সুখ যেন এক আপেক্ষিক শব্দ। আসলে এটি কোথা থেকে আসে? এর পরিমাণ মাপার কোনো স্কেল কি আদৌ আছে? হয়ত পরিমাপ করা যায় না, তবে কারও ব্যহ্যিক অনুষঙ্গ এবং সার্বিক বহিঃপ্রকাশ দেখে কিছুটা আঁচ করা যায়। আদতে সুখ হলো মনের একটি অবস্থা যা ভালোবাসা, তৃপ্তি, আনন্দ বা উচ্ছ্বাস দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। সঠিকভাবে সুখ পরিমাপ করা অত্যন্ত কঠিন।
প্রচলিত মিথ কিংবা বিশ্বাস— অনেকদিন ধরে ধারণা করা হতো যে, সুখ একটি বক্ররেখা অনুসরণ করা মানসিক অবস্থা। এটি শৈশবে বেশি থাকে, মধ্যবয়সে কমে যায় ও বার্ধক্যে পুনরায় বাড়ে। তবে, সুখ যেহেতু আপেক্ষিক, তাই সেই ধারণাটি যে অপরিবর্তিত থাকবে এর মানেও নেই।
ছয়টি ইংরেজিভাষী দেশের (অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, আয়ারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্র) তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তৈরি নতুন এক গবেষণাপত্রে দেখা গেছে, বর্তমান তরুণরা আগের প্রজন্মের তুলনায় অনেক কম সুখী।
জাতিসংঘের অর্থায়নে পরিচালিত এই গবেষণা যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ন্যাশনাল ব্যুরো অব ইকোনমিক রিসার্চ (NBER)-এ প্রকাশিত হয়। গবেষণাটি যৌথভাবে পরিচালনা করেন সান ডিয়েগো স্টেট ইউনিভার্সিটির মনোবিজ্ঞানী জিন টুয়েঙ্গি এবং ডার্টমাউথ ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ ডেভিড জি. ব্ল্যাঞ্চফ্লাওয়ার। তারা ১১টি সমীক্ষার তথ্য বিশ্লেষণ করেছেন। অঞ্চলভেদে গবেষণাগুলোও প্রায় একই ধরণের ইঙ্গিত দিয়েছে। সার্বিক প্রেক্ষাপটে তাই গবেষণাটি বর্তমান বিশ্বের প্রজন্মের ক্ষেত্রে যথার্থ- এটি বলা যায়।
গবেষণায় কী পাওয়া গেছে?
গবেষকদের মতে, ১২ থেকে ২৫ বছর বয়সী তরুণদের মধ্যে বিশেষভাবে উদ্বেগ ও বিষণ্নতা বৃদ্ধির প্রবণতা দেখা গিয়েছে। তারা মানসিকভাবে বেশি চাপে থাকছেন, যা মাত্র কয়েক বছর আগের তরুণদের মধ্যে ছিল না। একইভাবে, প্রবীণদের মধ্যে বয়স বৃদ্ধির সাথে সাথে জীবনের প্রতি সন্তুষ্টি বেড়েছে।
এই ধরণের পরিবর্তন বিশেষজ্ঞদের মধ্যে উদ্বেগের সৃষ্টি করেছে। কারণ, তরুণ প্রজন্ম মহামারী পরবর্তী পৃথিবীতে ডিজিটাল প্রযুক্তির প্রসার এবং অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মতো নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হচ্ছে। তাদের দেখার ব্যপ্তির যে পরিসর, তা অনেক বিস্তর। যেখানে হওয়ার কথা ছিল আরও প্রফুল্ল, সেখানে তরুণরা যেন মানসিকভাবে খেই হারিয়েছে।
তরুণদের সুখ কমে যাওয়ার কারণ কী?
গবেষকদের তথ্য অনুসারে, তরুণদের সুখ কমে যাওয়ার অন্যতম প্রধান কারণ ইন্টারনেটের অতিরিক্ত ব্যবহারের সাথে ব্যক্তিগত বিভিন্ন ইলেকট্রনিক ডিভাইসে আসক্ত হয়ে পড়া, যার মধ্যে প্রথমেই আসে স্মার্টফোন।
গবেষণায় বলা হয়েছে, যেসব তরুণরা ইন্টারনেট ব্যবহার করেন, তাদের মধ্যে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার হার বেশি।
গবেষক ব্ল্যাঞ্চফ্লাওয়ার বলেন, ইন্টারনেটই প্রধান কারণ, অন্য কিছু এই তথ্যের সাথে খাপ খায় না।
গত বছরের একটি জরিপে দেখা গেছে, তিন-চতুর্থাংশ মার্কিন কিশোর-কিশোরী তাদের স্মার্টফোন ছাড়া বেশি শান্ত ও সুখী অনুভব করে। আরেক গবেষণায় দেখা গেছে, ব্রিটিশ কিশোর-কিশোরীরা ইউরোপের মধ্যে সবচেয়ে কম সুখী, এবং এর জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমকে দায়ী করা হয়েছে।
ইউরোপ-উত্তর আমেরিকার পাশাপাশি ব্ল্যাঞ্চফ্লাওয়ারের গবেষণা আফ্রিকা, মধ্যপ্রাচ্য ও লাতিন আমেরিকার তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছে যে যেখানে তরুণদের স্মার্টফোন ব্যবহারের হার কম, সেখানে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা তুলনামূলক অনেকটাই কম।
২০২৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত ব্ল্যাঞ্চফ্লাওয়ারের আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছে, আফ্রিকার প্রায় অর্ধেক জনগোষ্ঠী কখনও ইন্টারনেট ব্যবহার করেনি। অন্য অঞ্চল বা মহাদেশভিত্তিক অনুপাতে দেখা যায় আফ্রিকার তরুণদের মানসিক স্বাস্থ্যের অবনতি তুলনামূলক কম হয়েছে ইউরোপ-আমেরিকা-এশিয়ার তরুণদের তুলনায়।
আরও যেসব কারণ রয়েছে
সুখ বা মানসিক শান্তি কমে যাওয়ার ক্ষেত্রে শুধু ইন্টারনেটই নয় আরও কিছু উপাদান রয়েছে যা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে জড়িত। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো:
অর্থনৈতিক সংকট: জীবনযাত্রার ব্যয় বৃদ্ধি, চাকরির নিরাপত্তাহীনতা ও আয়বৈষম্য তরুণদের ওপর মানসিক চাপ তৈরি করছে।
একাকিত্ব: সরাসরি মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ কমে যাওয়ায় অনেক তরুণ মানসিকভাবে বিচ্ছিন্ন অনুভব করছেন।
সামাজিক যোগাযোগের পরিবর্তন: গবেষণা বলছে, তরুণদের সরাসরি যোগাযোগের হার কমে যাচ্ছে, এবং তারা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে বেশি সময় ব্যয় করছে।
২০২৪ সালের ওয়ার্ল্ড হ্যাপিনেস রিপোর্ট বলছে, বিশ্বব্যাপী ৩০ বছরের কম বয়সীদের সুখ উল্লেখযোগ্যভাবে কমেছে, বিশেষ করে কোভিড-১৯ মহামারির পর। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এই প্রথম বিশ্বের ২০টি সবচেয়ে সুখী দেশের তালিকা থেকে বেরিয়ে গেছে। গবেষকরা বলছেন, এই প্রবণতা থামাতে আরও গবেষণা এবং নীতিগত উদ্যোগ প্রয়োজন।
কিন্তু ব্ল্যাঞ্চফ্লাওয়ার খুব একটা আশাবাদী নন। তিনি বলেন, যুবকদের সুখ কমতেই থাকছে এবং এটি বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়ছে। নিজ পরামর্শে তিনি বলেছেন, ফোন থেকে দূরে থাকুন এবং অন্যদের সাথে সরাসরি যোগাযোগ করুন।
যেভাবে তরুণরা সুখের পথ খুঁজে নিতে পারে
সুখ আদতে কোনো মরিচীকা নয়, একে ধরা যায়। এর জন্য প্রয়োজন জীবনযাত্রা বা অভ্যাসে পরিবর্তন আনা। আরও কিছু কাজ করা যেতে পারে:
বাস্তব জীবনের যোগাযোগ বাড়াতে হবে। পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সরাসরি সময় কাটানোর পাশাপাশি আউটডোর অ্যাক্টিভিটিতে অংশ নিতে হবে। দিনে অন্তত ২-৩ ঘণ্টা এবং সপ্তাহে ১ দিন ‘ডিজিটাল ফাস্টিং’ বা সোশ্যাল মিডিয়াসহ ইলেকট্রনিক্স ডিভাইস থেকে বিরতি নেয়া।
বর্তমান প্রজন্মকে মানসিক স্বাস্থ্যকে গুরুত্ব দেয়া শিখতে হবে। পর্যাপ্ত ঘুম, ব্যায়াম, ও স্বাস্থ্যকর খাদ্য গ্রহণের পাশাপাশি মেডিটেশন ও যোগব্যায়াম চর্চা ভালো একটি অভ্যাস হতে পারে।
সবশেষে, আত্মিক ও অভ্যন্তরীণ শান্তির জন্য ভালো জীবনযাত্রার পাশাপাশি ধর্মীয় অনুশাসন ও প্রার্থনাও একটি ভালো ইতিবাচক দিক এনে দিতে পারে। নিউরণের হরমোন যেন নেতিবাচক কিছু পরিবহন না করে, এর জন্য তরুণদের নিজেদেরই সচেতন হতে হবে।
/এমএইচআর
Leave a reply