দস্যুদের খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে ৫২ লাখ টাকা নিয়ে পালায় আরিফ

|

তোয়াহা ফারুক, সুন্দরবন থেকে ফিরে

ছেলেটিকে দেখলে চট করে তার ইতিহাস পড়ে ফেলা যায় না। আপাতদৃষ্টিতে সৌম্যদর্শন ছেলেটির নাম আরিফ। আরিফ বিল্লাল। এক সময় এই ছেলেটিই ছিল সুন্দরবনের ত্রাস! গহীন বনে কিংবা গভীর সাগরে দোর্দণ্ড প্রতাপে দস্যুবৃত্তি করে বেড়াতো। সাধারণ এক কিশোর থেকে কীভাবে দস্যু হয়ে উঠলো আরিফ? কেমন ছিলো সে জীবন? কেনইবা ফিরে এলো স্বাভাবিক জীবনে? 

সুন্দরবনের প্রতাপশালী দস্যু রাজু বাহিনীর সাথে বনে বাদাড়ে, সাগর-নদীতে ঘুরে বেড়াতে থাকলো কিশোর আরিফ। সময়গুলো দ্রুতই কেটে যাচ্ছিল। তবে মনের গহীনে প্রোথিত থাকা দস্যু হওয়ার বাসনা যে তখনো পূরণ হয়নি। অবশ্য সময় গড়ানোর সাথে সাথে আরিফ নিজের একটা জায়গা ঠিকই তৈরি করে নিতে থাকলো। একসময় রাজু বাহিনীর ক্যাশের হিসেব রাখার দায়িত্বও পেল।

প্রসঙ্গক্রমেই, তার কাছে থেকে জানতে চাওয়া হলো, দস্যু বাহিনীর টাকা আসতো কীভাবে আর তা ভাগাভাগি বা হতো কীভাবে?আরিফ জানায়, মাছের মৌসুমে জেলে, ট্রলার মালিকদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা পেত দস্যু বাহিনীগুলো। কেউ টাকা না দিলে তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে মুক্তিপণ আদায় করা হতো। এছাড়া বনের ভেতরে আরও নানা ধরনের অবৈধ ব্যবসার সাথে যুক্ত ছিল এসব বাহিনীগুলো। অনেক সময় সরাসরি নিজেরা যুক্ত না থাকলেও কাউকে সমর্থন দেয়ার বিনিময়ে টাকা পেত তারা। চাঁদা ও মুক্তিপণের টাকা আদায়ে বিকাশ সার্ভিস সবচেয়ে বেশি ব্যবহার করা হতো বলে জানায় আরিফ। তার কথা থেকে ধারণা পাওয়া যায়, সুন্দরবনের অনেক বড় বড় সাহেবদের সাথে দস্যু বাহিনীর লেনদেনের সম্পর্ক ছিল।

সাধারণত একেকটা মৌসুম হিসেব করে টাকা সংগ্রহ করা হতো। মৌসুম শেষে টাকা ভাগাভাগি হতো। প্রথমেই দলের প্রধান খাওয়া-দাওয়া, জ্বালানি, অস্ত্র-গোলাবারুদ ও অন্যান্য খরচ বাবদ একটা অংশ কেটে রাখতো। তারপর দলের সিনিয়র সদস্যদের জন্য একটা ভাগ আলাদা করে রাখা হতো। বাকি টাকা সদস্য সংখ্যা দিয়ে ভাগ করে সবার মাঝে সমানভাবে ভাগ করে দেয়া হতো। সেসময় রাজু বাহিনীতে ৫০-এর মতো সদস্য ছিল বলে জানায় আরিফ। এদের মধ্যে সিনিয়র সদস্য ছিল ১২/১৫ জনের মতো। বাহিনীর আয় উপার্জনও বেশ ভালো ছিল।

রাজু বাহিনীতে ফরহাদ নামের এক লোকের সাথে পরিচয় হয় আরিফের। ফরহাদ রাজু বাহিনীর সহযোগিতায় সাগরে নানা ধরনের ব্যবসা করতো। তার নিজেরও ছোটখাট একটা বাহিনী ছিল। তখন মাছের মৌসুম, সাগরে টাকা সংগ্রহের জন্য যাচ্ছে ফরহাদ। চৌকস মনে হওয়ায় আরিফকে তার সাথে নিয়ে যেতে চাইলো ফরহাদ। কিন্তু, রাজু রাজি হলো না। ততদিনে পুরো বাহিনীর ভরণ-পোষণ দেখভাল করে আরিফ। সে চলে গেলে খাওয়া-দাওয়া নিয়ে সবাইকে অসুবিধায় পড়তে হবে। ফরহাদের জোরাজুরি ও আরিফের আগ্রহের কারণে একসময় রাজি হলো রাজু। শর্ত দিলো, কোনো ধরনের ঝামেলাতে আরিফকে জড়ানো যাবে না।

সাগরে গিয়ে ঘটে গেল আরেক ঘটনা। প্রতিদ্বন্দ্বী অপর দুই দস্যুদল গামা আর কানা অলি বাহিনীর সাথে রাজু বাহিনীর সংঘর্ষ হলো, আরিফের ভাষায় ফাইট, আকস্মিক এ গোলাগুলিতে রাজু বাহিনীর অনেক ক্ষয়ক্ষতি হলো। কিন্তু, শেষ পর্যন্ত তারা প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করতে সক্ষম হলো। সেদিন আরিফ তার সাহস এবং গোপনবিদ্যা কাজে লাগিয়ে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিলো। ‌

এ ঘটনার পর অন্য বাহিনীগুলোর কাছেও আরিফের নাম ডাক ছড়িয়ে পড়তে থাকে। এ ঘটনার সত্যতা মিললো অন্যভাবেও।  পিরোজপুরের দস্যু মানজু ও মজিদ বাহিনীর আত্মসমর্পণ অনুষ্ঠানে গিয়ে নানা বয়সী বেশকিছু মানুষের সাক্ষাত পাওয়া গেল যারা আগে বিভিন্ন বাহিনীর সাথে দস্যুবৃত্তিতে যুক্ত ছিল। এদের মধ্যে কয়েকজনকে দেখিয়ে আরিফ বললো, এরা আমার দলের সদস্য ছিল। কথোপকথন খেয়াল করে দেখা গেল, এখনও আরিফকে তারা বেশ সমীহ করে কথা বলছে।

তো, গামা-আর কানা অলি বাহিনীর সাথে লড়াইয়ে জয়ী হয়ে ফিরে আসার পর রাজুকে সবিস্তারে সব জানালো ফরহাদ। সব শুনে, আরিফকে ডেকে গম্ভীর মুখে তার হাতে একটা অস্ত্র তুলে দিল রাজু। এতদিনে নিজেকে প্রমাণ করতে পেরে আরিফের আনন্দ যেন আর ধরে না। আরিফের ভাষ্যমতে, এরপর মামা সবসময় আমাকে সাথে রাখতো। তার ডানহাত হয়ে গেলাম আমি। আমার সাথে আলাপ না করে কোনো সিদ্ধান্ত নিত না সে। প্রশাসন সামলাতো মামা, আর বাকি সব দিক আমি খেয়াল রাখতাম। সবার ফোন বন্ধ থাকলেও আমার ফোন খোলা থাকতো। সবার কাছে আমার নাম্বার থাকতো।’

ক্ষমতার স্বাদ আরিফকে যেন আরও সাহসী ও বেপরোয়া করে তুললো। মাঝে মাঝে এলাকায় যেত সে। অনেক টাকা খরচ করার স্বভাব তার। এ নিয়ে তার উপলদ্ধি, টাকা তো অনেক কামাইছি, কিন্তু এ টাকা ধরে রাখা যায় না। অল্পকিছু মানুষ ছাড়া কেউ এসব টাকা ধরে রাখতে পারতো না।’

সুন্দরবনের আরেক দস্যু জুলফু বাহিনীর সাথে রাজু বাহিনীর দ্বন্দ্ব ছিল চরমে। জুলফুর কারণে বনের একটা বড় অংশের লোকজন রাজু বাহিনীকে চাঁদা দেয়া বন্ধ করে দিলো। জুলফুর লোকজন দাবি করতো থাকলো তারাই সুন্দরবন চালায়।

নারিকেলবাড়িয়া নামক স্থানে এক দুপুরে মুখোমুখি দেখা গেল দু’বাহিনীর। লেগে গেল তুমুল সংঘর্ষ । দুপুর গড়িয়ে বিকাল, বিকাল গড়িয়ে রাত গোলাগুলি চলতেই থাকলো। পরদিন দুপুর গিয়ে পিছু হটলো জুলফু। দু’বাহিনীর অনেক লোক হতাহত হলো। পুরোটা সময় রাজুর পাশে থেকে সাহসের সাথে ফাইট চালিয়ে গেছে আরিফ। জুলফু বাহিনীকে পরাস্ত করার পেছনে তার রণকৌশল নিয়ামক ভূমিকা রাখলো। এ ফাইটের পর তাকে দলের সিনিয়র সদস্যের মর্যাদা দেয়া হলো। আরিফ জানায়, বাহিনীগুলোতে কাজের ওপর নির্ভর করে পদ-পদবি বণ্টন করা হতো। যে যত ভালো ফাইট করতে পারতো, তার তত বেশি দাম ছিল। পাশাপাশি রাজুর ভাগ্নে হওয়ায় তার খাতির একটু বেশিই ছিল।

রাজু বাহিনীতে ভালো সময় যাচ্ছিল আরিফের। এদিকে, বাহিনী প্রধান রাজুর শরীরটা ভালো যাচ্ছিল না। নানা ধরনের রোগবালাইয়ের কারণে এ জীবনের ধকল নেয়া তার জন্য কঠিন হয়ে যাচ্ছিল। এ সময়ে এসে, যমুনা টেলিভিশনের বিশেষ প্রতিবেদক মোহসীন-উল হাকিমের নাম শুনলো আরিফ। সুন্দরবনের আনাচে-কানাচে ঘুরে বেড়ানো এই সাংবাদিক দস্যুদের আত্মসমর্পণ করার ব্যাপারে উৎসাহিত করছেন, দস্যুরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বনজীবীদের ওপর ছড়ি ঘোরাচ্ছে, তাদের মেহনতের উপার্জনে ভাগ বসাচ্ছে। এতকিছুর পর কি তারা শান্তিতে আছে? এসব প্রশ্নের উত্তর দস্যু রাজু বাহিনীর লোকদের কাছে ততদিনে স্পষ্ট। আসলেই তো, এ জীবনে শান্তি কোথায়? উপার্জনের টাকা তো তারা ধরে রাখতে পারে না। সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের মাধ্যমে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনের পথে ফিরে আসার ব্যাপারে আগ্রহী হয়ে উঠলো রাজু বাহিনীর অধিকাংশ লোকজন। যদিও শেষ পর্যন্ত নানা জটিলতায় দস্যু রাজুর আর আত্মসমর্পণ করা হয়নি।

সাংবাদিক মোহসীন-উল হাকিমের কাছে আত্মসমর্পণের আগ্রহ জানাচ্ছেন রাজু বাহিনীর এক সদস্য

রাজুর বিকল্প ভাবনা ছিল টাকা পয়সা নিয়ে ভারতে চলে যাবে। সেখানে নতুন করে শুরু করবে জীবন। সময়ের পালাবদলের সাথে সাথে আরিফের মাথায় নানা ভাবনা খেলা করতে থাকলো। মামা নাহয় ভারতে চলেই গেল। তার কী হবে? তারও কিছু একটা বন্দোবস্ত করা দরকার। নানামুখী ভাবনার স্রোত একসময় অর্থলোভের দিকে ঠেলে দেয় আরিফকে। বাহিনীতে তার সবচেয়ে বিশ্বস্ত সহযোগী বাচ্চু সাথে এসব নিয়ে আলাপ করে সে। রাজু বাহিনীর ক্যাশে জমা থাকা ৫২ লাখ টাকা নিয়ে কেটে পড়ার পরিকল্পনা করে দু’বন্ধু। পরিকল্পনামাফিক গোপনে ঘুমের ওষুধ কিনে আনায় আরিফ।

তখন, রাজু বাহিনী আদাচাকী ফরেস্ট অফিসে কিছুদিনের জন্য খুঁটি গেড়েছে। সেখানে রাজুর স্ত্রী-কন্যাও এসেছে। এক রাতে খাবারে বিষ মেশাতে যায় আরিফ ও বাচ্চু। এসময় নানা দ্বিধা-দ্বন্দ্ব পেয়ে বসে আরিফকে। যে মামা তার জন্য এতকিছু করলো, তাকে বিষ খাইয়ে মেরে ফেলবে? এ দোটানার মধ্যেই, কার যেন পায়ের আওয়াজ শুনতে পায় তারা। নিমেষেই ওষুধটুকু লুকিয়ে ফেলে আরিফ। সে দিন আর ঘুমের ওষুধ খাওয়ানো হয় না।

আদাচাকী ফরেস্ট অফিস: এখান থেকেই দস্যু রাজু বাহিনীর জমানো টাকা নিয়ে পালায় আরিফ ও বাচ্চু

সারা রাত নির্ঘুম কাটে আরিফের। বিছানায় শুয়ে এপাশ-ওপাশ গড়াগড়ি করতে থাকে। এ কাজ করা কি ঠিক হবে? এক সময় সে মনস্থির করে, এখান থেকে বের হতে হলে এটাই তার একমাত্র উপায়। তার ভাষ্যমতে, ‘আমার ভাবনা ছিল যে, তারাও তো আমাকে ব্যবহার করছিল। আমি সেখানে গিয়ে অনেক খাটনি করছি। মামা ইনডিয়া চলে গেলে আমার কী হবে ?’

পরের দিন ঠিক ঠিক খাবারে ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেয় আরিফ। খাওয়া-দাওয়া শেষে  সবাই একে একে ঘুমে ঢলে পড়তে থাকে। দেরি না করে দ্রুত বাচচুকে নিয়ে বনের ভেতর দিয়ে পালাতে থাকে আরিফ। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর নিরাপদ ভেবে তারা একটু জিরানোর জন্য বসে, আর তখনি গুলির শব্দ শুনতে পায়। তাদের খুব কাছ দিয়ে বাতাসে শিষ কেটে গুলিটি একটি গাছে আঘাত হানে।

(চলবে…)

প্রথম পর্ব পড়তে : এক কিশোর উঠে এলো দস্যু রাজু বাহিনীর ট্রলারে

যমুনা অনলাইন: টিএফ


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply