জাহান মালেক খাতুন, হারিয়ে যাওয়া এক ফারসি কবি

|

মুনিম রাব্বী

পারস্যের বিখ্যাত কবি খাজা শামসুদ্দিন হাফিজের শহর শিরাজ। এই শহরে আরও একজন কবি ছিলেন। যে সে কবি নন। তার বাবা ছিলেন শিরাজ ও ফার্সের রাজাধিরাজ। একে তো রাজকন্যা, তার ওপরে ফারসি কবিতার জগতে তখন হাফিজের একচ্ছত্র আধিপত্য। রাজমহলের নারীদের কবি হয়ে ওঠার নজির বিশ্ব ইতিহাসে খুব বেশি নেই। সেখানে জাহান মালেক খাতুন পার্সিয়ান সাহিত্যে তো বটেই, বিশ্বসাহিত্যের জন্যও অনন্য।

চতুর্দশ শতকের শিরাজের ইতিহাস ছিল হত্যা, ষড়যন্ত্র ও গৃহযুদ্ধের। জাহান অন্তত চার রাজার শাসন দেখেছেন। যাদের বেশিরভাগই মৃত্যু হয়েছিলো অপঘাতে। এমনই অপঘাতে বাবা নিহত হলে তিনি তার চাচা আবু ইসহাকের কাছে বড় হন। আবু ইসহাকের দশ বছর শিরাজের শাসক ছিলেন। তার দরবারে সাহিত্য চর্চা হতো। হাফিজ ও উবায়েদ জাকানির মতো কবিরা সেখানে যেতেন।

১৩৫৩ সালে মোবারিজ আল দিন শিরাজ দখল করলে আবু ইসহাক পালিয়ে যান। পরে ধরা পড়লে তাকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়। জাহানের স্বামীকেও হত্যা করা হয়। জাহানের কিছু কবিতা থেকে বোঝা যায়, এ সময় তিনিও বন্দি ও নির্বাসিত জীবন কাটিয়েছেন।

মোবারিজ আল দিনের শাসন ছিল কঠোর। তিনি সুরা নিষিদ্ধ করেছিলেন। কবিতাকে তুচ্ছ মনে করতেন। মহাকবি শেখ সাদির সমাধিও ধ্বংস করার কথাও ভেবেছিলেন। তিনি মনে করতেন সাদির কবিতা ইসলামবিরোধী। মোবারিজ ১৩৫৮ সালে নিজের পুত্র শাহ শোজা কতৃক ক্ষমতাচ্যুত হন। শিরাজে আবার ফিরে আসে সুরা, সংগীত আর কবিতা। হাফিজ, জাকানির সাথে জাহানও শিরাজে ফিরে আসেন। এরপর জাহান ইতিহাস থেকে প্রায় হারিয়ে যান। নানান প্রতিবন্ধকতা উপেক্ষা করে প্রথমবারের মতো জাহান মালেক খাতুনের সম্পূর্ণ কবিতাসমগ্র প্রকাশিত হয় ১৯৯৫ সালে।

জাহানের কাজের গুরুত্ব বুঝতে হলে তার সৃষ্টিকে কয়েকটি দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করতে হবে। প্রথমত, তার সমসাময়িক পুরুষ কবি বিশেষত হাফিজের সাথে তার কবিতার তুলনা করতে হবে এবং লিঙ্গ তার কবিতাকে আলাদা করে কিনা, বোঝার চেষ্টা করতে হবে। দ্বিতীয়ত, তার কবিতায় আত্মজৈবনিক উপাদান কতটা আছে, তা বিশ্লেষণ করতে হবে। বিশেষত যখন তার জীবনী সম্পর্কে তথ্য খুবই কম। শেষত, এই বিশ্লেষণকে ইরানের পরবর্তী ইসলামিক সমাজ ও বর্তমান নারীদের প্রেক্ষাপটে মূল্যায়ন করতে হবে।

জাহান মালেক খাতুনের পোর্ট্রেট

জাহানের কবিতা বুঝতে হলে প্রথমে চতুর্দশ শতকের ফারসি কবিতার কিছু রীতির কথা জানা দরকার। জাহান মূলত গজল কবি। তার ৪টি কাসিদা (প্রশস্তিমূলক কবিতা), ১টি তারজিবন্দ (স্তবক কবিতা), ১টি মার্সিয়া (শোকগাথা), ১২টি মোকাত্তা (খণ্ডকবিতা), ৩৫৭টি রুবাই (চতুষ্পদী), ১৪১৩টি গজল (প্রেমগীতি) রয়েছে।

গজল নিয়ে আমাদের মধ্যে কিছু বিভ্রান্তি আছে। প্রশংসামূলক গীতিকবিতাকে গজল বলা হয়। আরও স্পষ্ট করে বললে, গজলে সাধারণত একজন বক্তা ও শ্রোতার সম্পর্ক বর্ণিত হয়, যেখানে শ্রোতা বক্তার চেয়ে শ্রেষ্ঠ। শ্রোতা ঈশ্বর অথবা প্রিয়তম, যে কেউ হতে পারে। অনেক ক্ষেত্রে ঈশ্বর অথবা প্রিয়তমকে উহ্য রেখেই গজল রচিত হয়। এছাড়া, ফারসি ভাষায় লিঙ্গভেদ নেই। ‘সে’ বলতে পুরুষ বা নারী উভয়ই বোঝায়।

ফারসি কবিতায় প্রিয়তম সাধারণত পুরুষবাচক। জাহান খাতুনের মতো নারী লেখকের জন্য এটি সমস্যা তৈরি করেছিল। তাই তার গজলে সাধারণত নারী-পুরুষের সম্পর্কই ফুটে উঠেছে। যদিও তিনি কখনও কখনও পুরুষের ভূমিকায় নারীকেও সম্বোধন করেছেন।

ফারসি কবিতায় প্রেম ও মদের উল্লেখকে সুফি বা আধ্যাত্মিক রূপক হিসেবে ব্যাখ্যা করার রীতি চতুর্দশ শতক থেকেই প্রচলিত। কিন্তু জাহানের গজলে মদ বা সুফিবাদের উল্লেখ কম বরং তিনি রান্নাঘর ও গৃহস্থালির রূপক ব্যবহার করেছেন। যেমন: প্রেমের ধৌতপাত্র ছাদ থেকে পড়ে গেল।

বিশ্লেষকদের মতে, জাহানের কবিতা হাফিজ বা উবায়েদের সমতুল্য। জাহান যখন পুরুষের ভূমিকায় কবিতা লেখেন, তখনও শ্রোতা জানেন যে, তিনি নারী। এই কবিতাটাও সেই ঢঙে লেখা–

আমার প্রেম এমন এক ব্যথা, যার কোনো নিরাময় নেই
আমার আত্মা জ্বলছে অথচ তুমি নেই
কথা দিয়েছিলাম, ‘তোমার অনুপস্থিতিতে আমি ধৈর্য ধারণ করব’
কিন্তু তা অসম্ভব.. হায়, একটা সম্পূর্ণ দিন কীভাবে পার হয়ে গেলো!

জাহান খাতুন সম্পর্কে যতদূর জানা যায়– তিনি শিরাজে কবি হিসেবে বিখ্যাত ছিলেন। দেখতেও অসাধারণ ছিলেন। তার মজলিসে সমসাময়িক অন্যান্য সাহিত্যিকরাও সমবেত হতেন, এমনকি হাফিজও।

/এএম


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply