উপজেলা নির্বাচন: বিএনপির সিদ্ধান্ত ‘না’ হওয়ায় আওয়ামী লীগে প্রার্থীজট

|

আসন্ন উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ না করার ব্যাপারে বিএনপি নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয়ায় প্রার্থীজট দেখা দিয়েছে আওয়ামী লীগে।

প্রার্থী বাছাই প্রক্রিয়া শুরু করেছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। এরই মধ্যে একক প্রার্থী নির্ধারণে তৃণমূলে চিঠি পাঠিয়েছে দলটি। প্রতি উপজেলার চেয়ারম্যান, ভাইস চেয়ারম্যান ও মহিলা ভাইস চেয়ারম্যান পদের বিপরীতে তিনজন করে প্রার্থীর নাম কেন্দ্রে পাঠাতে জেলা কমিটিগুলোকে বলা হয়েছে।

শনিবার অনুষ্ঠেয় দলটির স্থানীয় মনোনয়ন বোর্ডের সভায় একক প্রার্থী চূড়ান্ত করার বিষয়ে বিস্তারিত আলোচনা হবে।

দেশের বিভিন্ন উপজেলায় খোঁজ নিয়ে দেখা গেছে, প্রতিটি চেয়ারম্যান পদের বিপরীতে গড়ে ৮ জন করে প্রার্থী দলীয় মনোনয়ন পেতে দৌড়ঝাঁপ শুরু করেছেন। আগ্রহী প্রার্থীদের ধারণা- ‘দলীয় মনোনয়ন পেলেই নিশ্চিত জয়’। প্রার্থীর ছড়াছড়ি হওয়ায় বাছাইয়ে কেন্দ্রের নির্দেশনা বাস্তবায়নে বেশ হিমশিম খাচ্ছেন স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতারা।

এ নিয়ে গ্রুপিং-কোন্দল কিংবা সহিংসতার আশঙ্কাও করছেন তারা। শুধু তা-ই নয়, কেন্দ্র কার্যকর অর্থে কঠোর না হলে অনেক স্থানেই দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ‘বিদ্রোহী প্রার্থী’ হিসেবে নির্বাচনী মাঠে থাকতে পারেন- এমন শঙ্কাও আছে সংশ্লিষ্টদের।

বিএনপিহীন একতরফা উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে একক প্রার্থী নিশ্চিতে কঠিন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে ক্ষমতাসীনদের- এমনটি ভাবছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের শঙ্কা- যদি একক প্রার্থী নিশ্চিত না হয়, তা হলে সহিংসতা হতে পারে। ভেঙে পড়তে পারে দলীয় শৃঙ্খলা।

আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য আবদুল মতিন খসরু যুগান্তরকে বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা এবং সাধারণ মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্যতার বিষয়টি অধিক গুরুত্বসহকারে বিবেচনায় আনা হবে।

এ ছাড়া থাকতে হবে সততা, নিষ্ঠা, দলের জন্য নিবেদিত, সততা ও স্বচ্ছ ভাবমূর্তি। সমাজ, দল ও সরকারে সমালোচিত-বিতর্কিতরা অযোগ্য হিসেবে বিবেচিত হবেন।

এদিকে উপজেলা নির্বাচন একতরফা হলে তা গণতন্ত্রের জন্য অশনিসংকেত বলে মন্তব্য করেছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সাধারণ সম্পাদক বদিউল আলম মজুমদার।

বুধবার যুগান্তরকে তিনি বলেন, যদি বিএনপি নির্বাচনে অংশ না নেয়, সে ক্ষেত্রে একক প্রার্থী নিশ্চিতে কঠিন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হবে আওয়ামী লীগকে। আর ক্ষমতাসীনরা একক প্রার্থী নিশ্চিত করতে না পারলে নিজেদের মধ্যে দলীয় কোন্দল সৃষ্টির শঙ্কা আছে। প্রতিদ্বন্দ্বিতাহীন এ নির্বাচন গণতন্ত্রের জন্য সুখকর নয়।

এ জন্য বিএনপিকে নির্বাচনে আনতে আওয়ামী লীগকে করণীয় নির্ধারণ করতে হবে। গণতন্ত্রে ভারসাম্য আনার কাজটি আওয়ামী লীগকেই করতে হবে। একদল দিয়ে গণতন্ত্র হয় না। গণতন্ত্র হলো বহুদলীয়।

আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও দলটির স্থানীয় নির্বাচন মনোনয়ন বোর্ডের সদস্য মাহবুব-উল আলম হানিফ বলেন, প্রার্থী বাছাইয়ে কেন্দ্র থেকে তৃণমূলে নির্দেশনা পাঠানো হয়েছে। সেখানে সংশ্লিষ্ট নেতাদের ভোটের ভিত্তিতে প্রার্থী নির্ধারণ করে কেন্দ্রে পাঠাবে। আবার কিছু ক্ষেত্রে প্রতি পদের বিপরীতে তিনজন করে প্রার্থীর নাম পাঠাতে বলা হয়েছে। সে ক্ষেত্রে কেন্দ্র অধিকতর যাচাই-বাছাই করে একক প্রার্থী নিশ্চিত করবে।

কোন দল নির্বাচনে আসবে কি আসবে না, সেটি তাদের ব্যাপার- এমন মন্তব্য করে হানিফ বলেন, তবে আমরা আশা করি স্থানীয় নির্বাচনে সবাই অংশ নেবে। তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের কোনো পদেই একাধিক প্রার্থী হবে না। হওয়ার সুযোগ নেই। একক প্রার্থী নিশ্চিতে কোনো চ্যালেঞ্জও নেই।

স্থানীয় নির্বাচন কখনও জোটবদ্ধ হয়নি জানিয়ে আওয়ামী লীগের এ নেতা বলেন, এতে আগের মতোই দলীয়ভাবে সবাই অংশগ্রহণ করবে। সব দল সেভাবেই প্রস্তুতি নিচ্ছে। আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ এবং যাকে মনোনয়ন দেয়া হবে, তার পক্ষেই কাজ করবে।

বরাবরের মতো এবারও উপজেলা নির্বাচন দলগতভাবে করা হবে বলে জানিয়েছেন ক্ষমতাসীন ১৪-দলীয় জোটের অন্যতম শরিক ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন। তিনি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, এতে জোটের ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এরই মধ্যে আমরা দলীয় প্রার্থী নির্ধারণে কাজ করছি।

জানা যায়, উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিতে ১৪-দলীয় জোটের জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) এবং জাতীয় পার্টি-জেপিসহ অন্য শরিক দলগুলো নিজেদের মতো করে প্রস্তুতি শুরু করেছে।

দলীয় প্রতীকে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে এককভাবে অংশ নেয়ার কথা আগেই জানিয়ে দিয়েছেন আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের।

বিএনপির অংশ না নেয়ার বিষয়ে আওয়ামী লীগের প্রচার ও প্রকাশনা সম্পাদক এবং তথ্যমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিএনপি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ না নিলে বিরাট ভুল করবে। দলটির মধ্যে বিশৃঙ্খলা দেখা যেতে পারে। দলগতভাবে তারা নির্বাচনে না এলেও বিএনপির অনেক নেতাই উপজেলা নির্বাচনে অংশ নেবেন বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

আগের স্থানীয় নির্বাচনগুলো পর্যবেক্ষণ করলে দেখা যায়, আওয়ামী লীগে বিদ্রোহী প্রার্থী থাকার কারণে উপজেলা, পৌরসভাসহ স্থানীয় সরকার নির্বাচনের অনেক স্থানেই দলের প্রার্থীর পরাজয়ের কারণ ঘটেছে। এতে সেসব এলাকায় দলের মধ্যে বিভেদ-দ্বন্দ্ব প্রকট হয়ে দেখা দেয়।

বিষয়টি মাথায় রেখে এবার আগে থেকেই শক্ত অবস্থানে থেকে উপজেলা নির্বাচনে প্রার্থিতা চূড়ান্ত করতে কাজ শুরু করেছে আওয়ামী লীগ। সে ক্ষেত্রে দলের সিদ্ধান্ত অমান্য করে কেউ বিদ্রোহী প্রার্থী হলে তাৎক্ষণিক দল থেকে বহিষ্কার ছাড়াও কঠোর সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণের সিদ্ধান্ত হয়েছে।

দল থেকে আজীবন বহিষ্কারের হুশিয়ারি আগেই দিয়ে রেখেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। কোন্দল এড়াতে গত ১৫ জানুয়ারি উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে দলীয় প্রার্থী চূড়ান্তে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের স্বাক্ষরিত চিঠি তৃণমূলে পাঠানো হয়েছে।

দলের সব জেলা-উপজেলা কমিটির সভাপতি-সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক-যুগ্ম আহ্বায়কদের কাছে পাঠানো ওই চিঠিতে বলা হয়েছে- উপজেলা নির্বাচনের প্রতিটি পদে একক অথবা তিনজন প্রার্থীর নামের সুপারিশসংবলিত একটি প্যানেল তৈরি করতে হবে।

দলের উপজেলা শাখা প্রতিটি ইউনিয়ন ও ওয়ার্ডে বর্ধিতসভা করে এ প্যানেল তৈরি করে দলের জেলা সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের কাছে পাঠাবে। এর পর জেলা আওয়ামী লীগ সংশ্লিষ্ট সব উপজেলার প্রার্থী তালিকা আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার ধানমণ্ডির রাজনৈতিক কার্যালয়ে ডাকযোগে কিংবা সরাসরি অন্য কোনো মাধ্যমে পৌঁছে দেবে।

এ প্রার্থী তালিকায় জেলা ও উপজেলা শাখার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদক অথবা আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কদের যৌথ স্বাক্ষর থাকতে হবে। চিঠিতে প্রার্থী মনোনয়ন প্রক্রিয়ায় তৃণমূলকে কিছু নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে।

দলের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, উপজেলা নির্বাচনে দলীয় মনোনয়নে ইচ্ছুক প্রার্থীদের মনোনয়ন ফরমের মূল্য চেয়ারম্যান পদে ২০ হাজার টাকা এবং ভাইস চেয়ারম্যান ও নারী ভাইস চেয়ারম্যান পদে পাঁচ হাজার টাকা করে নির্ধারণ করা হয়েছে।

৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর দুই মাস বিরতি দিয়ে উপজেলা পরিষদ নির্বাচন শুরু করতে যাচ্ছে ইলেকশন কমিশন (ইসি)। চলতি বছর পাঁচ ধাপে ৪৯২টির মধ্যে ৪৫০টির বেশি উপজেলা পরিষদে নির্বাচনের আয়োজন করতে নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে নির্বাচন কমিশন।

মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত কমিশনের সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। এর মধ্যে প্রথম ধাপে রংপুর, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের কয়েকটি জেলার ৬৯টি উপজেলায় নির্বাচন হবে আগামী ৮ বা ৯ মার্চ।

জেলাগুলো হচ্ছে- পঞ্চগড়, দিনাজপুর, নীলফামারী, কুড়িগ্রাম, জামালপুর, নেত্রকোনা, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ। দ্বিতীয় ধাপের উপজেলাগুলোতে ১৮ মার্চ, তৃতীয় ধাপে ২৪ মার্চ এবং চতুর্থ ধাপে ৩১ মার্চ ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। বাকি উপজেলাগুলোতে রোজার ঈদের পর ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ৩ ফেব্রুয়ারি কমিশন সভায় এসব উপজেলা নির্বাচনের তফসিল নির্ধারণ করা হবে।

দ্বিতীয় ধাপে রাজশাহী, খুলনা ও চট্টগ্রাম বিভাগের ১৬টি জেলার ১২৫টি উপজেলা; তৃতীয় ধাপে খুলনা, রংপুর, রাজশাহী, ময়মনসিংহ ও সিলেট বিভাগের ১৭ জেলার ১১১টি এবং চতুর্থ ধাপে বরিশাল, ঢাকা, চট্টগ্রাম বিভাগের ২৪ জেলার ১৫৯টি উপজেলার ভোটগ্রহণের প্রস্তাব করা হয়েছে মঙ্গলবারের বৈঠকের কার্যপত্রে।

সর্বশেষ ২০১৪ সালের মার্চ থেকে মে মাসে ছয় ধাপে এর অধিকাংশগুলোতে ভোট হয়েছিল। আইনে মেয়াদ শেষের পূর্ববর্তী ১৮০ দিনের মধ্যে ভোট করার বাধ্যবাধকতা থাকায় এ নির্বাচন করতে হচ্ছে।

১৯৮৫ সালে উপজেলা পরিষদ চালু হওয়ার পর ১৯৯০ ও ২০০৯ সালে একদিনেই ভোট হয়েছিল।

২০১৪ সালের ১৯ ফেব্রুয়ারি থেকে মে মাস পর্যন্ত ছয় ধাপে ভোট করেছিল তৎকালীন নির্বাচন কমিশন। সেই ধারা বজায় রেখে এবার বিভাগওয়ারি ভোট করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে কমিশন। এবারই প্রথম উপজেলা চেয়ারম্যান পদে দলীয় প্রতীকে নির্বাচন হচ্ছে।

(সূত্র: দৈনিক যুগান্তর)


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply