‘চার পাণ্ডবের’ শুরুর সাথে আইরিশ ঝলক, একই দিনে বিষাদের সুর ভারত-পাকিস্তানে

|

মেহেদী হাসান রোমান⚫

পোর্ট অব স্পেন থেকে কিংস্টনের দূরত্ব ১ হাজার ৯০০ কিলোমিটারের মতো। রাহুল দ্রাবিড় ও ইনজামাম-উল-হক এতো দূরত্বে দাঁড়িয়ে আছেন। শেষ বিকেলে পশ্চিম আকাশে হেলে পড়া সূর্যের দিকে তাকিয়ে দু’জনই। বিষাদ ভর করেছে ভারত-পাকিস্তান জুড়ে। সাধারণত ভারতের পতাকার অশোক চক্রের সেই নীল বৃত্ত থেকেই অনুপ্রাণিত হয়ে আন্তর্জাতিক যত ইভেন্টে দেশটি অংশ নেয়, তাদের জার্সির রং হয় নীল। সেবার একটু বেশিই হালকা নীল জার্সি বানিয়ে দিয়েছিল ভারতীয় ক্রিকেট বোর্ড (বিসিসিআই)। নীল রং সেবার যতটা হালকা হয়েছিল, গোধূলি লগ্নের গোল্ডের আওয়ার আলোতে রাহুলের মুখ ততটাই ফ্যাকাশে দেখাচ্ছিল। কিংস্টনে অবশ্য বৃষ্টি হয়েছে। তাই ইনজামামের মুখে কালো মেঘের আনাগোনা।

১৮ বছর আগে তেমনই এক বিকেল দেখেছিল ক্রিকেট বিশ্ব। দক্ষিণ এশিয়ায় অবশ্য বিকেল নয়, রাত ১২টা পার হয়ে পরদিন এসে গেছে। ক্যালেন্ডারে তারিখও পরিবর্তন হয়ে গেছে। একই দিন দুই ফেভারিট ভারত-পাকিস্তানের হার। এক দলের তো বিদায় ঘণ্টা বেজেই গেছে। ঘটনার নেপথ্যে বাংলাদেশ ও নবাগত আয়ারল্যান্ড। ২০০৫ সালে আইসিসি ট্রফিতে (এখন যে টুর্নামেন্টের নাম আইসিসি বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব) রানার্সআপ হয়ে আইরিশরা প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপ আঙ্গিনায়। পাকিস্তানের মতো ‘আনপ্রেডিক্টেবল’ দলের সমর্থকরা অবশ্য এসব দেখে অভ্যস্ত। ১৯৯৯ বিশ্বকাপেও প্রথমবার খেলতে আসা বাংলাদেশের কাছে হেরেছে তারা।

বিশ্বকাপ ক্রিকেটের নবম আসর বসেছিল আটলান্টিকের উপকন্ঠে ক্যারিবিয়ান দ্বীপপুঞ্জে। ইতিহাসে সর্বাধিক দল নিয়ে অনুষ্ঠিত ২০০৭ সালের সেই আসরের একটি দিন বিস্মিত করেছিল ক্রিকেট বিশ্বকে। একই দিন বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ডের কাছে হেরেছিল বিশ্বকাপের দুই হট ফেবারিট ভারত-পাকিস্তান। কেমন ছিল পোর্ট অব স্পেন এবং সাবিনা পার্কের সেই বিকেল?

বিশ্বকাপ ক্রিকেট ২০০৭’র লোগো।

সেবারের আসরে প্রতিটা গ্রুপের জন্য একটি করে মাঠ রেখেছিল আয়োজক ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ড। ওয়েস্ট ইন্ডিজের বেশিরভাগ মাঠে ফ্লাডলাইট না থাকায় আসরের সব ম্যাচ হয় দিনের আলোয়।

১৭ই মার্চ জ্যামাইকায় ‘ডি’ গ্রুপের ম্যাচে মুখোমুখি হয় পাকিস্তান-আয়ারল্যান্ড। অপরদিকে ত্রিনিদাদে ‘বি’ গ্রুপে বাংলাদেশ-ভারত ম্যাচ।

ব্রায়ান লারার দেশ ত্রিনিদাদ ও টোবাগো। দেশটির রাজধানী পোর্ট অব স্পেনের কুইন্স পার্ক ওভালে বাংলাদেশ নামে আগের আসরের রানার্সআপ ভারতের বিপক্ষে। আগেরদিন সতীর্থ মানজারুল ইসলাম রানার মৃত্যুতে শোকে মুহ্যমান টাইগাররা। হাবিবুল বাশার টস করতে নামলেন রাহুল দ্রাবিড়ের সাথে। টস জিতে ব্যাটিংয়ে ভারত।

বীরেন্দ্র শেবাগের স্ট্যাম্প উপড়ে ফেলা মাশরাফীর সেই ডেলিভারিটা আজও কেউ ভুলতে পেরেছে বলে মনে হয় না। সেদিন টাইগারদের ওপর ঐশ্বরিক একটা সুন্দর মোমেন্টাম ভর করেছিল। শুরু থেকেই আক্রমণাত্বক ভঙ্গি কিংবা শরীরী ভাষায় তারা ছিল উজ্জীবিত। একমাত্র কলকাতার মহারাজা সৌরভ গাঙ্গুলি ছাড়া ভারতের হয়ে পঞ্চাশ পেরোতে পারেনি কেউ। রবিন উথাপ্পার ক্যাচ হাতে নেবার পর আফতাব আহমেদ সেই যে শুরু করলেন দুই হাতের কনুই ভাঁজ করা একটা সেলেব্রেশন, সেটি আসরের বাকি ম্যাচগুলোতে উইকেট পাওয়ার পর উদযাপনে একটি আবশ্যিক রূপ নেয়।

শেবাগের স্ট্যাম্প উপড়ে মাশরাফীর উদযাপন।

রাজ্জাকের বলে মুশফিকের হাতে শচীনের ক্যাচটি যেভাবে ধরা দিয়েছিল কিংবা ধোনি-হরভজন-অজিত টানা তিন ব্যাটারের শূন্য রানে ফেরাটা। ভারতের এরকম অসহায়ত্ব বিশ্বকাপের ম্যাচে কোনদিন দেখা যায়নি। যুবরাজ সিং মাঝপথে লাগাম টানার চেষ্টা করলেও বেশিদূর নিতে পারেননি। এরচেয়ে টেলএন্ডার জহির খানের ১৫ কিন্তু ১৫৯ রানে ৯ উইকেট পড়ে যাওয়া ভারতের রানকে একটা সম্মানসূচক অবস্থানে দাঁড় করিয়েছিল।

ইনিংসের প্রথম দুই আর শেষের দুই এর চার উইকেট মাশরাফীর। কিন্তু মাশরাফী শেবাগ-উথাপাকে বিদায় করে যে রেশটা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন সেটিই তো গ্রহণ করেছিলো রাজ্জাক-রফিকরা। তারাও পেয়েছিলো ৩টি করে উইকেট।

সাকিব-তামিমের কিংবদন্তি হয়ে ওঠার আভাস। দ্বায়িত্ব নেয়া কিংবা শুরুটা কি এখান থেকেই?

১৯২ রানের টার্গেট। সাবিনা পার্কের দুপুর। ১৭ বছরের কিশোর তামিম ইকবালকে নিয়ে মাঠে নামলেন সহ-অধিনায়ক শাহরিয়ার নাফিস। নাফিস দ্রুত প্যাভিলিয়নে ফিরলেও তামিমের ডাউন দ্য উইকেটে এসে অভিজ্ঞ জহির খানের বল গ্যালারিতে আছড়ে ফেলে দেবার সেই সাহসে হতবাক হয়েছিল ভারতীয় দর্শক-সমর্থকরা। দলীয় ৬৯ রানে তামিম আউট হন। এর মাঝে দুজন ব্যাটার এসে গেছেন ক্রিজে। কিন্তু তামিমের রান তখন ৫১! সাকিব আল হাসানকে ধারভাষ্যকাররা বারবার সাকিবুল হাসান নামে সম্বোধন করছিল। কে জানতো সাকিব বছর দুয়েকের মাঝেই বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডারের জায়গায় আসবে। সাকিবের ব্যাট থেকে আসে ৫৩ রান।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মাঝরাতে বিজয় মিছিল। বাংলাদেশের জয়।

অধিনায়ক বাশারের ব্যাট হাসেনি। তবে মুশফিক যখন মুনাফ প্যাটেলের বলকে বাউন্ডারি পার করে জয় নিশ্চিত করলেন তখন তার রান দলীয় সর্বোচ্চ ৫৬।

একটা বিষয়, তামিম-সাকিব-মুশফিক এই তিনজনের প্রথম বিশ্বকাপ ম্যাচ। তিনজন মিলে ১৬০ রান। ‘ঐ নূতনের কেতন ওড়ে’ কবিতার লাইনটি এর চেয়ে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়তো হবে না। সেইসাথে মাশরাফী। বাংলাদেশের পরবর্তী ক্রিকেট যুগে ‘পঞ্চপাণ্ডব’ তত্ত্বের সূচনা কি এখান থেকেই? প্রশ্ন থেকেই যায়। যদিও ততদিনে মাহমুদউল্লাহ জাতীয় দলে আসেনি। ‘চারপাণ্ডব’ বলা যায়। ৫ উইকেটে জিতে গেল বাংলাদেশ। শ্রীলঙ্কার কাছে হারলেও বারমুডাকে হারিয়ে সেবার সুপার এইটে ওঠে টাইগাররা।

বাংলাদেশে তখন রাজনৈতিক অস্থিরতা চলে। কিন্তু এর মাঝেও সারাদেশে আনন্দের শোভাযাত্রা বের করার উপলক্ষ এনে দিয়েছিল আমাদের ক্রিকেট দল। একের পর এক ট্রিবিউট গান, বিজ্ঞাপন তৈরি হতে থাকে ম্যাচের পরদিন থেকে। ১৭ই মার্চ, ২০০৭ আটলান্টিকের পাড়ে এক মহাকাব্য রচনা করেছিল বাংলাদেশ দল।

ম্যাচ জিতে মুশফিক-আশরাফুলের চওড়া হাসি।

একই সময় যখন পোর্ট অব স্পেনে ভারত বধ করছিল বাংলাদেশ। একই সাথে আসরের অন্য ম্যাচে মাঠে নেমেছিল পাকিস্তান। প্রতিপক্ষ প্রথমবার বিশ্বকাপের মঞ্চে আসা আয়ারল্যান্ড। আসরের উদ্বোধনী ম্যাচে স্বাগতিক ওয়েস্ট ইন্ডিজের কাছে হেরে গিয়েছিল ইনজামামের দল, অপরদিকে জিম্বাবুয়ের সাথে ম্যাচ টাই করে আয়ারল্যান্ড।

আইরিশ অধিনায়ক ট্রেন্ট জনসন টস জিতে ফিল্ডিংয়ে নামেন তার দল নিয়ে। স্মিথ-বোথা-জনসনরা মিলে পাকিস্তানের টপ অর্ডার দুমড়ে মুচড়ে দেয় অনায়সেই। অতিরিক্ত ২৯ রান আসলেও পাকিস্তান অলআউট হয় ১৩২ রানে। দলের ৮ ব্যাটার আউট হয় এক অঙ্কের রানে। সর্বোচ্চ রান কামরান আকমালের ২৭!

শোয়েব মালিকের উইকেটে আইরিশদের উদযাপন।

১৩৩ রান টার্গেট! কিন্তু না বৃষ্টি বিলম্বে খেলা নেমে আসে ৪৭ ওভারে। নতুন টার্গেট ১২৮ রান। কী এমন আহামরি! কিন্তু পাকিস্তান মানে তো ‘আনপ্রেডিক্টেবল’। মোহাম্মদ সামির জোড়া আঘাতে শুরুতেই চাপে পরে আইরিশরা। ২০১৯ সালে ইংল্যান্ডকে বিশ্বকাপ জেতানো অধিনায়ক মরগান তখন খেলতেন আয়ারল্যান্ডের হয়ে। ৭০ রানে ৪ উইকেট পড়লে পাকিস্তান লড়াই করতে থাকে ম্যাচে ঘুরে দাঁড়াবার। কিন্তু নেইল ‘ও ব্রেইন এর ৭২ রান তো অর্ধেক কাজ করে দিয়েছিল আইরিশদের। ৩২ বল বাকি থাকতে ম্যাচ যেতে আয়ারল্যান্ড।

এই স্কোরবোর্ড আইরিশদের জেতার চেয়েও বেশি বলে দিচ্ছিল বিশ্বকাপে পাকিস্তানের বিদায়।

স্কোর বোর্ডে যখন ইংরেজিতে লেখা ওঠে ‘আয়ারল্যান্ড উইন বাই থ্রি উইকেটস’ এটি একই সাথে আইরিশদের সুপার এইটে যাত্রা নিশ্চিত, সেইসাথে প্রথম দল হিসেবে পাকিস্তানের বিশ্বকাপ ২০০৭ থেকে বিদায় ঘণ্টা বাজার দামামা বটে।

আসরের সবচেয়ে বেদনাকাতর ঘটনা ঘটে সেদিন ম্যাচের পর। হোটেলে নিজের রুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় পাকিস্তান কোচ বব উলমারকে। সেই ঘটনার কারণ কী ছিল? দলের বাজে পারফরম্যান্সের জন্য মানসিক চাপ, নাকি অন্যকিছু?— এই প্রশ্নটা থেকে যায় এখনও। কিংস্টনের একটি হোটেলের ৩৭৪ নম্বর রুমের বাথরুমে উলমারের মরদেহ পাওয়া যায়। পাকিস্তানি দলের কিছু খেলোয়াড়কে জেরা করার সঙ্গে ঘটনাটি গড়ায় আদালত পর্যন্ত। তবে, সুনির্দিষ্টভাবে কোনো সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে না পারায় শেষ পর্যন্ত ধরে নেয়া হয়েছিল, স্বাভাবিক মৃত্যুই হয়েছে ববের।

পাকিস্তানের কোচ বল উলমারের কফিন। আয়ারল্যান্ড ম্যাচের পরদিন তাকে হোটেলে রুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায়।

১৮ বছর পার হলেও ২০০৭ সালের ১৭ই মার্চ বিশ্ব ক্রিকেটের এক অভূতপূর্ব দিন। কেউ একে বিশ্বকাপের অঘটনের দিন বলে, কেউ বলে টুর্নামেন্টের সৌন্দর্য। আসলে কী? কুইন্স পার্ক ওভাল আর সাবিনা পার্কে কী হয়েছিল সেদিন? বাংলাদেশ-আয়ারল্যান্ড রুপকথা নাকি পাক-ভারতের বিষাদময় দিনের সাক্ষী হওয়া। সিন্ধু কিংবা গঙ্গার স্রোতকে শোকে স্তব্ধ করে দিয়েছিল বাশার-জনস্টনের দল।

আর ববের ট্র্যাজেডিক প্রস্থান— যা মেনে নেবার মতো না।

/এমএইচআর


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply