বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অসম আচরণ অবিবেচনাপ্রসূত

|

ব্রাহমা চেলানি:

বাংলাদেশে আসন্ন সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করার পথে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করবেন সংশ্লিষ্ট যেসব কর্মকর্তা, তাদেরকে নতুন ভিসা নীতির আওতায় আনার ঘোষণা দিয়েছে মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের প্রশাসন। কিন্তু এই প্রশাসনই নীরব ভূমিকা পালন করছে পাকিস্তানের প্রতি, যেখানে জারি রয়েছে অঘোষিত সামরিক আইন। গণগ্রেফতার, গুম এবং অত্যাচার যেখানে পরিণত হয়েছে রাজনৈতিক হাতিয়ারে; সেই পাকিস্তানের ব্যাপারে মুখে কুলুপ এঁটে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আলোচনায় বাংলাদেশকে মূলকেন্দ্রে নিয়ে আসার মার্কিন প্রবণতাকে কীভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব?

এর সংক্ষিপ্ত উত্তর হচ্ছে, গণতান্ত্রিক অধিকার প্রসারের ক্ষেত্রে যুক্তরাষ্ট্রের প্রচেষ্টা দীর্ঘদিন ধরেই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। বরং, এক্ষেত্রে ভূ-রাজনৈতিক বিবেচনা প্রায়ই প্রধানতম হয়ে উঠছে। গণতন্ত্রের প্রসারের ক্ষেত্রে নৈতিক বৈধতার অন্বেষণও মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে নিষেধাজ্ঞা আরোপকে পছন্দের হাতিয়ার করতে ভূমিকা রেখেছে।

বাংলাদেশের ক্ষেত্রে বাইডেন প্রশাসন দু’টি বিষয়ের সর্বোচ্চ সুবিধা নিতে চাইছে: বাংলাদেশের অনেক রাজনীতিবিদদের ঘনিষ্ঠ আত্মীয়-স্বজন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা ব্রিটেনে বাস করেন। এর মধ্যে আছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পুত্রও যিনি যুক্তরাষ্ট্রের গ্রিন কার্ডধারী। এছাড়া, বাংলাদেশের রফতানির সিংহভাগই যায় পশ্চিমা দেশগুলোতে। সেই তালিকার শীর্ষ নাম মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র।

মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন ২০২৪ সালে বাংলাদেশের আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্যের কথা জানিয়েছেন, একটি সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনই এখানে প্রত্যাশিত। এ নিয়ে কারো আপত্তি থাকার কথা নয়। তবে, ‘গণতান্ত্রিক নির্বাচন প্রক্রিয়াকে ক্ষুণ্ন করার জন্য দায়ী বা জড়িত’ ব্যক্তিদের মার্কিন ভিসা না দেয়ার যে হুমকি তিনি দিয়েছেন; তা নির্বাচন ঘিরে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ্য অর্জনের পক্ষে সহায়ক হবে না বলেই প্রতীয়মান হয়। বরং, উল্টোটা প্রমাণিত হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতা এবং প্রথম রাষ্ট্রপ্রধানের কন্যা শেখ হাসিনা দাবি করেছেন, তার দেশের শাসনক্ষমতায় পরিবর্তন আনার কৌশল প্রণয়ন করছে যুক্তরাষ্ট্র। গত এপ্রিলে সংসদে দাঁড়িয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, তারা (যুক্তরাষ্ট্র) এদেশ থেকে গণতন্ত্র হটিয়ে এমন একটি সরকারের প্রবর্তন ঘটাতে চায় যাদের গণতান্ত্রিক কোনো অস্তিত্বই নেই। এমনটা ঘটলে তা হবে এক অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপ।

বাংলাদেশের ইসলামপন্থীদের কাছে চক্ষুশূল, এমন একটি ধর্মনিরপেক্ষ সরকারের নেতৃত্ব ২০০৯ সাল থেকে দিচ্ছেন শেখ হাসিনা। দেশকে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা এবং দ্রুত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি দিয়েছেন তিনি। যদিও ইউক্রেন যুদ্ধের ফলে বিশ্বব্যাপী চলমান অর্থনৈতিক সংকট এখন দেশটির অর্থনীতিতে প্রভাব ফেলেছে।

বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির বলিষ্ঠ গতির সম্পূর্ণ বিপরীতে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের দীর্ঘস্থায়ী রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অস্থিরতা। দেশটির অর্থনীতি এখন অচলাবস্থার দ্বারপ্রান্তে। তারপরও ২০২১ এবং চলতি বছরের শুরুতে বাইডেন আয়োজিত গণতন্ত্র সামিট থেকে বাংলাদেশকে বাদ দেয়া হয়। পাকিস্তানকে দুইবারই আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। কিন্তু তারা একবারও যোগ দেয়নি।

স্বল্পমেয়াদী ভূ-রাজনৈতিক নানা বিবেচনাকে অগ্রাধিকার দিয়ে পাকিস্তানকে যখন পুরস্কৃত করা অব্যাহত রেখে চলছে বাইডেন প্রশাসন, তখনই বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক পশ্চাদপসরণের সমালোচনা করে আসছে তারা। ২০২১ সালে বাইডেন প্রশাসন বাংলাদেশের র‍্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ন এবং সংস্থাটির ছয়জন বর্তমান ও প্রাক্তন কর্তাব্যক্তিকে চিহ্নিত করে। বলা হয়, বাংলাদেশ ঘোষিত মাদকের বিরুদ্ধে যুদ্ধের সময় মানবাধিকার লঙ্ঘনের সাথে জড়িত ছিলেন তারা। সেই সাথে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে র‍্যাবের সেই কর্তাব্যক্তিদের সমস্ত সম্পদ জব্দ করা হয়।

গত ডিসেম্বরে বাংলাদেশে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাস অসংবেদনশীলভাবে পুলিশ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টির (বিএনপি) সদস্যদের মধ্যে একটি মারাত্মক সংঘর্ষের ঘটনার তদন্ত দাবি করেন। বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট পার্টি দেশের বৃহত্তম বিরোধী দল এবং কট্টরপন্থী ইসলামিক কয়েকটি দলের সাথেও জোট করেছে তারা। অতি সম্প্রতি, স্টেট ডিপার্টমেন্টের এক বিবৃতিতে ব্লিঙ্কেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুল মোমেনকে ‘মিডিয়া এবং সুশীল সমাজের প্রতি সহিংসতা এবং ভীতি প্রদর্শনের বিষয়ে তার উদ্বেগের’ কথা জানিয়েছেন। ব্লিঙ্কেনের ভিসা নিষেধাজ্ঞার নীতিটি পরিষ্কারভাবেই হাসিনা সরকারের সদস্যদের লক্ষ্য করে ঘোষিত। এর মাঝে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী এবং অন্যান্য নিরাপত্তা কর্মকর্তারাও রয়েছেন। যদিও এই ভিসানীতির ঘোষণায় বিরোধী দলের সদস্যদেরও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

কিন্তু বিদেশি কর্মকর্তাদের ওপর স্যাংশন দেয়া কূটনৈতিক প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত করা ছাড়া খুব বেশি কিছু করতে পারে না। এর কিছু অনাকাঙ্ক্ষিত ফলাফলও থাকতে পারে।

এই মাসের শুরুতে, সিঙ্গাপুরে লয়েড অস্টিন এবং জেনারেল লি শাংফু’র মধ্যকার প্রতিরক্ষা সচিব পর্যায়ের একটি বৈঠকের ব্যাপারে ওয়াশিংটনের অনুরোধ প্রত্যাখ্যান করেছে বেইজিং। মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় লি’র উপস্থিতির কথা উল্লেখ করেছে বেইজিং। গত মার্চে চীনের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবে নিয়োগের পাঁচ বছর আগেই মার্কিন নিষেধাজ্ঞার তালিকায় লি শাংফুকে যুক্ত করা হয়েছিল।

এখানে আরও যোগ করা যেতে পারে যে, মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর কমান্ডার-ইন-চিফ মিন অং হ্লাইংসহ তিন সিনিয়র সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধেও নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে যুক্তরাষ্ট্র। এই কর্মকর্তারা ২০২১ সালে দেশটির বেসামরিক সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করার অভ্যুত্থানে অবদান রেখেছিলেন। তবে নিষেধাজ্ঞা পাওয়ার পরও ব্যক্তিগতভাবে এই কর্মকর্তাদের হারানোর খুব বেশি কিছু নেই। এরপর থেকে মিয়ানমারে একের পর এক মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় দেশটির অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিই কেবল বেড়েছে। সেই সাথে বেড়েছে মিয়ানমারের সাথে চীনের ঘনিষ্ঠতা।

মিয়ানমার থেকে ইরান, বেলারুশ থেকে কিউবা; মার্কিন নিষেধাজ্ঞা কোনো দেশেই রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়েছে। মার্কিন প্রভাবের আপেক্ষিক পতন এবং পশ্চিম থেকে প্রাচ্যে বৈশ্বিক ক্ষমতার চলমান পরিবর্তন মার্কিন নেতৃত্বাধীন নিষেধাজ্ঞাগুলোকে দিনদিন আরও কম কার্যকর করে তুলছে। তবে, পশ্চিমারা যেহেতু এখনও বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক কাঠামোর নিয়ন্ত্রক এবং বিশ্বের প্রধান রিজার্ভ মুদ্রা হিসেবে রয়ে গেছে ডলার; মার্কিন নীতিনির্ধারকদের কাছে নিষেধাজ্ঞা আরোপই হয়ে দাঁড়িয়েছে এক আকর্ষণীয় উপায়।

ঢাকার প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের এই ‘হার্ড লাইনে’ যাওয়ার তাই নিরেট কোনো অর্থ নেই। যুক্তরাষ্ট্রের সন্ত্রাসবিরোধী যুদ্ধ এবং এশিয়ার নিরাপত্তার উন্নতিতে হাসিনা সরকার হতে পারতো যুক্তরাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। তা না হয়ে এখন বাংলাদেশ-যুক্তরাষ্ট্রের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক রয়েছে চাপের মধ্যে। বিশ্বব্যাংক এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাথে আলোচনার জন্য গত মাসে যখন ওয়াশিংটন গিয়েছিলেন শেখ হাসিনা, তখন বাইডেন প্রশাসনের কেউ বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সাথে দেখা করেনি।

এই মাসে সিঙ্গাপুরে থাকাকালীন লয়েড অস্টিন ঘোষণা করেছিলেন যে, চীনের হুমকি কিংবা জবরদস্তির মুখে নিজেদের অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াবে না তার দেশ। কিন্তু বাংলাদেশের সাথে স্বার্থরক্ষার জন্য সেই হুমকি ও জবরদস্তিকেই হাতিয়ার বানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।

মূলত, বিশ্বের সপ্তম জনবহুল দেশকে এভাবে হুমকি দিয়ে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সহায়তা করা সম্ভব নয়। বরং, মার্কিনিদের এই আচরণে নতুন করে জেগে ওঠে ১৯৭১ সালের বেদনাদায়ক স্মৃতি। যখন ইসলামাবাদ থেকে পৃথক হতে চাওয়ার জন্য বাংলাদেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষাকে নৃশংসভাবে দমন করতে চেয়েছিল পাকিস্তানি সেনাবাহিনী, হত্যা করেছিল ৩০ লাখ বাঙালিকে; তখন কী ছিল যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকা? ওয়াশিংটন এখনই বা কী করছে?

ভাষান্তর: মঞ্জুরুল ইকরাম।

(লেখক: ব্রাহমা চেলানি, প্রফেসর ইমিরেটাস অব স্ট্রাটেজিক স্টাডিজ অ্যাট সেন্টার ফর পলিসি রিসার্চ ইন নিউ দিল্লি, ভারতের নিরাপত্তা কাউন্সিলের সাবেক পরামর্শক।)


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply