‘ক্লাব ২৭’র সদস্য হতে কি শয়তানের কাছে আত্মা বিক্রি করতে হয়?

|

এ এক অদ্ভুত ক্লাব। নাম তার ‘ক্লাব অফ টোয়েন্টি সেভেন’। নামী সব তারকারা এই ক্লাবের সদস্য। তবু শখ করে এই ক্লাবে নাম লেখাতে চান না কেউই। ছবি: সংগৃহীত।

অনেকের কাছে মনে হতে পারে স্কুল, কলেজ অথবা বিশ্ববিদ্যালয় ভিত্তিক কোন ক্লাব। আসলে তেমনটি নয়। এই ক্লাবে নাম লেখাতে চাইবেন না কেউই। সঙ্গীত প্রেমীদের কাছে ‘ক্লাব ২৭’ এক আক্ষেপের নাম। কারণ, গানের জগতের অনেক তারকা ২৭ বছর বয়সে মারা গেছেন। তাদের নিয়েই এই ক্লাব ২৭ ধারণার সৃষ্টি। বলা যায়, এদের প্রত্যেকের মৃত্যুই অস্বাভাবিক। কেউ মারা গেছেন অতিরিক্ত মাদক সেবনে, কাউকে হত্যা করা হয়েছে, কেউ আবার আত্মঘাতী হয়েছেন।

৬০’ র দশকের রক সংগীতের কিংবদন্তি জিমি হেন্ড্রিক্স৷ খুব অল্প সময়ে রক মিউজিকের জগতে নতুন অধ্যায়ের সুচনা করেছিলেন তিনি৷ হেন্ড্রিক্স ছিলেন একাধারে গীতিকার, সুরকার, গায়ক ও ভিন্ন উচ্চতার গিটারিস্ট ৷ মাত্র চার বছরে ৩টি স্টুডিও অ্যালবাম প্রকাশ করেন।

জিমি হেন্ড্রিক্স একটি কনসার্টে গিটার বাজাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু সংগীতের পাশাপাশি মাদকও ছিল তাঁর নিত্যদিনের সাথী৷ এম্ফিটামিন নামের উত্তেজক পদার্থ ব্যবহারের অভ্যাস ছিলো। ১৯৭০ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, মাত্র ২৭ বছর বয়সে লন্ডনের এক হোটেল কক্ষে মৃত্যু বরণ করেন রক সঙ্গীতের এই প্রবাদপুরুষ।

ফ্ল্যাটের বেডরুম যেখানে জিমি হেন্ডরিক্স থাকতেন। ছবি: সংগৃহীত।

জিমি ডাক্তারের প্রেসক্রিপশন থেকে ভ্যাসপারেক্স নামে ঘুমের ওষুধ নেন, নির্ধারিত ডোজের চেয়ে ১৮ গুন বেশি। সে রাতে সারারাত এ্যালকোহলও পান করেন। সকালে অচেতন অবস্থায় পাওয়া যায়। ময়নাতদন্তের পর তার শরীরে পাওয়া এম্ফিটামিন, ক্যানাবিস এবং এলকোহলকে এই মৃত্যুর জন্য দায়ী করা হয় ৷

জিমি হেন্ড্রিকসেরই সমসাময়িক, আরেক লিজেন্ড জিম মরিসন। বিখ্যাত ব্যান্ড ‘দ্য ডোরস’ ভোকালিস্ট এবং কবি হিসেবে ষাটের দশকে পুরো বিশ্বকে মাতিয়েছেন তিনি। প্রথম অ্যালবামেই বাজিমাত করে দেয় ‘দ্য ডোরস’, যাতে আছে ‘ব্রেক অন থ্রু’, ‘লাইট মাই ফায়ার’, ‘দ্য এন্ড’, ‘অ্যালাবামা সং’ এর মত জনপ্রিয় গান।

জিম মরিসন কনসার্টে গাইছেন। ছবি: সংগৃহীত।

জিম মরিসন ১৯৭১ সালের ৩ জুলাই মাত্র ২৭ বছর বয়সে ফ্রান্সের প্যারিসে মারা যান। তার মৃত্যর কারন হিসে্বে বলা হয় অতিরিক্ত হেরোইন এবং কোকেইনের ওভারডোজেই তার হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে তিনি অ্যাপার্টমেন্টের বাথটাবে মারা যান।

কনসার্টে গান গাইতে গাইতে দর্শকদের সামনে স্টেজে ঘুমিয়ে পড়েন জিম মরিসন। ছবি: সংগৃহীত।

হেন্ড্রিকস-মরিসনরা যেমন ষাটের দশকে মিউজিকে যেমন বিপ্লব এনেছিলেন, তেমনি নব্বইয়ের দশকে সঙ্গীতে নতুন ধারার সূচনা করেন কার্ট কোবেইন ও তার ব্যন্ডদল নির্ভানা। খুব সংক্ষিপ্ত ক্যারিয়ারে কোবেইনের অর্জন কম না! ৭৫ মিলিয়ন অ্যালবাম বিক্রি করার রেকর্ড আছে, পাঁচ-ছ’বছরেই ব্যান্ডের আয় ছিল ৫৫০ মিলিয়ন ডলার, পেয়েছেন কোটি ভক্তের ভালবাসা।

কার্ট কোবেইন আনপ্লাগড শোতে পারফর্ম করছেন। ছবি: সংগৃহীত।

৮ ই এপ্রিল, ১৯৯৪ ৷ সিয়াটলে কোবেইনের বাড়ির সামনে বাতি মেরামত করতে গিয়ে জানালা দিয়ে কোবেইনকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেন এই ইলেকট্রিক মিস্ত্রি৷ নিথর কোবেইনের কানের পাশটা রক্তাক্ত দেখে, দ্রুত পুলিশকে খবর দেন। পুলিশ দ্রুত হাজির হয়ে কোবেইনের মরদেহের পাশে একটা শটগান দেখে, নিশ্চিত হয় আত্মহত্যাই করেছেন এই রকস্টার ৷ তবে ফরেনসিক ডিপার্টমেন্ট জানায়, আরও তিনদিন আগেই কোবেইনের মৃত্যু হয়েছিলো ৷ তার হাঁটুতে জখমের দাগ, সুইসাইড নোট পরবর্তীতে কোবেইনের মৃত্যু নিয়ে নানা গুজব তথা কন্সপিরেসি থিউরির জন্ম দেয় ৷

সুইসাইড নোটে উঠে আসে একাকীত্ব, পেশাগত ক্লান্তি, স্ত্রীর সাথে ঝামেলায় কতটা জর্জরিত ছিলেন ২৭ বছর বয়সী এই রকস্টার ৷ ডিভোর্স নিতে চাইছিলেন, রকস্টার স্ত্রী কোর্টনি লাভকে বাদ দিতে চেয়েছিলেন উইল থেকে ৷ গুঞ্জন রয়েছে, হয়তো সে কারনে খুনই করা হয়েছে, কোবেইনকে, সাজানো হয়েছে আত্মহত্যার নাটক।

মাত্র দুটি অ্যালবাম। ২০ মিলিয়ন কপি বিক্রি। এক আসরেই ৫টি গ্র্যামি জয়। গিনিস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ডে নাম। ধূমকেতুর মতোই আবির্ভাব ঘটেছিলো ব্রিটিশ সঙ্গীতশিল্পি অ্যামি ওয়াইনহাউজের। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় গান রিহ্যাব।

অ্যামি ওয়াইনহাউজ শোতে পারফর্ম করছেন। ছবি: সংগৃহীত।

গানে গানে মাদকাসক্তি পুনর্বাসন কেন্দ্রে যেতে ঘোর আপত্তি জানিয়েছেন অ্যামি। কিন্তু সেই আপত্তিই যেন কাল হলো তার। ২০১১ সালে ২৩ জুলাই, নিজ বেডরুমে মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় ২৭ বছর বয়সী অ্যামি ওয়ানহাউজকে। চিকিৎসকরা জানালেন, মাত্রাতিরিক্ত মদ্যপানেই তার মৃত্যু হয়েছে। তার মৃত্যুতে ক্লাব ২৭’র তালিকাটা যেন আরেকটু দীর্ঘ আর ভারি হলো।

অ্যামি ওয়াইনহাউজের মাদক সেবনের পূর্বের ছবি (বামে) এবং পরের ছবি (ডানে)।

টুয়েন্টি সেভেন ক্লাবের আরেক সদস্য ‘দ্য রোলিং স্টোনস’ ব্যান্ডের প্রতিষ্ঠাতা সদস্য ব্রায়ান জোনস ৷ তীব্র মাদকাসক্তি জোনসকে অন্তিম এক হতাশার দিকে ধাবিত করেছিলো ৷ জোনস রোলিং স্টোনস ছাড়ার পর তার আসক্তি চরমে পৌঁছে। একদিন এক সুইমিংপুলে জোনসকে মৃত অবস্থায় ভাসতে দেখা যায় ৷ ময়নাতদন্তের পর জানা যায় অতিরিক্ত মাদকের প্রভাবে হঠাৎ দমবন্ধ হয়ে জোনসের মৃত্যু ঘটেছিলো৷ পরে অবশ্য অর্থকড়ি দেনাপাওনা নিয়ে এক নির্মাণকর্মীর হাতে জোনসের খুন হবার তত্ত্বও ছড়িয়ে পড়ে।

কনসার্টে পারফর্ম করছেন ব্রায়ান জোনস। ছবি: সংগৃহীত।

কিন্তু ২৭ বছর বয়সেই কেন মরতে হবে এসব সঙ্গীত তারকাদের? বিষয়টা কি নিছকই কাকতালীয়? পরিসংখ্যানের মারপ্যাচ? নাকি অন্য কিছু আছে। তারকাদের নিয়ে গুজব-গুঞ্জনের কখনও ঘাটতি হয় না। একদল দাবি করে বসলেন, এই শিল্পীরা শয়তানের সাথে চুক্তি করেছিলেন। চুক্তি অনুযায়ী নাকি শিল্পী কাঙ্খিত জনপ্রিয়তা পাবেন; কিন্তু এর বদলে তাদের চড়া দাম দিতে হবে।

অনেকে ২৭ সংখ্যাকে কাকতাল-ই মনে করেন। এমন শিল্পীদের সংখ্যাও নিছক কম নয় যারা ৩০ থেকে ৩২ বছর বয়সের মধ্যে মারা গেছেন। ব্রিটিশ রক ব্যান্ড লেড জেপেলিনের ড্রামার জন বনহাম ১৯৮০ সালে ৩২ বছর বয়সে মারা যান অতিরিক্ত মদ্যপানের কারণে। জনপ্রিয় মার্কিন শিল্পী জিম ক্রোচি যিনি ভক্তদের উপহার দিয়েছেন টাইম ইন আ বটলের মত গান। ক্রোচি বিমান দুর্ঘটনায় মাত্র ৩০ বছর বয়সেই মারা যান।

সঙ্গীত জগত রাজত্ব করা এই শিল্পীরা কেউ মারা গেলেন মাদকাসক্ত হয়ে, কেউবা সুইসাইড করে, কেউ দুর্ঘটনায়, অথবা বিষাদগ্রস্ত হয়ে, কিংবা খ্যাতির চাপ সামলাতে না পেরে। কারন যা ই হোক, কেন মারা গেছে, তা অমীমাংসিত, এই ক্লাবের নামকরণের ভিত্তিও অমীমাংসিত। কিন্তু এটা নিশ্চিত, তারা বেচে থাকলে আরও অনেক সমৃদ্ধ হতো সঙ্গীতের দুনিয়া। আরও অনেক শৈল্পিক সৃষ্টিতে আবিষ্ট হয়ে থাকতো সঙ্গীতপ্রেমিরা। আক্ষেপটা থাকবেই। এমন প্রতিভারা যাতে অকালেই ঝরে না যায়, সেদিকে যত্নবান হওয়ার প্রয়োজন সবার।

/এআই


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply