আলো-আঁধারির ছায়া হলে হিজল বনে ডেকে ওঠে ডাহুক। বানের তোড়ে ওই দূরে জেগে ওঠে ভৈরবী নহর। জোনাক পোকার মতো আলো ছড়াতে থাকেন মহাপ্রাণ কিছু মানুষ। তারা অন্ধকারে প্রদীপ হয়ে জ্বলে ওঠেন। তাদের একজন ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল, ‘আলোর নারী’ নামে যার পরিচয়।
নাইটিঙ্গেল ছিলেন আধুনিক নার্সিংয়ের জননী ও স্বাস্থ্যসেবার একজন অগ্রদূত। তিনি ১৮২০ সালের ১২ মে ইতালির ফ্লোরেন্স শহরে জন্মগ্রহণ করেন। ওই শহরের নামেই তার নামকরণ। তার ধনী ইংরেজ পরিবার সে সময়ে ভ্রমণে থাকায় নাইটিঙ্গেলের জন্মস্থান ইতালি। ইংল্যান্ডে ফিরে এসে নাইটিঙ্গেল পরিবার ডার্বিশায়ারের লি হার্স্ট ও হ্যাম্পশায়ারের এম্বলি নামক দুটি বাড়িতে বাস করতো।
শৈশবে ফ্লোরেন্স তার বাবার কাছে শিক্ষা লাভ করেন। সে সময়ে মেয়েদের জন্য নার্স হওয়া সামাজিকভাবে মর্যাদাপূর্ণ পেশা ছিল না। পরিবার তার বিয়ে ও সংসারে মাতলেও কিশোরী ফ্লোরেন্সের মনে ছিল অন্য চিন্তা। তার অহর্নিশ মনে হতো– ঈশ্বর তাকে দরিদ্র ও অসুস্থ মানুষের সেবা করার জন্যই পাঠিয়েছেন।
পিতামাতার অমতে ফ্লোরেন্স নার্স হওয়ার সিদ্ধান্তে অটল থাকেন। অগত্যা তার বাবা তাকে জার্মানিতে থিওডোর ফ্লিডনার পরিচালিত একটি হাসপাতালে তিন মাসের প্রশিক্ষণ নেয়ার অনুমতি দেন। পরে তিনি প্যারিসেও নার্সদের সঙ্গে অতিরিক্ত প্রশিক্ষণ নেন। ৩৩ বছর বয়সে তিনি নার্সিং জগতে পরিচিত হয়ে ওঠেন এবং ১৮৫৩ সালে লন্ডনের একটি হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক হিসেবে দায়িত্ব নেন।
১৮৫৪ সালে ক্রিমিয়ান যুদ্ধ শুরু হলে ব্রিটিশ সেনাদের স্বাস্থ্যসেবা চরম অব্যবস্থাপনার মধ্যে পড়ে। যুদ্ধক্ষেত্রে চিকিৎসার দুরবস্থার খবর সংবাদপত্রে ছড়িয়ে পড়ে। তখন ব্রিটিশ যুদ্ধমন্ত্রী সিডনি হারবার্ট নাইটিঙ্গেলকে অনুরোধ করেন, তার নেতৃত্বে নার্সদের একটি দল যেন যুদ্ধক্ষেত্রে যায়। যার ধমনীতে মানবসেবা বহমান, তিনি কি আর সেই আহ্বানে সাড়া না দিয়ে থাকতে পারেন! রাজি হয়ে গেলেন ফ্লোরেন্স। ১৮৫৪ সালের ৪ নভেম্বর, তিনি ৩৮ জন নার্সকে নিয়ে কনস্টান্টিনোপলের কাছে ব্রিটিশ শিবিরে পৌঁছান।

সেখানে প্রথমে পুরুষ চিকিৎসকেরা নার্সদের গ্রহণ করতে গড়িমসি করেন। কিন্তু রোগীর সংখ্যা ধীরে ধীরে বাড়তে থাকলে তাদের সাহায্যের দরকার পড়ে। নাইটিঙ্গেল ও তার দল সেখানে পরিচ্ছন্নতা, পুষ্টিকর খাদ্য ও সেবার মাধ্যমে হাসপাতালে আমূল পরিবর্তন আনেন। রাতে প্রদীপ হাতে রোগীদের খোঁজ নিতে যাওয়ার সুবাদে ‘আলোর নারী’ নামে পরিচিত হন তিনি। ছয় মাসের মধ্যে মৃত্যুর হার ৪০ শতাংশ থেকে কমে ২ শতাংশে নেমে আসে।
যুদ্ধ শেষে ফিরে এসে ফ্লোরেন্স তার অভিজ্ঞতা ও পরিসংখ্যান রানী ভিক্টোরিয়া ও প্রিন্স অ্যালবার্টের কাছে উপস্থাপন করেন, যার ভিত্তিতে ব্রিটিশ সেনাবাহিনীতে স্বাস্থ্য সংস্কার হয়। তিনি ১৮৫৮ সালে রয়্যাল স্ট্যাটিস্টিক্যাল সোসাইটির প্রথম নারী সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৫৯ সালে তিনি তার বিখ্যাত বই Notes on Nursing: What it is, and What it is Not প্রকাশ করেন। ১৮৬০ সালে তার প্রতিষ্ঠিত ‘নাইটিঙ্গেল ট্রেনিং স্কুল’ নার্সিং শিক্ষায় এক নতুন দিগন্ত উন্মোচন করে।
১৯১০ সালের ১৩ আগস্ট, ৯০ বছর বয়সে এই ‘আলোর নারী’ ধরাধাম ত্যাগ করেন। তার অনিন্দ্য অবদানের স্মরণে ১৯১২ সাল থেকে ফ্লোরেন্স নাইটিঙ্গেল মেডেল প্রদান শুরু হয় এবং ১৯৬৫ সাল থেকে প্রতি বছর ১২ মে ‘আন্তর্জাতিক নার্স দিবস’ পালিত হয়ে আসছে।
/এমএমএইচ/এএম
Leave a reply