মোহসীন-উল হাকিম:
নেত্রকোণা ও সুনামগঞ্জের বন্যাদুর্গতদের জীবন বেঁচেছে ঠিকই। কিন্তু বাঁচানো যায়নি সম্পদ। বিস্তীর্ণ হাওরের ঘরে-ঘরে সেই হাহাকার। কিন্তু তাদের কথা শোনারও যেন কেউ নেই। বন্যায় ঘর ছেড়ে যাওয়া মানুষেরা এখন ফিরছেন একে একে। নিজের মতো করেই গুছিয়ে নেয়ার চেষ্টা চলছে। তবে প্রতিদিনের খাবার জোগাড় করাই যেখানে কঠিন, সেখানে নতুন ঘর উঠবে কী করে?
গোলাবাড়ির কামাল ঘরটি তুলেছিলেন এক বছর বছর হলো। এবারের বন্যা আর পানির তোড়ে ভেঙে গেছে তার ঘরটি। ভেসে গেছে সবকিছু। তছনছ হয়েছে স্বপ্ন। বন্যার পরপরই কামাল তার স্ত্রী-সন্তানদের পাঠিয়ে দিয়েছেন উজানের উঁচু এলাকায়, এক আত্মীয়ের বাড়িতে। আমার বাড়িঘর, যা কিছু ছিল সব ভেঙে গেছে বন্যার পানিতে। এখন বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে কই যাবো, কী করবো কিছুই বুঝতে পারছি না।
ঢেউ আর শ্রোত কমার পর থেকে প্রতিদিন নৌকা বেয়ে নিজের ঘরটি দেখতে আসেন কামাল। ধ্বংসস্তুপের ভেতরে খুঁজছেন কী যেন! সবই গেছে জেনেও চেষ্টা চলতেই থাকে। যদি কোনো কিছুর অবশিষ্ট থাকে! দূর জনপদের প্রতিবন্ধিতার শিকার প্রান্তিক এই মানুষটির সারা জীবনের জমানো সম্পদ ভেসে গেছে বন্যায়। কামাল জানান, ২-৪ মণ ধান, চাল, টাকাপয়সা যা ছিল সব ভেসে গেছে বন্যার তোড়ে। রাত ১২টা-১টার দিকে বুক সমান পানিতে সাঁতার কেটে উঁচু জায়গায় গিয়ে উঠেছেন। ঘরের চাল ঠিক করতেই ২০ থেকে ৫০ হাজার টাকা দরকার বলে জানালেন তিনি। বললেন, ঘরে খাবার নেই। বাচ্চাকাচ্চাদের কী খাওয়াবো জানি না।
হাওরের বিচ্ছিন্ন গ্রামগুলোর অবস্থা একটু বেশিই খারাপ। বন্যার রাতেই তাদেরকে এই অঞ্চল ছাড়তে হয়েছিল, ঘর ছাড়তে হয়েছিল। তাদের অনেকেই ঘরে ফেরার চেষ্টা করছেন। কিন্তু সেখানে ফেরার কোনো উপায় আর নেই। কারণ, সেই ঘরই যেখানে নেই, ঘরের আসবাবপত্র বা অন্যকিছু থাকার প্রশ্নও আসে না।
একটু একটু করে নামছে বন্যার পানি। তাহিরপুর-মধ্যনগরের ঘরভাঙা অন্য মানুষেরাও ফিরছেন নিজের গ্রামে, নিজের ঘরে। সেখানকার সবার বাস্তবতাই কামালের মতো। কেবল নিজের জীবন আর সন্তানসন্ততি নিয়ে ঘর ছেড়েছেন তারা। রক্ষা করতে পারেননি তারা সারা জীবনের সঞ্চিত সম্পদের কিছুই।
বন্যা দুর্গতদের মধ্যে সবচেয়ে দূরের এই জনপদের খোঁজ সেভাবে কেউ রাখছে না। তবে সেদিকে নজর দিয়ে সময় নষ্ট করছেন না কেউ। তিল তিল করে গড়ে তোলা সম্পদ তাদের। যতোটুকু ফিরিয়ে আনা যায় সেই চেষ্টায় ব্যস্ত তারা। ঘরে খাবার নেই। গবাদিপশুর জন্যও নেই কিছুই। নেই নেই’র সাম্রাজ্যে বন্যাকবলিতরা চালিয়ে যাচ্ছেন জীবন সংগ্রাম।
টাঙ্গুয়ার হাওরের মাঝের গ্রাম গোলাবাড়ি। পাশ দিয়ে বয়ে গেছে পাতলাই নদী। চারপাশ থৈথৈ করছে পানিতে। পাখির চোখে এই নদীর কিছু নিশানা দেখা যায়। করচ হিজলের গাছের ফাঁকে ফাঁকে ভেঙে পড়া ছোট ছোট গ্রামগুলোও পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে।
/এম ই
Leave a reply