কোটি টাকার প্রকল্পে আ’লীগ নেতার অনৈতিক দাবি, না মানলে কাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি

|

মাহবুবুর রহমান রিপন, সিলেট ব্যুরো

বাংলাদেশ বেতার সিলেট কেন্দ্রের ৫৬ কোটি টাকা উন্নয়ন প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক (পিডি) দেখা না করলে কাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকি দিয়েছেন সিলেট মহানগর আওয়ামী লীগের সাংস্কৃতিক সম্পাদক ও জয় বাংলা সাংস্কৃতিক জোটের প্রেসিডিয়াম সদস্য প্রিন্স সদরুজ্জামান।
বাংলাদেশ বেতারের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মানোয়ার হোসেন খানকে মোবাইল ফোনে এমন হুমকি দেয়ার অডিও সম্প্রতি ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে সিলেট ও ঢাকায় চলছে ব্যাপক সমালোচনা।

অডিওটিতে মানোয়ার হোসেন খানকে প্রিন্স সদরুজ্জামান বলেন, আপনার পিডি, ডিপিডি বারবার বলার পরও সেলিমের (সামসুল আলম সেলিম, সিলেট জেলার সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সহসভাপতি) সঙ্গে দেখা করল না, আমার এখন একটিই পথ খোলা- সেটা কাজ বন্ধ করে দেয়া। উন্নয়ন দরকার নেই, টাকা ফেরত যাক।

যদিও প্রিন্স সদরুজ্জামান যমুনা টেলিভিশনকে বলেন, কাজ যাতে ভালো হয় সেই পরামর্শ নেয়ার জন্য দেখা করতে বলেছি, অন্য কোনো কারণে নয়। প্রকল্প পরিচালক (পিডি) মুজিবর রহমান বলেন, তারা কি কারণে দেখা করতে বলেছেন তা সবারই জানা থাকার কথা। কোনোভাবেই তাদের কোনো অনৈতিক দাবি মেটাব না। এই অডিওটির বিষয়ে বাংলাদেশ বেতারের প্রধান প্রকৌশলীও জানেন।

জানা গেছে, বাংলাদেশ বেতার সিলেট আঞ্চলিক কেন্দ্রের আধুনিকায়নে ৫৬ কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়। বরাদ্দ অনুযায়ী একটি ডরমেটরি ও একটি আধুনিক অডিটোরিয়ামসহ বেশকিছু কাজ শুরু করে বাংলাদেশ বেতার প্রকৌশল বিভাগ। প্রকল্প পরিচালক হিসেবে প্রকৌশল বিভাগের ঢাকা কার্যালয়ের মুজিবর রহমানকে দায়িত্ব দেয়া হয়। কিছু কাজ শুরু করার পর বারবার পিডিকে দেখা করার জন্য বলেন প্রিন্স সদরুজ্জামান। দেখা না করায় সম্প্রতি তিনি সিলেটের আঞ্চলিক প্রকৌশলী মানোয়ার হোসেন খানের সঙ্গে মোবাইলে কথা বলেন। যা হুবহু তুলে ধরা হল- ‘কি অবস্থা আমি তো ভারত থেকে এসে শুনলাম আপনার পিডি সেলিমের সঙ্গে দেখা করল না, সে তো এসে সেলিমের সঙ্গে বসার কথা ছিল। আমি তো তাকে স্ট্রেইট বলেছিলাম, সিলেটে এসে সেলিমের সঙ্গে দেখা করে কাজ শুরু করার জন্য। এখন সে যদি এসব করে তাহলে উন্নয়নের দরকার নেই, কাজ বন্ধ থাকুক। উন্নয়ন তো আমরাই আনছি, উন্নয়ন দরকার নেই, এগুলো বন্ধ রাখেন।’ এ সময় মানোয়ার খান বলেন, কাজ বন্ধ করতে পারবেন না। আমাকে প্রধান প্রকৌশলীর কাছে জবাবদিহি করতে হবে। এ সময় প্রিন্স বলেন, ‘স্ট্রেইট আমাদের কথা বলেন যে তারা বলেছে- পিডি ডিপিডি দেখা না করা পর্যন্ত কাজ বন্ধ থাকবে।’ এ সময় প্রিন্সকে বলতে শোনা যায়, ‘বারবার কথা বলার পরও সে যদি না শুনে, তার মানে সে চোর। এখানে চুরি চলবে না।’ এ সময় প্রিন্স আরও বলেন, ‘ঢাকায় জয় বাংলা সাংস্কৃতিক জোটের স্মরণসভায় তথ্যমন্ত্রী এসেছিলেন, তার পাশেই বসা ছিলাম। আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে ছিল; কিন্তু নানাদিক চিন্তা করে বলিনি।’
এরপর মানোয়ার খান কিছু কথা বলার পর প্রিন্স বলেন, ‘এসব বললে সোজা ওপর মহলে বলে আঞ্চলিক প্রকৌশলী আর পিডিকে বদলাতে বলব। এসব লোক দিয়ে এখানে কাজ হবে না।’ এ সময় মানোয়ার খানকে বলতে শোনা যায়, তিনি কাজ করছেন না, কাজ মনিটরিং করছেন পিডি ও ডিপিডি। প্রিন্স বলেন, ‘আমি কাজ বন্ধ করলে আপনার পিডির বাপও কাজ করতে পারবে না এবং আমি আসলে একদম কাজ বন্ধ করে দিব, আমার আর কোনো রাস্তা নেই। আপনিই দায়িত্ব নিয়েছিলেন সেলিমের সঙ্গে পিডিকে বসিয়ে দিবেন।’ এসব বিষয়ে প্রায় ৭ মিনিট ১৪ সেকেন্ড কথা হয় প্রিন্স সদরুজ্জামান ও মানোয়ার হোসেন খানের। এই অডিও ক্লিপটি এখন যমুনা টেলিভিশনসহ বিভিন্ন গোয়েন্দা দফতর ও বাংলাদেশ বেতারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে।

এ বিষয়ে প্রিন্স সদরুজ্জামান বলেন, আমাদের দাবির পরিপ্রেক্ষিতেই এই উন্নয়ন কর্মকাণ্ডের বরাদ্দ এসেছে। কিন্তু কাজ সঠিকভাবে করার জন্যই তাদের সঙ্গে বসার কথা বলেছি। পিডি যাতে সার্বক্ষণিক সিলেটে থেকে কাজটি করেন এসব পরামর্শ দেয়ার জন্য। কাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকির বিষয়ে তিনি বলেন, কাজ যদি ভালো না হয়, তাহলে তো বন্ধ করে দেয়াই ভালো।

এ বিষয়ে মানোয়ার হোসেন খান বলেন, তার সঙ্গে কথা হয়েছে, কি বিষয়ে কথা হয়েছে তা তো অডিওতেই আছে, এর বেশি আর কিছু বলতে চাচ্ছি না। কথা হয় প্রকল্প পরিচালক মুজিবর রহমানের সঙ্গে, তিনি বলেন, কাজ শুরুর আগে থেকেই আমাকে বারবার তাদের সঙ্গে বসতে বলা হচ্ছে। সামসুল আলম সেলিমের সঙ্গে কথাও বলেছি, কিন্তু তারপরও সেলিম আমাকে বলেছে তাদের সঙ্গে বসতে।

কেন বসতে বলেছে জানতে চাইলে মুজিবর রহমান বলেন, সেটা তো অনুমানই করতে পারেন কেন বসতে বলেছে। কোনোভাবেই অনৈতিক দাবিতে আমি সায় দেব না। তিনি আরও বলেন, এই অডিওটি এখন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের কাছে।

তারা এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন। এদিকে সামসুল আলম সেলিমের কাছে এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি স্বীকার করেন তার সঙ্গে পিডির কথা হয়েছে। কিন্তু শুধু কাজটি ভালোভাবে করার জন্যই বলেছেন বলে দাবি করেন তিনি। বসার কথা তিনি বলেননি বলে দাবি করেন।
প্রিন্স সদরুজ্জামান কেন তার সঙ্গে বসার জন্য পিডিকে বলেছেন এমন প্রশ্নের জবাবে সামসুল আলম সেলিম বলেন, এটা আমি জানি না, আমার সঙ্গে প্রিন্সের কোনো সম্পর্কই নেই।

মহানগর আওয়ামী লীগ নেতা প্রিন্স সদরুজ্জামানের কাজ বন্ধ করে দেয়ার হুমকির বিষয়ে মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কেন্দ্রীয় সদস্য বদরউদ্দিন আহমদ কামরান বলেন, এটা অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এমন কথাবার্তার প্রমাণ পেলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply