‘কাকতাল’-এর কাকতালীয় বিদায়

|

চার বছরের সংগীতযাত্রায় সবচেয়ে বড় পুরস্কার ছিল অসংখ্য শ্রোতার ভালোবাসা। ছিল বলছি, কারণ ‘কাকতাল’ হঠাৎ করেই ঘোষণা দিলো কার্যক্রম বন্ধের। ‘চরকি’, ‘সোডিয়াম’, ‘গোলকধাঁধা’, ‘মায়া’, ‘নস্টালজিয়া’– এমন অনেক গান দিয়ে তরুণ প্রজন্মের কাছে খ্যাতি পাওয়া এই ব্যান্ড হঠাৎ করেই জানিয়ে দিলো, তাদের আর কোনো কার্যক্রম থাকছে না!

শনিবার (১৭ মে) সামাজিকমাধ্যম ফেসবুকে এক আবেগঘন পোস্টে কাকতাল তাদের এই সিদ্ধান্ত জানায়।

ব্যান্ডটির ফেসবুক পোস্টে বলা হয়েছে, ‘প্রায় চার বছরের এক দুর্দান্ত যাত্রা ছিল আমাদের— সেটা সম্ভব হয়েছে আপনাদের ভালোবাসা ও পাশে থাকার জন্য। এই যাত্রায় আমরা অনেক ভালোবাসা, প্রাপ্তি আর অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছি; যা আমাদের কল্পনারও বাইরে ছিল। আমরা আশা করি, আমাদের গানগুলো আপনাদের স্মৃতির পাতায় কিছুটা হলেও জায়গা করে নিতে পেরেছে।’

কিন্তু কেন থেমে গেল ‘কাকতাল’? বিদায়ের কারণ হিসেবে ব্যান্ডটি জানিয়েছে– যেই শান্তির খোঁজে এই যাত্রা শুরু হয়েছিল, সেটিই এখন হারিয়ে যেতে বসেছে। তাই এখন এই পথচলার ইতি টানার সময় এসেছে।

সবশেষে ব্যান্ডটি লিখেছে, ‘আমরা সবাই যেন নিজ নিজ জীবনে সেই শান্তিটুকু খুঁজে পাই।’

‘কাকতাল’-এর ফেসবুক পোস্ট

ব্যান্ডটির ভোকালিস্ট ও গীতিকার আসিফ ইকবাল অন্তু এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, কারাগারে থেকেই কাকতালীয়ভাবে ব্যান্ডটির জন্ম। প্রায় দুইশ-আড়াইশ গান জেলে বসেই কম্পোজ করেছে ব্যান্ড কাকতাল।

তিনি আরও জানান, এই ব্যান্ড তৈরি হয়েছে নিরবচ্ছিন্ন এক যাত্রার মধ্য দিয়ে। অনেক সদস্যের স্বতঃস্ফূর্ত সমন্বয়ে তারা গড়ে তোলে গানের দলটি। কেউ এক মাস ছিলেন ব্যান্ডে, এরপর কারাগার থেকে ‘মুক্তি’ লাভ করেছেন। কেউবা থেকেছেন দীর্ঘদিন। এভাবে পরিবর্তিত মিউজিশিয়ানদের সংমিশ্রণে দলটির অস্থায়ীভাবে বেড়ে ওঠা।

এ বিষয়ে ব্লগার নিবর্হণ নির্ঘোষ তার এক লেখায় উল্লেখ করেন, মিথ্যা মামলায় ৭ বছরের সাজা পাওয়া এক যুবকের (আসিফ ইকবাল অন্তু) মাধ্যমে গঠিত হয় কাকতাল ব্যান্ডটি। সঙ্গে ছিল আরও কিছু কারাবন্দি। সেই সময় কারাগার কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নেয়, সৃজনশীল কাজের মধ্যে কারাবন্দিদের নিয়োজিত করা। সে সময় কিছু বাদ্যযন্ত্র কারাগারে আনা হয়। ধীরে ধীরে বাদ্যযন্ত্রের পরিমাণ বৃদ্ধি পায়। এ সময় আসিফ কারাগারেই তৈরি করেন ‘মননচর্চা’ নামের এক সংগঠন। যাদের কাজ হলো, সৃজনশীল কাজের প্রচার এবং সুষ্ঠু মননচর্চার ভেতর দিয়ে বন্দিদের সংশোধান করা। আর এরই ফলশ্রুতিতে জন্ম নেয় ‘কাকতাল’।

তিনি আরও জানান, ২০২১ সালে কারামুক্তি ঘটে আসিফ ইকবাল অন্তুর। এরপর স্বাধীনভাবে যাত্রা শুরু করে কাকতাল। তবে মজার ব্যাপার হলো, প্রথম দিকে এই ব্যান্ডের কোনো লাইনআপ ছিল না। কারণ কারাগারে যারা ছিল, তারা কেউ হয় সাজামুক্তি পেয়েছে, কেউ পায়নি। এই ব্যান্ডের স্থায়ী সদস্য তখন একজন আর তিনি হলেন আসিফ ইকবাল অন্তু!

ফ্যান মেইড পোস্টারে কাকতাল-এর সঙ্গে উড়ন্ত কাক

এখানে বলে রাখা দরকার, পূর্ণমাত্রায় আত্মপ্রকাশ করার পর ব্যান্ড কাকতালের সদস্যরা ছিলেন– আসিফ ইকবাল অন্তু (ভোকালিস্ট ও গিটার), নাজেম আনোয়ার (বাঁশি), অ্যালেক্স জোভেন (ড্রামস ও পারকাশন), সৌম্য অনিন্দ্য ঋদ্ধ (বেস গিটার)। এছাড়া, অন্তর ও জাভেদ ছিলেন এই যাত্রায়।

কাকতালের এই থেমে যাওয়ার সিদ্ধান্ত মেনে নিতে পারছে না অনেক শ্রোতাই। দলটির মিনিমালিস্ট সাউন্ড, আরবান লিরিকে শ্রুতিমধুর গান সামনে থেকে আর শুনতে পাওয়া যাবে না, এটা যেন হজম করতেই কষ্ট হচ্ছে অনেকের।

তারা বলছে, ‘কাকতাল’ কোনো ব্যান্ড না, এটা ভেজা কাকের পরিবার। তারা কাকতালের থমকে যাওয়া মানতে পারছে না.. মনগড়া এসব কিছু মানতে পারছে না.. পারছে না আদরের চাদরে মুড়িয়ে কাকতালকে ধরে রাখতে।

অন্তুরা শেষ পর্যন্ত অগুনতি শ্রোতাদের শিখিয়ে দিয়ে গেলো– টু লাভ ইজ টু লেট গো। ভালোবাসলে এক বুক যন্ত্রণা নিয়ে হলেও যেতে দিতে হয়। কাকতাল কখনও বিস্মৃত হবে না। কাকতাল কখনও হারিয়ে যাবে না। কাকতাল ভক্তদের বুকে বেঁচে থাকা সুবাসিত বেলির নাম।

একবার ভোকালিস্টকে জিজ্ঞাসা করা হয়েছিল, ব্যান্ডের নাম ‘কাকতাল’ কেন?

আসিফ ইকবাল অন্তু জানিয়েছিলেন– কারণ, পুরো জার্নি খুবই কাকতালীয়। কোনো কিছু পরিকল্পনা করে হয়নি। যেভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সব জোড়া লাগছে, সেভাবেই চলছে, সেভাবেই জড়িয়ে ধরছি।

আপনি জানেন, পরিকল্পনা না করেই অনিন্দ্য সুন্দর পাখি জীবনের ডালে উড়ে এসে বসে? আপনি জানেন, কাকতালীয়ভাবেই আপনার দেখা হতে পারে পরশপাথর কিংবা কষ্টিপাথরের সঙ্গে? তখন সেই অনুভূতি হয় অমূল্য, কোনো মূল্য দিয়ে তা শোধ করা যায় না। কাকতাল এমন এক অমূল্য অনুভূতির নাম। যে ব্যান্ডটির পয়দা হয়েছিল কাকতালীয়ভাবে, তার অন্তিম যাত্রাও কি কাকতালীয়! আবার দেখা হলে বলবে কি কাকতাল– ‘কেমন আছো?’

‘আবার দেখা হলে
মিলিয়ে নিও মনের ছবি
শুনেছি বদলে গেছে
জানি বদলায়নি বুকের খাঁচায়
উদাস নীলাভ পাখি
লুকিয়ে আজও গাইছে নীরবে
লুকিয়ে আজও গাইছে..’

গ্রন্থনা: আল মাহফুজ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply