ভারতের নানা প্রান্তে কাশ্মীরিদের নির্যাতন, মারধর

|

বিবিসি বাংলা

তিনদিন আগে ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পুলওয়ামাতে আত্মঘাতী হামলায় চল্লিশজনেরও বেশি ভারতীয় আধা-সেনা নিহত হওয়ার পর এখন দেশের নানা প্রান্ত থেকে কাশ্মীরীদের ওপর হামলা ও চড়াও হবার খবর পাওয়া যাচ্ছে।

দেরাদুনের বিভিন্ন কলেজ-পড়ুয়া কাশ্মীরী ছাত্রছাত্রীদের উত্তেজিত জনতা যেমন ঘিরে ধরেছে, তেমনি বিহারের পাটনাতে কাশ্মীরি শাল-বিক্রেতাদের দোকানে লাঠিসোঁটা নিয়ে হামলা চালানো হয়েছে।

তবে ভারতের বিভিন্ন প্রান্তে কাশ্মীরিদের বিরুদ্ধে এভাবে যেমন এলাকা ছাড়ার হুমকি দেওয়া হচ্ছে, তেমনি অনেক ভারতীয় নাগরিক আবার নিজেদের বাড়ির দরজা কাশ্মীরিদের জন্য খুলে দেওয়ার কথা ঘোষণাও করছেন।

ভারতের বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী কাশ্মীরীদের সহায়তার জন্য সরকার একটি হেল্পলাইনও চালু করেছে।

এই শীতের মরশুমে কাশ্মীরের বিখ্যাত শাল ও অন্যান্য পোশাক বিক্রির জন্যই বহু কাশ্মীরি ব্যবসায়ীই দেশের নানা প্রান্তে ঘুরে বেড়ান, অথবা দোকান দেন বিভিন্ন শিল্পমেলায়।

বৃহস্পতিবার পুলওয়ামার অবন্তীপুরায় এক কাশ্মীরি যুবকের বিধ্বংসী আত্মঘাতী হামলার পর ভারত জুড়ে যে প্রতিহিংসার রব উঠেছে, তাতে চরম বিপদ ঘনিয়ে এসেছে এই সব ব্যবসায়ীদের।

পাটনার এমনই এক বাণিজ্যমেলায় তা হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন অনন্তনাগের প্রবীণ শালওয়ালা মহম্মদ আবদুল গনি।

তিনি বলছিলেন, “গতকাল দিনেদুপুরে জনা-পঁচিশেক লোক হাতে ঝান্ডা নিয়ে আর কাশ্মীর-বিরোধী শ্লোগান দিতে দিতে আচমকা এসে চড়াও হয় আমাদের দোকানে। এসেই জিনিসপত্র টান মেরে ফেলে দিতে থাকে, আমার ছেলেদের মারধর শুরু করে দেয়।”

“মিনিট পনেরো ধরে তান্ডব চালিয়ে যাওয়ার সময় হুমকি দিয়ে যায়, দশ ঘন্টার মধ্যে আমাদের বিহার ছেড়ে কাশ্মীর ফিরে যেতে হবে – নইলে না কি আগুন ধরিয়ে দেওয়া হবে, আমাদের জীবন্ত কবর দেওয়া হবে।”

মি গনির ছেলে ও দোকানের অন্য কাশ্মীরি সেলসম্যানরাও বলছিলেন, ওই হামলার পর থেকেই তারা ভয়ে সিঁটিয়ে আছেন।

ওই যুবকরা জানাচ্ছেন, তাদের সবাইকে ব্যাপক মারধর করা হয়েছে, কাউকে কাউকে হাসপাতালেও ভর্তি করাতে হয়েছে।

তাদের প্রশ্ন, “বিহারেও যদি কাশ্মীরের মতোই এরকম আতঙ্কের পরিবেশে পড়তে হয়, তাহলে তার সেখানে থেকে কী লাভ?”

অন্য দিকে উত্তরাখন্ডের রাজধানী দেরাদুনেও বহু কাশ্মীরি ছাত্রছাত্রী পড়াশুনো করেন, তাদের হোস্টেল বা পেয়িং গেস্ট আস্তানাগুলোকেও ঘিরে শুরু হয়ে যায় জনতার বিক্ষোভ।

স্থানীয় যে সব বাড়িওলা কাশ্মীরি ছাত্রদের বাড়িভাড়া দিয়ে থাকেন, তারাও তাদের বাড়ি ছাড়ার নোটিশ দিতে থাকেন।

এরই মধ্যে দিল্লির জেএনইউ-তে বামপন্থী ছাত্র নেত্রী ও কাশ্মীরের মেয়ে শেলা রশিদ টুইট করে জানান, দেরাদুনে ডলফিন ইনস্টিটিউট নামে একটি প্রতিষ্ঠানের জনা-কুড়ি কাশ্মীরি ছাত্রী চরম বিপদে পড়েছেন।

তাদেরকে টানা বেশ কয়েক ঘন্টা ধরে তাদের হোস্টেলে আটকে রেখে বাইরে থেকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে। ঘটনাস্থলে পুলিশ গিয়েও তাদের উদ্ধার করতে পারছে না।

কাশ্মীরিদের ওপর এই সব হামলার ঘটনায় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের হস্তক্ষেপ দাবি করেন ভারত শাসিত কাশ্মীরের দুই সাবেক মুখ্যমন্ত্রী ওমর আবদুল্লা ও মেহবুবা মুফতিও।

এর পরই ভারত-শাসিত কাশ্মীরের পুলিশ ও প্রশাসন একাধিক টেলিফোন হেল্পলাইন চালু করে, যেখানে ফোন করে ভারতের অন্যত্র বসবাসকারী কাশ্মীরিরা সাহায্য চাইতে পারবেন।

তবে কাশ্মীরিদের প্রতি ক্ষোভ উগরে দেওয়ার নানা ঘটনার পাশাপাশি বহু ভারতীয় আবার নিজের বাড়িতে তাদের সাদরে আমন্ত্রণও জানাচ্ছেন।

নয়ডা এক্সটেনশন থেকে দুষ্যন্ত বা মহেন্দ্র মিশ্র, দিল্লি থেকে মনামি বসুর মতো অনেকেই নিজের বাড়ির ঠিকানা দিয়ে টুইট করছেন – বিপন্ন কাশ্মীরিদের জন্য তাদের বাড়ির দরজা খোলা, এমন কী তারা এলে রান্না করেও খাওয়ানো হবে।

কিন্তু কাশ্মীরিরা যে এর মধ্যেই আহত ও ক্ষুব্ধ – তা গোপন থাকছে না।

ভারত শসিত কাশ্মীরের জনপ্রিয় সোশ্যাল মিডিয়া তারকা ফাহাদ মাকসুসি যেমন তার ফেসবুক বার্তায় এই সব হামলার কঠোর নিন্দা করে বলেছেন, “ভারতীয়দের কাশ্মীর চাই – কিন্তু কাশ্মীরিদের চাই না, এটা কেমন নির্বুদ্ধিতা?”

“কাশ্মীরিদের বুকে টেনে না-নিলে পুলওয়ামার চেয়েও সাঙ্ঘাতিক ঘটনা যে ঘটে যেতে-পারে এটা তারা কবে আর বুঝবেন?”, প্রশ্ন ছুঁড়ে দিয়েছেন তিনি।

অবন্তীপুরার হামলার পর কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং দেশের সব রাজ্যকে কাশ্মীরিদের নিরাপত্তার দিকে নজর দিতে নির্দেশ দিয়েছিলেন।

কিন্তু ওই ঘটনার পর কাশ্মীরিদের সঙ্গে ভারতের বাকি অংশের বহু বাসিন্দার দূরত্ব ও বিভাজন আরও বাড়ারই লক্ষণ দেখা যাচ্ছে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply