স্মরণে কাজী নজরুল ইসলাম

|

কাজী নজরুল ইসলাম। ছবি- ইন্টারনেট।

রাকিব হাসান রাফি:

এক হাতে তার অগ্নিবীণা, অন্যহাতে বিষের বাঁশি। ঝাঁকড়া চুলের বাবরি দোলানো এক মহান পুরুষ যার প্রতিটি লাইন যেনো মহান সৃষ্টিসুখের উল্লাসে কাঁপা! কণ্ঠে তার এক সুর:-

“আমি সেই দিন হবো শান্ত,
যবে উৎপীড়িতের ক্রন্দন-রোল, আকাশে বাতাসে ধ্বনিবে না,
অত্যাচারীর খড়গ কৃপাণ ভীম রণ-ভূমে রণিবে না –
বিদ্রোহী রণ-ক্লান্ত
আমি সেই দিন হবো শান্ত”

তিনি আর কেউ নন, আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম। যিনি একই সাথে বিদ্রোহী কবি হিসেবেও পরিচিত। তবে সে বিদ্রোহ নিতান্তভাবে অন্য সকল বিদ্রোহ থেকে প্রকৃতিগত দিক দিয়ে আলাদা। এ বিদ্রোহের পেছনে নেই কোনো অভিলক্ষ্য। কেবলমাত্র নিপীড়িত মানুষের উদ্দেশ্যে ধ্বনিত হয়েছে এ বিদ্রোহ।

সুকান্ত ভট্টাচার্য কিংবা রুদ্র মুহাম্মদ শহীদুল্লাহসহ অনেক কবিই বিদ্রোহের কবিতা রচনা করেছেন তবে তাদের প্রত্যেকের বিদ্রোহ ছিলো মার্কসবাদী চিন্তাধারার নিরিখে প্রতিফলিত, এদিক থেকে নজরুল ছিলেন সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র এবং তার বিদ্রোহী চেতনাকে কোনও ধরণের রাজনৈতিক আদর্শ দিয়ে কখনও ব্যাখ্যা করা সম্ভব নয়।

সমাজের সকল বৈষম্যের মূলে তিনি কুঠারাঘাত করেছেন নিম্নের দুই চরণের মাধ্যমে:-

“গাহি সাম্যের গান-
যেখানে আসিয়া এক হয়ে গেছে সব বাধা-ব্যবধান!”

বাংলা সাহিত্যে নজরুল হচ্ছেন এমন একজন কবি যাকে আপনি যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে সংজ্ঞায়িত করতে পারেন। একদিকে তিনি যেমন তার সাহিত্যচর্চায় ইসলামী মূল্যবোধ ও ভাবধারাকে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন, অন্যদিকে শ্যামা সঙ্গীত চর্চায়ও তিনি পারদর্শিতা দেখিয়েছেন। আবার ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে কেউই লেখনীর মাধ্যমে ধর্মনিরপেক্ষতাকে সেভাবে প্রষ্ফুটিত করতে পারেননি, কবি কাজী নজরুল ইসলাম যেভাবে করেছেন। বিংশ শতাব্দীতে ভারতবর্ষে তাই যখন হিন্দু এবং মুসলমান এ দুই সম্প্রদায়ের মানুষের মাঝে অসহিষ্ণুতা রীতিমতো যখন এক বিপর্যয়ের রূপ নিলো সে সময়ে তিনি লিখেছেন:-

“ মোরা এক বৃন্তে দু’টি কুসুম হিন্দু-মুসলমান।
মুসলিম তার নয়ন-মণি, হিন্দু তাহার প্রাণ।।
এক সে আকাশ মায়ের কোলে
যেন রবি শশী দোলে,
এক রক্ত বুকের তলে, এক সে নাড়ির টান।।
এক সে দেশের খাই গো হাওয়া, এক সে দেশের জল,
এক সে মায়ের বক্ষে ফলাই একই ফুল ও ফল।
এক সে দেশের মাটিতে পাই
কেউ গোরে কেউ শ্মাশানে ঠাঁই
এক ভাষাতে মা’কে ডাকি, এক সুরে গাই গান।।”

এমনকি সে যুগেও তিনি তার সন্তানদের নাম রেখেছিলেন কাজী সব্যসাচী, কৃষ্ণ মুহাম্মদ, কাজী অনিরুদ্ধ এবং অরিন্দম খালেদ। প্রাতিষ্ঠানিকভাবে খুব বেশিদূর অগ্রসর হতে পারেননি অথচ বাংলা সাহিত্যকে তিনি করেছেন সমৃদ্ধ। ৪২ বছর বয়সে তিনি মস্তিষ্কের এক দুরারোগ্য ব্যাধিতে আক্রান্ত হলে তার সাহিত্যচর্চায় ছেদ পড়ে এবং ধীরে ধীরে তার বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। সত্যিকথা বলতে গেলে তার সাহিত্যচর্চার সময় ছিলো বিশ থেকে চব্বিশ বছরের মতো যেটা নিতান্ত কম বলতে হবে। তবুও এ স্বল্প সময়ে তিনি তার লেখনীর দ্বারা গোটা বাঙালির হৃদয়ে এক বিশেষ স্থান দখল করে নিয়েছেন।

আর একারণে বিংশ শতাব্দীতে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর যে সময় বাংলা সাহিত্যের মধ্যগগণে পদচারণা করছেন, ঠিক সেসময় নজরুলের আবির্ভাবকে অনেকে ধূমকেতুর সাথে তুলনা করেছেন। নজরুলের আরও একটি কৃতিত্ব হচ্ছে বিশ্বের কোনও কবি কিংবা গীতিকার এককভাবে একসাথে এতো বেশি সঙ্গীতের রচনা করতে পারেননি যেটা নজরুল পেরেছেন। আরবি, ফার্সি, সংস্কৃতসহ বিভিন্ন ভাষার শব্দমালার সংমিশ্রণে তিনি নতুন নতুন অনেক সুরের সৃষ্টি করেছেন। আবার প্রেমিক কবি হিসেবেও নজরুল ঠাঁই করে নিয়েছেন কোটি কোটি যুগলের হৃদয়ে। তার রচিত একটি বিখ্যাত প্রেমের কবিতা:-

“তোমারে পড়িছে মনে
আজি নীপ-বালিকার ভীরু-শিহরণে,
যুথিকার অশ্রুসিক্ত ছলছল মুখে
কেতকী-বধূর অবগুন্ঠিত ও বুকে-
তোমারে পড়িছে মনে।
হয়তো তেমনি আজি দূর বাতায়নে
ঝিলিমিলি-তলে
ম্লান লুলিত অঞ্ছলে
চাহিয়া বসিয়া আছ একা,
বারে বারে মুছে যায় আঁখি-জল-লেখা।
বারে বারে নিভে যায় শিয়রেরে বাতি,
তুমি জাগ, জাগে সাথে বরষার রাতি।”

বস্তুতপক্ষে বাংলা সাহিত্যে নজরুলের তুলনা নেই, তিনি নিজেই তার প্রতিদ্বন্দ্বী। এমনকি নিখিল ভারতে স্বাধীনতাকামী মানুষের মাঝে প্রথম স্বাধীনতার বীজ বোপিত হয়েছিলো তার মাধ্যমে, এমনটি দাবি করলেও ভুল হবে না। সত্যি কথা বলতে গেলে ১৯২০ সালের ১২ জুলাই নবযুগ নামক একটি সান্ধ্য দৈনিক পত্রিকা প্রকাশিত হওয়া শুরু করে। অসহযোগ ও খিলাফত আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে প্রকাশিত এই পত্রিকার সম্পাদক ছিলেন শের-ই-বাংলা এ.কে. ফজলুল হক। এই পত্রিকার মাধ্যমেই নজরুল নিয়মিত সাংবাদিকতা শুরু করেন।

ঐ বছরই এই পত্রিকায় “মুহাজিরীন হত্যার জন্য দায়ী কে” শিরোনামে একটি প্রবন্ধ লেখেন যার জন্য পত্রিকার জামানত বাজেয়াপ্ত করা হয়। নজরুল ব্রিটিশ সরকারের জনরোষে পতিত হন এবং রাষ্ট্রদ্রোহীতার অভিযোগে তাকে কারারুদ্ধ করা হয়। স্বাধীনতাকামী মানুষের উদ্দেশ্যে তার লেখা:-

“কারার ঐ লৌহকপাট,
ভেঙ্গে ফেল, কর রে লোপাট,
রক্ত-জমাট
শিকল পূজার পাষাণ-বেদী।
ওরে ও তরুণ ঈশান!
বাজা তোর প্রলয় বিষাণ!
ধ্বংস নিশান
উড়ুক প্রাচীর প্রাচীর ভেদি।”

আজ ২৭শে আগস্ট, ১৯৭৬ সালের এ দিনে তিনি পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে পরপারের উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান। মৃত্যবার্ষিকীর এই দিনে তাই নজরুলের প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।

লেখক: শিক্ষার্থী, ইউনিভার্সিটি অব নোভা গোরিছা, স্লোভেনিয়া।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply