মেহেদী হাসান রোমান⚫
বিশ্বকাপ ক্রিকেটে সবচেয়ে সফল দল কোনটি? শিরোপার সংখ্যায় এগিয়ে থাকা কিংবা প্রতিপক্ষ দলকে সর্বাধিকবার হারিয়েছে কারা?— এমন প্রশ্নে সবাই একসুরে উত্তর দেবে, দলটি অস্ট্রেলিয়া। দ্য মাইটি অজিরা ছয়বারের বিশ্বচ্যাম্পিয়ন তো বটেই, সবচেয়ে বেশিবার ফাইনাল খেলা দলও। ১৯৭৫ ও ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপে রানার্স আপ হয় অস্ট্রেলিয়া। ১৩টি আসরের মধ্যে কেবল ৫ বার অজিদের ছাড়া গড়িয়েছে বিশ্বকাপের শিরোপা নির্ধারণী ম্যাচ। একবার ভাবুন কতটা অপ্রতিরোধ্য তারা এই টুর্নামেন্টের আসরগুলোতে। তবে, এর বাইরেও একটা সময়কে আলাদাভাবে মনে রাখে ক্রিকেট ভক্তরা। অজিদের একটি প্রজন্ম টানা তিনটি বিশ্বকাপ জিতেছিল। প্রায় ৪ হাজার দিনেরও বেশি সময় ধরে অস্ট্রেলিয়াকে বিশ্বকাপে হারাতে পারেনি কোনো দল।
লর্ডস থেকে শুরু হয়ে বার্বাডোস। উপমহাদেশের তিন ক্রিকেট পরাশক্তি পাকিস্তান, ভারত ও শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে হ্যাটট্রিক শিরোপাও জিতেছিল অস্ট্রেলিয়া। এর সামনে-পেছনেও রয়েছে আরেক অধ্যায়। বিশ্বকাপে টানা ৩৪ ম্যাচ অপরাজিত থাকা এক দলের গল্প।
সেই আধিপত্যের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া শেষবার হেরেছিল পাকিস্তানের কাছে। আবার সেই রেকর্ড থামে পাকিস্তানে কাছেই হেরে। লীডস থেকে কলম্বো, চার হাজার দিনের সেই রেকর্ড ভাঙার সাধ্য কার? আগের শতাব্দীর শেষ দশক থেকে নতুন শতাব্দীর প্রথম দশকেও অপরাজিত অস্ট্রেলিয়া, ১৯৯৯ থেকে ২০১১।
অপরাজিত একটি আপেক্ষিক বিষয়, এখানে না হারার পাশাপাশি ম্যাচ টাই কিংবা বৃষ্টিতে পরিত্যক্ত হওয়ার ইস্যুও চলে আসে। যদি এসব পরিসংখ্যানের বাইরে ‘শুধু জয়’কে মানদণ্ডে রাখা হয়, তাহলেও সেটি টানা ২৫ ম্যাচের। কারণ, ১৯৯৯ বিশ্বকাপের সেমিফাইনালে প্রোটিয়াদের বিপক্ষে অজিদের ম্যাচটি টাই হয়। অপরদিকে, ২০১১ বিশ্বকাপে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ম্যাচে মাঠে নামতে পারেনি অজিরা। ম্যাচটি পরিত্যক্ত হয় বৃষ্টিতে। এই দুই ম্যাচের মাঝে শুধুই জয়ের গল্প, প্রতিপক্ষদের টানা হারানোর একাধিপত্য। প্রতিটি ম্যাচের পর পুরস্কার বিতরণী মঞ্চে অস্ট্রেলিয়ার ক্যাপ্টেনের ডাক পড়তো প্রতিপক্ষ দলের অধিনায়কের পরে, কারণ সে জয়ী অধিনায়ক।
২৩ মে, ১৯৯৯। হেডিংলি ক্রিকেট গ্রাউন্ডের এক পড়ন্ত বিকেল। দিবা-রাত্রির ম্যাচে পাকিস্তানের মুখোমুখি গতবারের রানার্সআপ অস্ট্রেলিয়া। অধিনায়ক স্টিভ ওয়াহ টস জিতে ওয়াসিম আকরামের দলকে ব্যাট করার আমন্ত্রণ জানান। সেবারের আসরে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে আসর শুরু করলেও প্রতিবেশী নিউজিল্যান্ডের কাছে পরাজয়ের তিক্ত স্বাদ পায় অজিরা। পাকিস্তানও স্কটিশ ও ক্যারিবিয়ানদের বিপক্ষে জয় নিয়ে নিজেদের তৃতীয় ম্যাচ খেলতে নেমেছে। ইনজামাম ও রাজ্জাকের জোড়া ফিফটিতে ভর করে ২৭৫ রানের সংগ্রহ পায় পাকিস্তান। জবাবে, মাইকেল বেভানের হাফ সেঞ্চুরির সাথে স্টিভ-মার্ক সহোদরের পাশাপাশি পন্টিংয়ের ‘নার্ভাস ফিফটি’। তীরে এসে তরী ডোবে অজিদের। মাত্র ১০ রানে হার।

হেডিংলি ক্রিকেট গ্রাউন্ড, লীডস (২৩ মে, ১৯৯৯)।
লীডসের সেই হারের পর কী যে হলো অস্ট্রেলিয়ার? তখনকার যুগে ইউটিউব থাকলে ‘বিশ্বকাপের ম্যাচ কীভাবে জিততে হয়’— এমন একটি ভিডিও তৈরি করতে খোদ অস্ট্রেলিয়ান ক্রিকেট বোর্ডকে (সিএ) হয়ত অনুরোধ করত বাকি সব দলগুলো।
পাকিস্তানের বিপক্ষে হারের সেই প্রতিশোধ ফাইনালে বেশ ভালোভাবেই নিয়েছিল স্টিভ ওয়াহ’র দল। তাদের হারিয়েই ১৯৮৭ সালের পর নিজেদের দ্বিতীয় শিরোপা ঘরে তোলে অস্ট্রেলিয়া। সেইসাথে লাহোরের গাদ্দাফি স্টেডিয়ামে ‘লঙ্কান রাবনদের’ কাছে বধ হওয়ার সেই জ্বালায় কিছুটা প্রলেপ দিতে পেরেছিল ওয়ার্ন-ম্যাকগ্রা’রা।
এরপর পৃথিবীতে নতুন এক শতাব্দী আসে। তারও এক দশক পেরিয়ে যায়। আটলান্টিক-প্রশান্ত মহাসাগরে ট্রিলিয়ন কোটি পানির চক্র সম্পন্ন হয়। বাটারফ্লাই ইফেক্টের মতো ঢাকায় একটি পাখি উড়ে যাওয়ার ফলে সেই ডানার ঝাপটা ও বাতাসের রেশে বুলাওয়েতে তুফান শুরু হয়েছিল কি না, তা আমাদের জানা নেই। তবে এর মাঝে অস্ট্রেলিয়ার রাডারে ‘হেরে গেছি’ ধরনের কোনো তরঙ্গ ধরা দেয়নি।
সেবার লর্ডসে ওয়াসিমকে থামিয়েই ক্ষান্ত হয়নি অজিরা। পরের দুই আসরে সৌরভ গাঙ্গুলি কিংবা মাহেলা জয়াবর্ধনেকে ২০১৪ সালের লিওনেল মেসি বানিয়ে দিয়েছিল রিকি পন্টিং বাহিনী। কলকাতার বেহালায় দাদাগিরি কিংবা কলম্বোতে উদযাপনের দোল খেলা হতে দেয়নি সেই অস্ট্রেলিয়া।

তবে সবকিছুরই তো শেষ আছে। অজিদের সেই একাধিপত্যেরও ইতি ঘটে। ১৯ মার্চ, ২০১১। রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়ামে টস জিতে ব্যাট করার সিদ্ধান্ত নেয় অজি অধিনায়ক পন্টিং। উমর গুল-রাজ্জাক-রিয়াজদের সামনে খেই হারায় ওয়াটসন-ক্লার্ক-হাসি-স্মিথরা। ১৭৭ রানের লক্ষ্যে ব্যাট করতে নেমে অর্ধশত বল বাকি থাকতেই জয়ের বন্দরে নোঙর করে শহিদ আফ্রিদির দল।

রানাসিংহে প্রেমাদাসা স্টেডিয়াম, কলম্বো (১৯ মার্চ, ২০১১।
শেষ হয় ৪ হাজার ৩১৮ দিনের এক বর্ণালী অধ্যায়। আরও ভালোভাবে বললে, ১১ বছর ৯ মাস ২৪ দিনের অজি আধিপত্য। যে গল্পের শুরু ও শেষে পাকিস্তান। লীডস থেকে কলম্বো, দুই প্রান্তে পাকিস্তানের কাছে হারের মধ্যবর্তী সময়ে বিশ্বকাপে অস্ট্রেলিয়াকে হারাতে পারেনি কেউ। এমনকি, এর মাঝে ২০০৩ সালে জোহানেসবার্গেও একে অপরের মুখোমুখি হয়েছিল তারা। সেবার অ্যান্ড্রু সায়মন্ডস ঝড়ে উড়ে গিয়েছিল ওয়াকার ইউনিসের পাকিস্তান।
/এমএইচআর
Leave a reply