সূর্য দীঘল বাড়িতে বোকা পিঁপড়ের দল

|

আল মাহফুজ

বাংলাদেশের চলচ্চিত্রে অন্যতম সেরা এক সৃষ্টি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। কয়েক বছর আগে এটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল। বই নয়, সিনেমার কথা বলছি। দেখি দেখি করেও ব্যস্ততায় ব্যাটে-বলে মিলছিল না। ছবিটা দেখার পর মনে হয়েছিল– এমন ‘অবশ্য দ্রষ্টব্য’ সিনেমাকে হেলা করে ভুল করেছিলাম। কথাসাহিত্যিক আবু ইসহাকের বিখ্যাত উপন্যাস অবলম্বনে মসিহউদ্দিন শাকের ও শেখ নিয়ামত আলী যুগ্মভাবে ছবিটা নির্মাণ করেন।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন দুর্ভিক্ষ ও অবিভক্ত ভারতের পটভূমিতে গড়ে উঠেছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র গল্প। বাংলার অসহায় ক্ষুধার্ত মানুষের ওপর চিরন্তন শোষণের গল্প ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’। ধর্মকে ব্যবহার করে স্বার্থান্বেষীদের ‘চতুর শেয়াল’ বনে যাওয়ার গল্প দেখানো হয়েছে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’তে।

সিনেমার ব্যাপ্তি ১৩২ মিনিট। কিন্তু কখনোই মনোযোগ হারাতে হয় না। প্রধান চরিত্র জয়গুন, আমাদের চারপাশে ক্রমাগত সংগ্রাম করে যাওয়া পরিচিত এক নারী। বাস্তুহারা জয়গুন যতোটা চোয়ালবদ্ধ সংকল্পে বা খিটখিটে মেজাজে সংসার আগলে রাখে, ঠিক ততোটাই আগলে রাখে পড়শির দস্যি চোখ থেকে নিজের সম্ভ্রমকে। অতি চতুরের ভ্রূকুটি এড়িয়ে অটুট দৃঢ়তায় ‘স্বামী পরিত্যক্তা’ যে নারী এ অঞ্চলের চাল ও অঞ্চলে ফেরি করে বেড়ায়, তা দেখে দর্শকের তার প্রতি সহানুভূতি হয়। মমতায় তাদের চোখ ভিজে ওঠে হয়তোবা।

‘সূর্য দীঘল বাড়ী’র কিছু দৃশ্য। ছবি: আইএমডিবি

জয়গুনের একমাত্র মেয়ে মায়মুন। সময়ের পরিক্রমায় তার জীবনের পথের বাঁকও ধুলোয় ধূসরিত হয়ে দেখা দেয়। সেখানে অনুপস্থিত মমতার পরশ, ফোটে না কোনো নরম মাটির ফুল। তাদের জন্য সুদিনের স্বপ্ন দেখাটা যেন সাংঘাতিক অপরাধ! মায়মুনের বিয়ের দিনে জয়গুনকে ইচ্ছের বিরুদ্ধে তওবা পড়তে হয়। এরপর তার অঝোরে কান্না করার দৃশ্যটি বস্তুত আমাদের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়– পুরুষতান্ত্রিক সমাজে নারীরা এখনও হাতের পুতুল। পুরুষের যেমন ইচ্ছে, সেভাবেই তাদের ব্যবহার করা যায়। প্রসঙ্গত, হুমায়ুন আজাদের কথা মনে পড়ে যায়– ‘কেউ নারী হয়ে জন্ম নেয় না। ক্রমশ নারী হয়ে ওঠে।’

সিনেমায় আমার প্রিয় চরিত্র হয়ে দাঁড়ায় জয়গুনের বড় ছেলে হাসু। সদ্য কৈশোর পেরুনো এ যুবক যেন বঞ্চনার প্রতীক। মুটের কাজ করতে গিয়ে অবাঞ্ছিত হওয়া, নির্মাণ কাজ বন্ধ হওয়ায় ন্যায্য মজুরি না পাওয়া, চালের লাইনে দাঁড়িয়েও চাল ভাগ্যে না জোটা, ছোট ভাইকে দেখতে গিয়ে সৎবাবার পাটকেল নিক্ষেপ, পয়সা বাঁচিয়ে বোনের জন্য চুরি কিনে গালি হজমসহ নানা দিক থেকে আসা হাজার বঞ্চনা মুখ বুজে সয়ে যাওয়া হাসুর চোখে কিছু একটা দেখেছিলাম। সেখানে কষ্টের অশ্রু ছিল না। অভিযোগের তীর ছিল না। ছিল যেন প্রভাদীপ্ত সুন্দরে বন্দুকে ফুল ফোটানোর পণ। নাকি বন্দুকযুদ্ধের নীরব অভিলাষ– ‘দেখিস, একদিন আমিও..’

‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ ছবির চিত্রনাট্যেও ছিলেন নির্মাতাদ্বয়। কাজটি যত্ন সহকারে করেছেন তারা। পরিচালনায় যথেষ্ট মুন্সিয়ানার ছাপ থাকবারই কথা। তার কারণ, দুটি নাম। শেখ নিয়ামত আলী ও মসিহউদ্দিন শাকের। বাংলাদেশে ‘অঁতর নির্মাতা’ গড়ে ওঠেনি নানা কারণে। তবে এই বিশেষণ আমি শেখ নিয়ামতকে দিতে পারলে খুব খুশি হতাম। তার নির্মিত তিনটি ছবি (বাকি দুটি হল ‘দহন’, ‘অন্য জীবন’) দেখলে এই কথার যথার্থতা টের পাওয়া যাবে বলে আমার বিশ্বাস।

‘অন্য জীবন’ ছবির শুটিংয়ে শেখ নিয়ামত আলী

সিনেমাটোগ্রাফিতে আনোয়ার হোসেন। তবে তিনি ছিলেন বলেই তার কাছ থেকে আরেকটু ভালো আশা করেছিলাম। শেষ দৃশ্যটা ব্যক্তিগতভাবে আমার ভীষণ ভালো লেগেছে। সূর্যাস্তের বেলায় ঘর পোড়া জয়তুনের গোটা পরিবার উদ্বাস্তু হয়ে আবারও শহরমুখী হবার পথে। এক্সট্রিম লং শটে ক্যামেরা স্থির। মাথা নিচু করে জয়তুনেরা পিঁপড়ের দলের মতো চুপচাপ নির্বিকার হেঁটে যাচ্ছে। আমরাও বাকশুন্য হয়ে বসে থাকি। স্থির থাকি। আমাদেরও যেন কিছুই করার নেই!

জয়তুনের চরিত্রে ডলি আনোয়ারকে দারুণভাবে মানিয়েছে। মায়মুন চরিত্রে ইলোরা গওহরও বেশ মানানসই। এটিএম শামসুজ্জামান ছিলেন বরাবরের মতো অতুলনীয়। জহিরুল হক, লেনিন, আরিফুল হক, ফখরুল হাসান বৈরাগীসহ প্রায় সবার অভিনয়ই কম বেশি ভালো লেগেছে। তবে হাসান ইমামের অভিনয় দশাসই মনে হয়নি। রওশন জামিলের কথা না বললেই নয়। এই গুণী অভিনেত্রীর অসাধারণ অভিনয় তন্ময় হয়ে দেখি। দেখতে হয়। জীবন থেকে নেয়া (১৯৭০-৭১), তিতাস একটি নদীর নাম (১৯৭৩), দহন (১৯৮৬), চিত্রা নদীর পাড়ে (১৯৯৯)সহ অসংখ্য বিখ্যাত ও নন্দিত ছবিতে তিনি সহজাত মনোমুগ্ধকর অভিনয় করেছেন। তবে সে অনুযায়ী প্রাপ্য স্বীকৃতি পাননি তিনি।

অভিনেত্রী রওশন জামিল

সঙ্গীত আশানুরূপ হয়নি। ছবির ছন্দের সঙ্গে ম্যাচ করেনি বলে আমার মনে হয়েছে। দুয়েকটি জায়গা ব্যতিত ছবিজুড়ে মিউজিকের তেমন প্রভাব ছিল না। আগের দিন ঋত্বিক ঘটকের ‘মেঘে ঢাকা তারা’ দেখে এটা দেখতে বসেছিলাম, তাই হয়তো তুষ্টি আসেনি। ছুঁয়ে যাওয়ার মতো যেমন আবহ সংগীত আশা করেছিলাম কিংবদন্তি আলাউদ্দিন আলীর কাছ থেকে, তা খুঁজে পাওয়া যায়নি ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’তে। সিনেমার সিকোয়েন্স মোতাবেক কানে বা মনে দোলা দেয়নি সুর।

তবে ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’তে পেয়েছি বেগুনি সংগ্রামের নিদারুণ বাস্তবতা। ধর্মের অপব্যব্যহার, আদিম কুসংস্কার, অজ্ঞতা, দখলদারিত্ব ও সামাজিক বিধি নিষেধের শেকলে আটকে পড়া আমাদের চিরাচরিত যে গ্রাম ও তার অধিবাসী, তাতে ছবিটির নাম ‘সূর্য দীঘল বাড়ী’ বেমানান ঠেকে। আবার লেখক শহীদুল জহিরের মতো বলতে ইচ্ছেও হয়– ‘এটাই তো সূর্য দীঘল বাড়ী!’

‘অবশ্য দ্রষ্টব্য’ এই সিনেমার দুজন নির্মাতার একজন শেখ নিয়ামত আলী। ১৯৩৯ সালে ৩০ এপ্রিল কলকাতার ২৪ পরগনার সোনারপুর জেলায় এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। পঁচিশ বছর বয়সে ঢাকায় চলে আসেন এবং তখন থেকেই বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করতে থাকেন নিয়ামত।

এযাবৎকালে বাংলাদেশে যতোজন ফিল্মমেকার এসেছেন, তার মধ্যে অন্যতম সেরা শেখ নিয়ামত আলী। সিনেমায় অবদানের জন্য শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে তার সাফল্যে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারের পালক জোটে তিন তিনবার। আজ এই সৃজনশীল চলচ্চিত্র নির্মাতার জন্মদিন। জন্মদিনে তাকে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply