ছবির মতোই সুন্দর শ্রীলঙ্কার গল শহরের সমুদ্র সৈকত
হাসান আল মারুফ, শ্রীলঙ্কা থেকে⚫
শ্রীলঙ্কার দক্ষিণে ভারত মহাসাগর তীরবর্তী অপার্থিব সৌন্দর্যের শহর গল। সমুদ্রের কোলঘেঁষে গড়ে ওঠা এক জনপদ। নয়নাভিরাম সমুদ্রতটে নীল জলরাশি। পাশেই মাথা উঁচু করে শহরকে আগলে রেখেছে ডাচ ফোর্ট। তার সামনেই গল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট স্টেডিয়াম; বিশ্বের অন্যতম মনোরম লোকেশনের এক ক্রিকেট মাঠ। এক পাশে ঢেউ খেলানো সমুদ্র, অন্য পাশে শতাব্দী প্রাচীন দুর্গ। সেই গলেই বাংলাদেশ-শ্রীলংকা সিরিজের প্রথম টেস্ট। কাভার করতে আমার গন্তব্য তাই লঙ্কান দ্বীপ।
গলে যেতে হলে ফ্লাইটে সরাসরি আগে যেতে হবে কলম্বো। ১৪ তারিখে ফ্লাইট ধরে গিয়ে পৌঁছালাম কলম্বোর বন্দরনায়েকে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে। রাত তখন প্রায় ৩টা। সিম কিনে এয়ারপোর্ট থেকে এবার গলে যাত্রার অপেক্ষা। বিমানবন্দর থেকে বেরিয়ে পাশেই বাস স্ট্যান্ড। কিন্তু গলের বাস ধরতে হলে যেতে হবে কলম্বো বাস স্ট্যান্ড। বাস যখন বিমানবন্দর ছাড়ে, ঘড়ির কাটায় তখন রাত ৪টা। মিনিট চল্লিশের পথ পাড়ি দিয়ে কলম্বো বাস স্ট্যান্ড। চা বিরতি দিয়ে খুঁজে বের করলাম গলের বাস। বাংলাদেশের আগের আমলের বাসের মতো দেখতে হলেও, বাইরে কিংবা ভেতরের চাকচিক্য চোখে পড়ার মতো। কলম্বো থেকে গল যাত্রা রেলপথেই বেশি উপভোগ্য। সমুদ্র ঘেঁষে এগিয়ে চলা। কিন্তু ভাগ্য সুপ্রসন্ন না হওয়ায় মেলেনি ট্রেনের টিকিট।
নির্ঘুম রাত পার করায় বাস ছাড়তেই ঘুমের রাজ্যে। ঢেউয়ের শব্দ আর সামুদ্রিক বাতাসের হিমেল ছোয়ায় কখনও কখনও তাতে ছেদ পড়ে। চোখ খুলতেই দেখি পৌঁছে গেছি গল শহরে, ঘণ্টা তিনেকের যাত্রা যেন এক নিমিষেই শেষ।
বাস থেকে নেমেই হোটেলে ওঠার তাড়া। বাংলাদেশ দলের প্রথম অনুশীলন, সেটা কাভার করতেই হন্যে হয়ে বাহন খোঁজা। বাহনের নাম ‘টুকটুক’। গল ঘুরে দেখার জন্য এর চেয়ে সহজ কিছু হয় না। বাংলাদেশিদের জন্য পরিচিত নাম সিএনজি বললেও ভুল হবে না।

টুকটুক চলতে শুরু করলো ‘ওল্ড ডাচ হাউজ’ এর পথে। মোড় ঘুরতেই শহরের প্রবেশদ্বারে ঠায় দাঁড়িয়ে আইকনিক গল ফোর্ট ক্লক টাওয়ার। আর তার সামনেই গল আন্তর্জাতিক স্টেডিয়ামে দারুন ব্যস্ততা।
গল ফোর্টের টানেল ধরে মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই পৌঁছে গেলাম ওল্ড ডাচ হাউজে। ৪৫০ বছরের বেশি পুরনো বাড়ি, যদিও চাকচিক্য দেখে বোঝার উপায় নেই। রুমে ব্যাগ রেখে দ্রুত তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাংলাদেশের অনুশীলন ধরতে। ভ্রমণ ক্লান্তির পর কাজ – সবমিলে গলের প্রথম দিনটা কেটেছে অম্ল-মধুর।
টেস্ট ম্যাচ চলাকালীন কাজের কারণে সকাল ৯ টা থেকে রাত ৮ টা অবধি ঘোরার সুযোগ নেই। গলের মুগ্ধতা নিতে ঠিক করলাম, প্রতিদিন ভোর ৬ টায় বের হয়ে ৮ টা পর্যন্ত ঘুরে দেখবো। এভাবেই চললো বাকি কয়েকদিন।

ফোর্ট মূল আকর্ষণ হলেও অসংখ্য বিচ আছে গলজুড়ে—উনাওয়াতুনা, জাঙ্গালাবিচ, মিরিসা কিংবা থাল্পে—যেখানে নেই কোনো কোলাহল, বেশিরভাগই যেন জনমানবশূন্য। বিশেষ করে ভোর কিংবা গোধূলি বেলায় এসব সমুদ্রতটে দাঁড়িয়ে থাকলে মনে হয়, গোটা সাগরটাই যেন কেবল আপনারই জন্যে।
বলা হয়, শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে সুন্দর বিচ ডালাওয়েলা। বিচেও একাকী সময় কেটেছে বেশ কিছুক্ষণ। জোয়ারের বড় ঢেউয়ের সামনে গাছে দড়ি বেড়ে ‘পাম্প সুইং’ করার কিছুটা সাহসিকতাও দেখাতে ভুলিনি।
গল ফোর্টের এক প্রান্তে আছে শহরের সবচেয়ে পুরোনো লাইটহাউজ। সেটিও জনপ্রিয় এক পর্যটন কেন্দ্র। ১৮৪৮ সালে প্রথম এটি নির্মিত হয়। কিন্তু আগুনে পুড়ে যাওয়ার পর ১৯৩৯ সালে বর্তমান কাঠামোটি তৈরি করা হয়। লাইটহাউজের সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠলে দেখা মেলে চারপাশের সাগর’ পাথুরে প্রাচীর আর শহরের দৃশ্যপট। একই ফ্রেমে দেখবেন ইতিহাস আর প্রকৃতি।

দুর্গের ভেতরে থাকা ডাচ কলোনি আপনাকে নিয়ে যেতে পারে সপ্তদশ শতকে। মধ্যযুগের ঘর-বাড়িগুলো ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারক হয়ে আছে এখানে। এখানে চোখে পড়বে কাঠের জানালাওয়ালা ইউরোপীয় ঘর, পুরোনো গির্জা, হাতের লেখা সাইনবোর্ড, বা একশ বছরের পুরোনো বাড়িতে চালু হওয়া ক্যাফে। এক পাশে ব্রিটিশ আমলের অল সেন্টস চার্চ, অন্যদিকে মুসলিমদের মেহেরিয়া মসজিদ—এক শহরে বহু সভ্যতার যুগপৎ বসবাস। কাজের ফাঁকে হাতে থাকা অল্প সময়েই সব ঘুরে দেখা সারা। ছোট্ট শহরের এটাই সবচেয়ে ভালো দিক।
গল শহরটা বেশ পরিছন্ন। প্রকৃতির মতোই সুন্দর রাস্তাঘাট। খুব একটা দেখে মেলে না ট্রাফিক পুলিশের। প্রয়োজনও হয় না। রোড সাইন দেখে দাঁড়িয়ে যান চালকরা। এমনকি জেব্রা ক্রসিংয়ে কাউকে পার হতে দেখলে দাঁড়িয়ে যায় গাড়ি।
আরেকটা দৃশ্য অবাক করে। একদিন ভোরে দেখলাম শৃঙ্খলা ও ট্রাফিকের দায়িত্বে রয়েছেন ক্ষুদে ছাত্র-ছাত্রীরা; এমনকি বাচ্চারা যাওয়া-আসার পথে নির্দিষ্ট সময় ওই রাস্তায় অপেক্ষা করতে হচ্ছে বাহনগুলোকেও। সবাই সারিবদ্ধ ভাবে স্কুলে প্রবেশ করার পর আবার আগের মতোই চলতে শুরু করলো গাড়ি! গলে এমন চিত্র আপনি দেখবেন হরহামেশাই। লোকজন কম, জ্যাম শব্দটাই অপরিচিত।

সূর্যের আলোতেই লোকজন কম। আর সূর্যাস্তের পর শহরে যেন নেমে আসে নিঃস্তব্ধতা। তবে দিনের আলোর মতোই ঝকঝকে রাতের গল। রাতে সমুদ্রের ঢেউয়ের শব্দ কানে বেশি বাজে। নেই নিরাপত্তার কোনো শঙ্কা, ঘুরে বেড়ানো যায় যেকোনো সময়।
গলে এখন মূলত অফ সিজন। খুব একটা দর্শনার্থী নেই তাই। তবে পিক সিজনে অনেক দর্শনার্থী এলেও প্রকৃতি কিংবা পরিবেশ কোথাও সৌন্দর্যের কমতি থাকে না।
শ্রীলঙ্কার সবচেয়ে ব্যয়বহুল শহর এই গল। ক’বছর আগের টালমাটাল অর্থনৈতিক অবস্থার কারণে মুদ্রার মান এতোটাই পড়েছে যে, এক কাপ চা খেতেই বেরিয়ে যায় দু’শো রুপি। রাতে ডিনারে অমলেট, ভাত আর ডালেই বিল প্রায় ১৫০০ রুপি। বাংলাদেশি টাকার হিসেবে যা ৬০০’রও বেশি।
থাকার খরচটা একেক এলাকায় একেক রকম। ডাচ কলোনিতে থাকতে হলে মাঝারি মানের হোটেলেও গুনতে হবে বাংলাদেশি ৩-৪ হাজার টাকা। তবে ফোর্টের বাইরে ১৫০০-২৫০০ টাকায় বেশ ভালোভাবেই থাকতে পারবেন এই গল শহরে।

শেষ পর্যন্ত গল দুর্গের সামনে টেস্ট জয় করা হয়নি বাংলাদেশ দলের। ব্যস্ততার মাঝে গিয়েছিলাম স্টেডিয়াম থেকে দুই কিলোমিটার দূরে মাহিন্দা কলেজে। যেখানে ক্রিকেটে হাতেখড়ি হয়েছিল মারভান আতাপাত্তু, লাসিথ মালিঙ্গার মতো অনেক কিংবদন্তির। শতবর্ষী এই ক্রিকেট পাঠশালায় ব্যাট বল নিয়ে ব্যস্ত ক্ষুদে ক্রিকেটারদের মধ্যেই হয়তো লুকিয়ে আছে ভবিষ্যতের কোনো কিংবদন্তি।
বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কা সিরিজের গল পর্ব যখন শেষ, তখন আমারও এই শহরকে বিদায় বলার পালা। যখনই মনে হলো, এই শহরকে বিদায় বলতে হবে, তখনই কেমন যেন হাহাকার করে উঠলো ভেতরে। জানি, এসেছি মাত্র কদিনের জন্য। কিন্তু এই অল্প সময়েই কেমন যেন আপন হয়ে গেছে গল। মনের মাঝে কোথাও একটা দাগ কেটে ফেলেছে এই সমুদ্রঘেষা নগরী।
কলম্বো ফেরার সময় যাত্রা ট্রেনে। মনের ভেতর প্রিয় কিছু ছেড়ে যাওয়ার বিষাদ নিয়ে নিয়ে এগুচ্ছি। সমুদ্রের পাশ দিয়ে ট্রেন চলছে। কানে বাজছে খট-খট-খট-খট শব্দের এক ঝঙ্কার। ট্রেনের এমন বিরক্তিকর শব্দও কি তবে এত মধুর হতে পারে? আগে জানতাম না। গল যে জীবনে অনেক নতুনের সাথে পরিচয় করিয়ে দিল। দেখালো আকাশ কত সুন্দর, সমুদ্র কত বিশাল!
খানিকক্ষণ বাদে নিজেই আবিষ্কার করলাম, গুন গুন করে গাইছি রবী ঠাকুরকে ,
আকাশভরা সূর্য -তারা, বিশ্বভরা প্রাণ
তাহারই মাঝখানে আমি পেয়েছি মোর স্থান
বিস্ময়ে তাই জাগে আমার গান…’
/এমএমএইচ
Leave a reply