আজ ভয়াল ২১ আগস্ট: দ্রুত সাজা কার্যকরের তাগিদ

|

আজ ভয়াল ২১ আগস্ট। ২০০৪ সালের এ দিনে রাজধানীর ২৩ বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগ আয়োজিত সমাবেশে গ্রেনেড হামলা করে জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামী (হুজি)। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন।

আহত হন পাঁচ শতাধিক নেতাকর্মী। বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা প্রাণে বেঁচে গেলেও তার শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণায় সন্তোষ প্রকাশ করে তা দ্রুত কার্যকর করার জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানিয়ে আসছেন সেদিনের ঘটনায় নিহতদের পরিবার-পরিজন ও আহতরা। ২১ আগস্ট উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

দীর্ঘ ১৪ বছর পর ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর বহুল আলোচিত গ্রেনেড হামলা মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এ রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টু, এনএসআইয়ের সাবেক দুই মহাপরিচালক (ডিজি) মেজর জেনারেল (অব.) রেজ্জাকুল হায়দার চৌধুরী ও ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবদুর রহিমসহ ১৯ আসামিকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন আদালত।

অন্যদিকে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী, সাবেক প্রতিমন্ত্রী কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ আসামিকে যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে।

মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১৯ আসামির মধ্যে দুই আসামি পলাতক ও যাবজ্জীবন দণ্ডিত ১৯ জনের মধ্যে ১২ আসামি পলাতক রয়েছেন। এ ছাড়া রায়ে আনসার ও ভিডিপির সাবেক ডিজি মেজর জেনারেল (অব.) এটিএম আমিন, সাবেক তিন আইজিপি মো. আশরাফুল হুদা, শহুদুল হক ও খোদা বক্স চৌধুরীসহ ১১ সাবেক সরকারি কর্মকর্তাকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেয়া হয়। রায়ে দণ্ডপ্রাপ্তদের ৫০ হাজার টাকা থেকে এক লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদণ্ড দেয়া হয়।

২১ আগস্ট হামলায় গুরুতর আহত আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও পানিসম্পাদ উপমন্ত্রী একেএম এনামুল হক শামীম যুগান্তরকে বলেন, সেদিনের গ্রেনেড হামলার সঙ্গে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে খালেদা জিয়া ও তারেক রহমান জড়িত। দীর্ঘদিন মামলা চলার পর রায় হয়েছে।

আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক কিংবা মন্ত্রী হিসেবে নয়, একজন আহত ব্যক্তি হিসেবে এ রায় দ্রুত কার্যকর হোক প্রত্যাশা করছি। ২১ আগস্ট হামলায় গুরুতর আহত নাসিমা ফেরদৌস যুগান্তরকে বলেন, মামলার রায়ে আমরা খুশি হয়েছি। এখন এ রায় দ্রুত কার্যকর দেখে যেতে চাই। গ্রেনেডের স্পি­ন্টারের ব্যথা ভুলে থাকতে চাই। সরকারের কাছে দাবি আসামিদের দ্রুত শাস্তি কার্যকর করে দেশকে কলঙ্কমুক্ত করা হোক।

গুরুতর আহত লিটন মোল্লা জানান, আমি এখনও হাঁটতে পারি না। কিছুদিন পর পর চিকিৎসকের শরণাপন্ন হতে হয়। এ মামলায় যারা দোষী সাব্যস্ত হয়েছে তাদের রায় দ্রুত কার্যকর করার দাবি জানাই।

গ্রেনেড হামলায় নিহতদের স্মরণে কর্মসূচি ঘোষণা করেছে আওয়ামী লীগ। কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে- সকাল ৯টায় দলের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে নির্মিত বেদিতে পুষ্পার্ঘ্য নিবেদন এবং বিকেল ৪টায় কৃষিবিদ ইন্সটিটিউশন মিলনায়তনে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হবে। আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করবেন আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বক্তব্য রাখবেন দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবী ও জাতীয় নেতারা।

২০০৪ সালের এ দিন বিকালে রাজধানীর বঙ্গবন্ধু এভিনিউ সন্ত্রাসবিরোধী সভা ও শোভাযাত্রা উপলক্ষে আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মী এবং সাধারণ মানুষে কানায় কানায় ভরে ওঠে।

স্লোগানে স্লোগানে মুখরিত হয়ে ওঠে বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশের এলাকা। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের সামনে খোলা ট্রাকে বানানো উন্মুক্ত মঞ্চে বক্তৃতা দেন দলের শীর্ষস্থানীয় নেতারা। বিকাল ৫টার দিকে বুলেটপ্রুফ গাড়িতে সমাবেশস্থলে পৌঁছান তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। প্রায় ২০ মিনিট বক্তৃতা করেন তিনি।

বিকাল ৫টা ২২ মিনিটে বক্তৃতা শেষে সন্ত্রাসবিরোধী মিছিল শুরুর ঘোষণা দেয়ার ঠিক আগমুহূর্তে একের পর এক পৈশাচিক গ্রেনেড হামলা শুরু হয়। মুহূর্তে গোটা বঙ্গবন্ধু এভিনিউ মৃত্যুপুরীতে পরিণত হয়।

সন্ত্রাসবিরোধী সভা কভার করতে যাওয়া ফটোসাংবাদিকদের ছবি তোলার অনুরোধ রক্ষা করতে গিয়ে প্রায় এক মিনিট অপেক্ষা করেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা। ওই এক মিনিট অপেক্ষা না করলে হয়তো রচিত হতো অন্য এক কলঙ্কিত ইতিহাস। ভাগ্যক্রমে বঙ্গবন্ধুকন্যা বেঁচে গেলেও সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের সহধর্মিণী ও আওয়ামী লীগের মহিলাবিষয়ক সম্পাদক আইভি রহমানসহ ২৪ জন নিহত হন।

পাঁচ শতাধিক মানুষ আহত হন। বিস্ফোরিত গ্রেনেডের ধোঁয়া ও পুলিশের ছোড়া কাঁদুনে গ্যাসে আচ্ছন্ন হয়ে যায় বঙ্গবন্ধু এভিনিউসহ আশপাশ। শেখ হাসিনার গাড়ি লক্ষ্য করে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। নিক্ষিপ্ত গ্রেনেডগুলোর মধ্যে তিনটি অবিস্ফোরিত থেকে যায়।

শত শত মানুষের আর্তচিৎকার, ছড়িয়ে থাকা ছিন্নভিন্ন দেহ, রক্ত আর পোড়া গন্ধ সব মিলিয়ে বীভৎস অবস্থার সৃষ্টি হয় পুরো এলাকায়। আহতদের সাহায্য করার বদলে বিক্ষুব্ধ ও আহত মানুষের ওপর বেপরোয়া লাঠিপেটা আর কাঁদুনে গ্যাস ছোড়ে পুলিশ। মুহূর্তের মধ্যে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। আতঙ্কে এলাকা ছেড়ে পালাতে শুরু করে সবাই।

দলীয় সভাপতিকে বাঁচাতে ট্রাকের ওপর মানববর্ম রচনা করেন আওয়ামী লীগের নেতারা। সেদিনের গ্রেনেড হামলায় গুরুতর আহত আইভি রহমান ৫৮ ঘণ্টা মৃত্যুর সঙ্গে লড়াই করে ২৪ আগস্ট মারা যান।

তবে ওই দিনই নিহত হন মোস্তাক আহমেদ সেন্টু, ল্যান্স করপোরাল (অব.) মাহবুবুর রশীদ, রফিকুল ইসলাম আদা, সুফিয়া বেগম, হাসিনা মমতাজ রীনা, লিটন মুন্সী ওরফে লিটু, রতন সিকদার, মো. হানিফ ওরফে মুক্তিযোদ্ধা হানিফ, মামুন মৃধা, বেলাল হোসেন, আমিনুল ইসলাম, আবদুল কুদ্দুস পাটোয়ারী, আতিক সরকার, নাসিরউদ্দিন সর্দার, রেজিয়া বেগম, আবুল কাসেম, জাহেদ আলী, মমিন আলী, শামসুদ্দিন, আবুল কালাম আজাদ, ইছহাক মিয়া এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও দু’জন।

আহতের মধ্যে ছিলেন জিল্লুর রহমান, আমির হোসেন আমু, প্রয়াত আবদুর রাজ্জাক, আওয়ামী লীগের তদানীন্তন সাধারণ সম্পাদক আবদুল জলিল, সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত, মো. হানিফ, শেখ ফজলুল করিম সেলিম, আবদুল লতিফ সিদ্দিকী, অ্যাডভোকেট সাহারা খাতুন, ড. মহীউদ্দীন খান আলমগীর, কাজী জাফর উল্লাহ, ওবায়দুল কাদের, ড. হাছান মাহমুদ, মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া, এসএম কামালসহ পাঁচ শতাধিক আওয়ামী লীগ নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ।

দীর্ঘদিন চিকিৎসায় অনেকে কিছুটা সুস্থ হলেও পঙ্গুত্বের অভিশাপ নিয়ে বেঁচে থাকতে হচ্ছে অনেককে। সেদিনের সেই দুঃসহ স্মৃতি প্রতিনিয়ত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে তাদের।

২১ আগস্টের হামলার সময় পুলিশের ভূমিকা নিয়ে ব্যাপক বিতর্ক রয়েছে। অভিযোগ, আহতদের সাহায্যে এগিয়ে না এসে পুলিশ উল্টো তাদের হেনস্থা করে। তৎকালীন বিএনপি সরকারের ভূমিকা নিয়েও নানা বিতর্ক ও প্রশ্ন রয়েছে। এর তদন্তে পুলিশের নিষ্ক্রিয়তা নিয়েও ব্যাপক প্রশ্ন ওঠে।

জজ মিয়া নামের এক ব্যক্তিকে দিয়ে গ্রেনেড হামলার বিষয়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়ার বিষয়টি ব্যাপক সমালোচনার জন্ম দেয়। ২০০৭ সালের সেনা-সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময় ওই হামলার ঘটনায় পুনরায় তদন্ত হয়। সেই তদন্তে নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নান এবং তৎকালীন উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুর নাম বেরিয়ে আসে।

২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় এলে পুনরায় এ মামলার তদন্ত শুরু হয়। একই তদন্তে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের নামও উঠে আসে।

শেখ হাসিনার বাণী : বাসস জানায়, ২১ আগস্ট উপলক্ষে দেয়া বাণীতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, গ্রেনেড হামলা মামলায় দণ্ডিতদের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে দেশ থেকে হত্যা, সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের চির অবসান হবে এবং দেশে আইনের শাসন সুপ্রতিষ্ঠিত হবে।

২১ আগস্টের শোককে শক্তিতে পরিণত করে সন্ত্রাস ও জঙ্গিমুক্ত একটি শান্তিপূর্ণ, উদার, গণতান্ত্রিক উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণে তিনি দেশের সব নাগরিককে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, বাংলাদেশের ইতিহাসে ২১ আগস্ট একটি কলঙ্কময় দিন।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply