকে যে বিশ্বের সেরা প্রমাণে তীরে এসে তরী ডোবাতে বাধ্য করেছে। তিনি ইতিহাসে একমাত্র, যিনি পোস্ট পাহারায় থেকেও সেই ইভেন্টের দুইটি ব্যক্তিগত সেরা পদক জিতে নিয়েছেন। যার পদচারণা একটি বক্সের ভেতর, অথচ পুরো মাঠ দাপিয়ে বেড়ানো ফুটবলারদের টপকে সেরা খেলোয়াড়ের তকমা অর্জন করেছিলেন তিনি। এতকিছুর পরও মন খারাপ তার। দেশের জার্সিতে আরেকটা স্টার যে যুক্ত হলো না। থ্রি স্টার নিয়েই ফাইনাল হেরে বিদায় নিতে হলো জার্মানির।
মিস্টার কান, অলিভার কান। ভক্তরা তাকে ভালোবেসে ডাকতো ‘কিং কান’, ‘দ্য টাইটান’ নামে।

এরপর ১২টা বছর কেটে গেছে। ২০১৪ সালে তার উত্তরসূরীরা সেই ইয়োকোহামার শোধ নিয়েছে তাদেরই সেই প্রতিপক্ষের দেশে গিয়ে। বেলো হরিজন্তে’তে ব্রাজিলের বিপক্ষে জার্মানির সেই সেমিফাইনাল ক’জন ভুলতে পারেন?
ইউরোপিয়ানরা দক্ষিণ আমেরিকায় কোনোদিন শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পারেনি এর আগে। সেবার সেই ডিম্যানশাফট বাহিনী পেরেছে তাও লাতিনের আরেক শক্তিশালী দেশ ম্যারাডোনার আর্জেন্টিনাকে ফাইনালে হারিয়ে। সেদিন হয়ত খুশির কান্নাটা করেছিলেন বারপোস্টের নিচে ১২ বছর আগে মন খারাপ করে বসে থাকা লোকটি।
কে জানে, ইয়োকোহামার সেই বিকেলটা যদি জার্মানির হতো, অলিভার কান কে বিশেষায়িত করার কোনো বিশেষণ অভিধানে আমরা পেতাম কি না। হয়ত উনি লেভ ইয়াসিন না, অলিভার কান কি লেভ এর চাইতে খুব কমও ছিলেন?
হালের এমি মার্টিনেজ, স্টেগান, বেকার, ডি গিয়া, অভিজ্ঞ বুফন অথবা নয়্যার— এরাও কি অলিভার কান’কে বা অথবা তার সেই কিপারসত্ত্বাকে ছুঁয়ে দেখতে পেরেছেন নিজেদের সক্ষমতা দিয়ে? তর্ক সাপেক্ষে পেরেছেন। কারণ তালিকায় যে অনেকেই বিশ্বকাপজয়ী গোলকিপার। এরপরেও ‘কান অধ্যায়ে’ এসে প্রশ্ন যেন থেকেই যায়।
অলিভার কান ২০০২ বিশ্বকাপে জার্মানির ওয়ান ম্যান আর্মি ছিলেন— এটি বললে কেউ মানবেন না, এমন কাউকে পাওয়া মুশকিল। ব্রাজিল-স্পেন-ইংল্যান্ডের ফরোয়ার্ডরা যখন দলকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছিলেন গোল করে, কান জার্মানিকে যেন বয়ে নিচ্ছিলেন গোলপোস্ট পাহারায় রেখে। গোল্ডেন বলজয়ী প্রথম ও একমাত্র গোলকিপার যে তিনি।

১৯৯৪ ও ১৯৯৮ বিশ্বকাপে বেঞ্চ গরম করার পর ২০০২ সালে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হয় কানের। সেবার জার্মানির আর্মব্যান্ড ছিল তার হাতে। দলনেতা হিসেবে মাঠে সত্যিকার নেতৃত্ব দিয়েছিলেন সামনে নয়, পেছন থেকে। সেবার স্কোয়াডের পরিসংখ্যানে ফেভারিট তকমাটা ছিলো না জার্মানির ওপর। ভক্তদেরও হয়ত খুব বেশি প্রত্যাশা ছিল না।
কিন্তু কান তো গোলপোস্টের নিচে চীনের এক দুর্ভেদ্য প্রাচীর। সেবারের আসরে নিজেদের দ্বিতীয় ম্যাচের ইনজুরি সময়ে জার্মানির বিপক্ষে একটি গোল করেছিলেন আইরিশ স্ট্রাইকার রবি কিন। এরপর ফাইনাল পর্যন্ত টানা চার ম্যাচে কান-দেয়ালে চিড় ধরাতে পারেনি কোনো দল। একের পর এক ক্লিন শিট।

গ্রুপ পর্বে সৌদি আরব, আয়ারল্যান্ড ও ক্যামেরুন অধ্যায় শেষ করে নকআউটের রাউন্ড অব সিক্সটিনে প্যারাগুয়ে, কোয়ার্টার ফাইনালে যুক্তরাষ্ট্র ও সেমিতে স্বাগতিক দক্ষিণ কোরিয়ার বিপক্ষে অতন্দ্র প্রহরী হয়ে ছিলেন কান।
ইয়োকোহামার মেগা ফাইনালও তিনি খেলতে নেমেছিলেন ডান হাতের আঙ্গুলে চিড় ও ব্যাথা নিয়ে। সেই খেসারতও তাকে দিতে হয়েছে হাতেনাতে। পরাস্ত করতে পারেননি তর্কসাপেক্ষে বিশ্বের সেরা নাম্বার নাইন রোনালদো নাজারিওকে। ফাইনালের আগে সেবার চ্যাম্পিয়ন হওয়া ব্রাজিলের গোলরক্ষক পজিশনে থাকা কিপারও গোল হজম করেছিলেন ৪টি, কান ১টি।

হয়ত বিশ্বসেরার শিরোপাটা দেশকে উপহার দিতে পারেননি কান। তার মানে এই না, তার আগের সব বীরত্বগাঁথা একেবারে মিথ্যা হয়ে যাবে। আসরে সেরা গোলরক্ষকের পুরস্কার গোল্ডেন গ্লাভসের পাশাপাশি তাই সেরা খেলোয়াড়ও কান। গোল্ডেন বল জেতা একমাত্র গোলকিপার— আজও এই তকমায় ভাগ বসাতে পারেনি কেউ।
সেই ফাইনালে হারের পর বিশ্বকাপে আরও একটি ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি। ২০০৬ বিশ্বকাপে তিনি জার্মানির নম্বর ওয়ান জার্সি পাননি কান। তবে সেমিতে জার্মানি হেরে গেলে তৃতীয় স্থান নির্ধারনী ম্যাচে পর্তুগালের বিপক্ষে মাঠে নেমেছিলেন তিনি। দলও জিতেছিল।

মারাকানায় ফিলিপ লাপ যখন ট্রফি উঁচিয়ে ধরছিলেন তখন কান সাহেব হয়ত আবার ইয়োকোহামায় ফিরে গিয়েছিলেন। অনুশোচনা করছিলেন কেন দুইবার রোনালদোকে আটকাতে পেরেছিলেন না তিনি। ২০০২ বিশ্বকাপে জার্মানি বলতে অলিভার কানের জার্মানিকেই হয়ত বোঝে সবাই। জার্মানির স্টার আরও একটা বেশি থাকতে পারতো আজ।
/এমএইচআর
Leave a reply